রূপকথা: রাইন নদীর তীরে বাজ়েল শহর
রসায়নের গবেষক হিসেবে অনেক দিন ধরে বিভিন্ন বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগদান করার সুযোগ হয়েছে আমার। তেমনই কতিপয় নোবেল বিজয়ীকে নিয়ে এক বৈজ্ঞানিক কনফারেন্সের আসর বসেছিল সুইৎজ়ারল্যান্ড-এর বাজ়েল শহরে। সুইৎজ়ারল্যান্ডে হবে বলে বাড়তি উৎসাহ নিয়ে রিসার্চ পেপার জমা দিয়েছিলাম। কারণ, পশ্চিমের সব দেশেই শরতের এক অনন্য সৌন্দর্য পরিলক্ষিত হয়। পেপার নির্বাচিত হওয়ার পরে তাই আনন্দের মাত্রাও ছিল খানিক বেশি। ফল সিজ়নে এখানে গাছের পাতায় চলে রং বদলের খেলা। তাই কনফারেন্স শেষ হওয়ার পরে কয়েক দিন থেকে শহরটা ঘুরে দেখব বলে ঠিক করেছিলাম। সেই মতো শেঙ্গেন ভিসারও আবেদন করাই ছিল।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এক বার বলেছিলেন, ‘কোনও দেশের ইতিহাস নির্ধারিত হয় সেই দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের উপর।’ বাজ়েলের জন্য এটা পুরোপুরি সত্য। রাইন নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি আসলে ফ্রান্স, জার্মানি আর সুইৎজ়ারল্যান্ডের সীমান্ত। তা ছাড়াও বাজ়েল মূলত পরিচিত আন্তর্জাতিক মিউজ়িয়াম আর কেমিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যালস হাব-এর জন্য। তবে বাজ়েল বলতে আমার প্রথমেই যা মনে পড়ে, তা হল টেনিস কিংবদন্তি রজার ফেডেরারের জন্মস্থান।
আমার যাত্রা শুরু হল এখানকার বাণিজ্যিক রাজধানী জ়ুরিখ দিয়ে। এয়ারপোর্ট থেকে জ়ুরিখ মেন স্টেশনে আসার পথে পাহাড়ঘেরা এই ছোট সাজানো শহরের মধ্যে চোখে পড়ল বিখ্যাত লিন্ডট চকলেটের কারখানা। এখান থেকে সুইস রেল ধরে বাজ়েল। তার পর হোটেল পৌঁছতে বেশ সন্ধ্যা হয়ে গেল। ইউরোপের সব জনপ্রিয় শহরগুলিতেই দেখেছি, হোটেলের রিসেপশনে সেখানকার দ্রষ্টব্য জায়গাগুলিতে যাওয়ার জন্য দিক-নির্দেশকারী ম্যাপ বিনামূল্যে পাওয়া যায়। এখানেও একই ব্যবস্থা। তাই সন্ধ্যাটা নষ্ট না করে তড়িঘড়ি হোটেলের ঘরে ব্যাগপত্র রেখে শহরটা এক ঝলক দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই ঢুকে পড়লাম একটি সুইস চকলেটের দোকানে। কলকাতায় মিষ্টির দোকানে মিষ্টি যেমন থরে-থরে সাজানো থাকে, এখানে চকলেটগুলোও সেই ভাবে রাখা।
দর্শনীয়: বাজ়েলের ফাইন আর্টস মিউজ়িয়াম
ম্যাপ তো রয়েছেই। পরদিন সকালে তাই স্থির করলাম, পায়ে হেঁটে এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন গির্জা বাজ়েল মিনস্টার দেখে নেব। রাইন নদীর তীরে অবস্থিত এই বেলেপাথরের গির্জাটি আনুমানিক ১০১৯ থেকে ১৫০০ শতাব্দীর মধ্যে রোমানিয়ান এবং গথিক শৈলীতে নির্মিত। গির্জাটির পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান ফটকটি দু’জন নাইটের নামে তৈরি দু’টি টাওয়ার দ্বারা উত্তোলিত রয়েছে। এঁদের ত্রিমাত্রিক মূর্তিও চোখে পড়ে মূল ফটকের সামনে উঁচু আয়তাকার স্তম্ভের উপরে। উত্তরেরটি জর্জস্টুর্ম আর দক্ষিণেরটি মার্টিনস্টুর্ম নামে পরিচিত। এর মধ্যে মার্টিনস্টুর্মে একটি যান্ত্রিক ঘড়ি ও সানডায়াল আছে। তবে গির্জার ভিতরটা বেশ গা ছমছমে। চারদিকে বিভিন্ন প্রাচীন ছবি ও মূর্তি খোদাই করা আছে। ভিতর থেকে বেরিয়ে বারান্দা মতো বেশ একটা চওড়া জায়গা আছে। সেখান থেকে চোখে পড়ে রাইন নদীর স্বর্গীয় ভিউ!
বাজ়েলের প্রধান পরিবহণ বলতে ট্রাম! এই ট্রামগুলো অত্যন্ত সুসজ্জিত এবং অত্যাধুনিক। ট্রামে দৈনিক বা মাসিক যে কোনও টিকিট কেটে নেওয়া যায় স্টপের স্বয়ংক্রিয় কিয়স্ক থেকে। তার পর যেমন ইচ্ছে যখন খুশি সব দিকের রুটে ভ্রমণ করা যায়। শুনলে অবাক হতে হয় যে, বাজ়েল থেকে এই ট্রামে চেপেই ফ্রান্স বা জার্মানিও চলে যাওয়া যায়!
সীমানা: ট্রাইপয়েন্ট
দুপুরে একটি পথ-রেস্তরাঁয় সুস্বাদু জিলাটো আর টুনা মাছের পিৎজ়া দিয়ে লাঞ্চ সেরে রওনা দিলাম ত্রিদেশীয় সীমান্ত ড্রাইলেন্ডেরেক দেখার উদ্দেশে। এটি জার্মান শব্দ, ইংরেজিতে ট্রাইপয়েন্ট। সরকারি ভাবে এই ত্রিদেশীয় সীমান্তের অবস্থান রাইন নদীর মধ্যিখানে কোনও একটা জায়গায়। কিন্তু পর্যটক আকর্ষণের জন্য বাজ়েল বন্দর সংলগ্ন বিশাল জায়গা ঘিরে একটি ত্রিমুখী রকেট আকৃতির স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়েছে। এর তিনটি মুখ তিনটি দেশ অর্থাৎ ফ্রান্স, জার্মানি আর সুইৎজ়ারল্যান্ডের দিক নির্দেশ করছে। এক কথায়, বাজ়েল এই তিনটি দেশের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। সীমান্তে না আছে নো ম্যানস ল্যান্ড, না আছে কড়া পাহারা! দেখতে দেখতেই কখন যে সূর্য ক্রমশ ঢলে পড়েছে রাইনের অপর প্রান্তে, তা খেয়াল হয়নি। আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে মন আর বিমুগ্ধ আমার দৃষ্টি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, অগত্যা তাই ফিরে চললাম সেই অপরূপাকে পিছনে ফেলে। অজস্র ছবি ক্যামেরাবন্দি করলাম ঠিকই। তবে ফের আসার সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy