Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

অচেনা উটির উপকথা

চেনা উটি নয়। তার পরিবর্তে ভূমিপুত্র টোডা-কোটাদের গ্রামই ছিল গন্তব্যরানওয়েতে চাকা ছোঁয়ার সময়েই বুঝেছিলাম, মিশমিশে সবুজের দেশে এসে পড়েছি। কোয়েম্বত্তূর ছেড়ে হাইওয়েতে পড়ে গাড়ির স্পিডোমিটার আশির কাঁটা ছাড়াতেই চোখ জুড়িয়ে গেল সবুজে।

শ্যামলিমা: চা-বাগানের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য

শ্যামলিমা: চা-বাগানের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য

সায়নী ঘটক
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৯ ০১:০৮
Share: Save:

উদাগামণ্ডলম পরিচিত তার ছোট্ট ডাক নামেই। যে নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীলগিরির এক হিল স্টেশন। চা বাগান আর পাইনে মোড়া সেই জনপদের নাম উটি, যার গায়ে এখনও লেগে ব্রিটিশ উপনিবেশের গন্ধ। তলিয়ে দেখলে দেখা মেলে সেখানকার ভূমিপুত্রদেরও। টোডা, কোটার মতো সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখনও নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাককে আঁকড়ে থেকেও আদ্যন্ত আধুনিক। বোটানিক্যাল গার্ডেন, উটি লেক, জন সালিভানের স্টোন হাউসের বাইরের উটিকে খুঁজতেই ছিল এ বারের যাত্রা।

রানওয়েতে চাকা ছোঁয়ার সময়েই বুঝেছিলাম, মিশমিশে সবুজের দেশে এসে পড়েছি। কোয়েম্বত্তূর ছেড়ে হাইওয়েতে পড়ে গাড়ির স্পিডোমিটার আশির কাঁটা ছাড়াতেই চোখ জুড়িয়ে গেল সবুজে। রাস্তার দু’ধারে প্রথম প্রথম শুধুই নারকেল আর কলাবনের সারি। কারিপাতা বোঝাই ট্রাক দেখেই মনে হল, আগামী ক’টা দিন পাতে এই জিনিসটি তো থাকবেই! খানিক পরেই পাকদণ্ডী বেয়ে ঘুরে ঘুরে গাড়ি ভাঙতে লাগল চড়াই। এক একটা পাহাড়ের বাঁক ঘুরছে আর যেন সরে যাচ্ছে এক একটা পর্দা। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল আশপাশের সবুজও। নীলগিরি বায়োস্ফিয়ার রিজ়ার্ভ এরিয়ায় ঢুকে গিয়েছি ততক্ষণে। পাইন, ইউক্যালিপ্টাস, ওয়াটলের গহিন সমারোহের মাঝে পেরিয়ে যেতে লাগলাম একের পর এক এলিফ্যান্ট করিডোর, খাদের গার্ড ওয়ালে বসে কিচিরমিচির করা বাঁদরের দল। হঠাৎ ‘ভ্যাঁপ্পোর’ হর্ন শুনে চমকে দেখি, অবিশ্বাস্য সাবলীলতায় হেয়ার পিন টার্ন পেরোচ্ছে সবুজ রঙের লোকাল বাস। বুঝলাম, উটি শহরের কাছাকাছি এসে পড়েছি।

স্টার্লিং ফার্ন হিল পৌঁছতে মূল শহরটাকে বাইপাস করে, বনের ভিতরের রাস্তা নিল আমাদের গাড়ি। ক্যাম্পাসটাই যেন গোটা শহরটার একটা মিনিয়েচার। সামনেই চা-বাগান। লনে ক্যামেলিয়া, পিচ, ড্যান্ডেলিয়নের বাহার। কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই চোখ আটকাবে দেওয়ালজোড়া কারুকাজে। শিল্পীর খোঁজ করতে জানা গেল, স্থানীয় টোডা সম্প্রদায়ের মহিলারা কাপড়ের উপরে ফুটিয়ে তুলেছেন এই এমব্রয়ডারি, যার স্থানীয় নাম ‘পুখুর’। চাষবাস আর মধু সংগ্রহ করে দিন গুজরান করেন তাঁরা। তাঁদের হাতের কাজেও সাদার উপরে কালো-লালে ফুটে উঠেছে উপত্যকার ধাপ চাষ, ফুল আর মৌচাকের মোটিফ। সাজিয়ে রাখা মিনিয়েচারে তাঁদের জীবনযাত্রার টুকরো দেখতে গিয়ে সাধ হল, গ্রামে গিয়ে চাক্ষুষ করে আসার। রাতে এল্‌ক হিলের টেরেসে ডিনার সারতে সারতে পরদিন টোডা আর কোটাদের গ্রামে যাওয়ার প্ল্যান ছকে ফেললাম। তাপমাত্রার পারদ তখন দশের নীচে। শিশিরে ভিজে গিয়েছে টেবল ম্যাট আর সামনে অন্ধকার পাহাড়ের ঢালুতে ঝলমল করছে উটি শহর।

আস্তানা: টোডা সম্প্রদায়ের বাড়ি ‘মন্‌দ’

১২ বছরে একবার ফোটে নীল কুরিঞ্জি ফুল, নীলগিরি নাম সেই থেকেই। হোটেলের গাইড রিচার্ডের মুখে উটি শহরের ইতিবৃত্ত গল্পের মতো শুনতে শুনতে এগোতে লাগলাম। বিস্তীর্ণ গল্‌ফ কোর্স, সেন্ট থমাস চার্চ, বোটানিক্যাল গার্ডেন পেরিয়ে গাড়ি এগোল টোডা গ্রামের দিকে। নিরামিষাশী টোডাদের স্টেপল ফুড মাখন-ভাত। আমাদেরই মতো রোদে শুকনো মশলা বিশাল শিলনোড়ায় গুঁড়িয়ে নেওয়ার চল রয়েছে তাঁদের হেঁশেলেও। অর্ধেক পিপের আকারের থাকার জায়গাকে টোডারা বলেন ‘মন্‌দ’, মাটি থেকে ফুট চারেক উঁচু। যদিও গ্রামে পৌঁছে কয়েক ঘর পাকা বাড়িও চোখে পড়ল। টোডা মন্দির দেখব বলে এগোতেই রে রে করে উঠলেন স্থানীয়রা। সেখানে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ! পাথরের চাঁই দিয়ে বেড়া দেওয়া মন্দির সংলগ্ন টাওয়ার, স্থানীয় ভাষায় ‘পোওয়শ’। আমাদের গাড়িতে উঠলেন টোডা রমণী, মাঝে সিঁথি করা পাকানো কালো চুলের গোছা কাঁধের উপরে নেমে এসেছে। পঞ্চপাণ্ডবের আরাধনা করেন তাঁরা। কোটাদের গ্রামে পৌঁছেও দেখলাম, সেখানে আরাধ্য দেবদেবীদের তিনটি মন্দির পাশাপাশি, মা-বাবা-সন্তানের। আলাপ হল এক পরিবারের সঙ্গে, যাঁদের বাড়ির ছোট মেয়েটি শহরের কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। কোটা গ্রাম শহরের অন্য প্রান্তে। পথে পেরোতে হল লরেন্স স্কুল, নীলগিরি মাউন্টেন রেলপথের ছোট ছোট স্টেশন।

১৯৮৩-৮৪ সালের উটিকে ফ্রেমে ধরেছিল ডেভিড লিনের ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’, কমল হাসন-শ্রীদেবীর ‘সদমা’। কসমো-কালচারে সমৃদ্ধ এ শহরকে ব্রিটিশরা হ্যান্ডমেড চকলেট তৈরি থেকে শুরু করে শিখিয়েছিল অনেক কিছুই। তার কয়েক টুকরো সম্বল করে, ফেরার উড়ান ধরলাম।

অন্য বিষয়গুলি:

Travel Tourism Ooty Tribal Village
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy