দৃশ্যমান: কালাপানি থেকে তুষারাবৃত ধৌলাগিরি।
বাইকে মুক্তিনাথের পথে। কলকাতা থেকে সোজা নেপালের মুস্তাং উপত্যকা। ট্রিপটার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হতে বছরখানেক সময় লেগেছিল। কারণ তার বছর দুয়েক আগেই লিউকেমিয়া ধরা পড়ে আমার। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস তো দূরস্থান, বাইক রাইড প্রায় বাদ পড়তে বসেছিল। কিন্তু সাধের বাইক আমাকে ছাড়ল না। ও-ই আমাকে টেনে বার করল ঘর থেকে। তল্পিতল্পা গুছিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে যে দিন বাইকে চেপে বসলাম, সে দিনও জানতাম না যে, ট্রিপটা কমপ্লিট করতে পারব। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য ফিটনেস প্রয়োজন। মানসিক ভাবে ফিট হলেও শরীর সব সময়ে সঙ্গ দেয় না। তবুও শতকরা একশো ভাগ মনের জোর সঙ্গী করেই বেরিয়ে পড়লাম মুক্তিনাথের পথে।
ভোর সাড়ে তিনটেয় শুরু হল যাত্রা। প্রথম দিন টার্গেট ছিল রক্সৌল বর্ডার। কিন্তু শরীরের জন্য সেই পর্যন্ত পৌঁছতে পারলাম না। ক্লান্ত লাগছিল। আসানসোল, দুর্গাপুর হয়ে রাত ন’টা নাগাদ পৌঁছলাম মুজ়ফ্ফরপুর।
পরদিন হেতোদা। এখান থেকেই আসল জার্নি শুরু। সে দিনের গন্তব্য পোখরা। আর সেই রাস্তা দেখার মতো। পারসা ওয়াইল্ডলাইফ রিজ়ার্ভ ও চিতোয়ান ন্যাশনাল পার্ককে সঙ্গী করে রাস্তা চলে গিয়েছে ভরতপুর পর্যন্ত। পাহাড়ে জঙ্গুলে রাস্তা এত সুন্দর যে, মাঝেমাঝেই আমরা বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম। চুপ করে শুধু দেখছিলাম জঙ্গল ও পাহাড়ের রূপ। গোটা রাস্তায় কত যে ঝরনা এল, তা গুনে রাখা যায় না। মাঝেমাঝে বেশ ভয়ও করছিল, বিপদ না বাধিয়ে বসি! কিন্তু সন্ধের মুখেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। পরের দিন সকালে উঠে যখন হোটেলের বাইরে এলাম, এক দিকে ফেওয়া হ্রদ আর অন্য দিকে অন্নপূর্ণা পাহাড়। তার মাঝে আমিও খানিকক্ষণ প্রস্তরীভূত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু স্ত্রী এসে পারমিট নিতে যাওয়ার তাড়া দিতে সেই ঘোর কাটল। টিআইএমএস ও এসিএপি পারমিট আদায় করতেই সে দিনটা কেটে গেল। সন্ধের দিকে স্থানীয় বাজার ঘুরে আর রেস্তরাঁয় খাবার চেখে বেড়ালাম। আমার শরীরের জন্য সে দিনের বিশ্রামটাও জরুরি ছিল। কারণ আসল পথই যে বাকি। পরদিনের গন্তব্য বেনি। সকাল সকাল মালপত্র বেঁধে আবার বাইকে চেপে বসলাম। নেপালের সর্বোচ্চ ও দীর্ঘতম সাসপেনশন ব্রিজ কুসমা গ্যাদি পার হলাম। ১১৭ মিটার উচ্চতায় প্রায় ৩৪৪ মিটার দীর্ঘ এই সেতু। এই ব্রিজের উপর দিয়ে যাওয়াটা সত্যিই সারা জীবন মনে থাকবে। এর পরে বেনি পর্যন্ত রাস্তায় কিছু খানাখন্দ থাকলেও বেশ ভালই বলতে হয়। কারণ তার পরের রাস্তাকে আর রাস্তা বলা চলে না। পাথর, বোল্ডার, ধুলো... কী নেই সেখানে! তার উপরে জায়গায় জায়গায় ধস। সেই রাস্তায় বাইক চালানোও খুব কঠিন। কয়েক বার পড়েও যাই বাইক থেকে। শরীর একদম সঙ্গ দিচ্ছিল না। হ্যালুসিনেশন হচ্ছিল। ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। শুধু দু’হাতে বাইক ধরা ছিল। সে ভাবেই কোনও রকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটা ছোট গ্রামে এসে পৌঁছলাম। সে রাতের মতো টিপল্যাঙের এক নেপালি বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হল।
উষর: কালীগণ্ডকীর নদীখাত
আরও পড়ুন: পঞ্জাব দী সোয়াদ
শেষ ৩০ কিলোমিটার জার্নি ছিল পৃথিবীর গভীরতম কালীগণ্ডকী গর্জের মধ্য দিয়ে। তবে সে দিন শুরুতেই ঠিক করে রেখেছিলাম, শরীরের অবস্থা মাথায় রেখে ঠিক করব কোথায় হল্ট নেব। এই রাস্তাটা সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু সে দিকে নয়, আমার মন ছিল রাস্তায়। এক দিকে কালীগণ্ডকী বয়ে চলেছে, অন্য দিকে তুষারাবৃত অন্নপূর্ণা, ধৌলাগিরি। এত উঁচু পাহাড়ের বুক চিরে কালীগণ্ডকী ঠিক ক্যানিয়ন বানিয়ে চলেছে। কেমন যেন, নিজের মধ্যেও সেই প্রত্যয় সঞ্চারিত হল। মনে হল, আমিও পারব। প্রকৃতিই যেন আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিল। সেখান থেকে কাদামাখা, বন্ধুর, প্রায় নেই রাস্তা ধরে পৌঁছলাম জমসম। পারমিট নেওয়া ও দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারলাম। তবে উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খাবারের দামের পারদও চড়তে থাকল। ভরসা কেবল ইনস্ট্যান্ট নুড্লস। বিকেলের মধ্যে কাগবেনি পৌঁছলাম। রাতে সেখানেই হল্ট। যেমন হাড়হিম করা ঠান্ডা, তেমন হাওয়া। ঘরের বাইরে পা রাখাই দুঃসাধ্য। আর শরীর তখন ছেড়ে দিয়েছে। ঘরের জানালা দিয়ে চোখ মেলে রইলাম প্রকৃতির দিকে। বরফে মোড়া পাহাড়, বিস্তীর্ণ উপত্যকা, স্বচ্ছ আকাশে উজ্জ্বল তারা... শান্তিতে বুজে এল চোখ।
আরও পড়ুন: সূর্যাস্ত, সমুদ্র ও স্মৃতিমেদুরতার গ্রিস
পরের দিন ফাইনাল রাইড মুক্তিনাথের পথে। ১৩ কিলোমিটারের রাস্তা পিচে ঢাকা। হিমশীতল ঠান্ডায় রাস্তার আইস স্লিটের মাঝে বাইক চালানো মুখের কথা নয়, যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু মুক্তিনাথ যখন লক্ষ্য, সব বাঁধন ছিঁড়ে মন ছুটছিল বাইকের চেয়েও বেশি গতিতে। অবশেষে পৌঁছলাম। তুষারাবৃত পর্বতরাজির মাঝে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, ধূপ-ধুনোর গন্ধ, উচ্চ স্বরে মন্ত্রোচ্চারণ মন শুদ্ধ করে তুলছিল। আমার এই ট্রিপ ঈশ্বরদর্শনের উদ্দেশ্যে ছিল না, কিন্তু ঈশ্বরলাভই হল বটে! মুক্তিনাথ মনের সংকোচ থেকে মুক্তি দিল। কোনও অসুখ মনের নাগাল পেতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy