তিরুভাল্লুভারের মূর্তি।
সন্ধ্যার উড়ানে কলকাতা থেকে চেন্নাই পৌঁছে সারারাতের অপেক্ষার পর ভোর ৪টে নাগাদ চোখ কচলাতে কচলাতে আবার উঠে বসলাম তিরুঅনন্তপুরমগামী বিমানে। দেড় ঘণ্টার সফর। বিমানবন্দর থেকে যখন বেরলাম, ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ৬টা পার করেছে। বিশ্বনাথনের গাড়িতে চেপে শুরু হল দক্ষিণ তামিলনাড়ু সফর।
তিরুঅনন্তপুরম শহর সবে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে। জাতীয় সড়ক ৪৭ ধরে গাড়ি ছুটছে। পারাসালা কেরলের শেষ গ্রাম। সীমান্ত অঞ্চল কালিয়াক্কাভিলা পেরিয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী জেলায় প্রবেশ। ১৯৫৬ সালের আগে পর্যন্ত কন্যাকুমারী জেলা কেরলের অন্তর্গত ছিল। আট্টুরে পৌঁছে প্রাতরাশের বিরতি।
আট্টুরকে পিছনে ফেলে আরও ১৩ কিলোমিটার চলার পর গাড়ি হাইওয়ে ছেড়ে বাঁ দিকের রাস্তায় ঢুকল। পৌঁছলাম থিরুপারাপ্পু। এখানে পাচিপাড়া নদী ৫০ ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ে সৃষ্ট হয়েছে মনোরম জলপ্রপাত। টিকিট কেটে চলে এলাম ফলসের সামনে। বছরে সাত মাস পুষ্ট। সামনের পার্ক চত্বরে স্থানীয়রা চড়ুইভাতির আসর জমিয়েছে। কেউ কেউ আবার স্নানের আনন্দে মেতেছে।
আরও পড়ুন: কল্পনার হিমাচল যখন সত্যিকারের
বেশি ক্ষণ কাটানো গেল না। কন্যাকুমারী এখনও প্রায় ৬২ কিলোমিটার দূর। পথে বুড়ি ছোঁয়ার মতো দেখে নিতে হবে পদ্মনাভপুরম প্যালেস। এগিয়ে চললাম। ২৫ কিলোমিটার পথ শেষ হল প্রাসাদের দোরগোড়ায়। ১৭৯৮ পর্যন্ত কেরলের ত্রাভাঙ্কোর রাজাদের রাজধানী ছিল পদ্মনাভপুরম। ভেলি পাহাড়ের পাদদেশে কেরলীয় আর্কিটেকচারে নির্মিত সূক্ষ্ম কারুকার্যময় কাঠের প্রাসাদ দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম। ৬ একর এলাকা জুড়ে সুবিশাল প্রাসাদ চত্বরে ১৪টি প্রাসাদ ভবন আছে। ক্লক টাওয়ার, মন্ত্রণালয়, অপূর্ব ম্যুরাল পেন্টিং, রাজপরিবারের আসবাব প্রভৃতি দেখে ঢুকলাম মিউজিয়ামে। প্রাচীন মূর্তি, মুদ্রা, ভাস্কর্য, অস্ত্রশস্ত্র তড়িঘড়ি দেখে যখন বেরোলাম তখন বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে।
থিরুপারাপ্পু জলপ্রপাত।
আরও ৩৭ কিলোমিটার পথ চলার পর কন্যাকুমারী পৌঁছলাম বেলা দেড়টা নাগাদ। তামিলনাড়ু ট্যুরিজমের ‘হোটেল তামিলনাড়ু’ দু’দিনের অস্থায়ী ঠিকানা। বেশ নিরিবিলি। পাশেই লাইটহাউস। লনে বসেই দেখা যায় নীল জলরাশির দুধসাদা ঢেউ। সানসেট পয়েন্টও খুব বেশি দূরে নয়।
বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল মন্দির।
দুপুরে ঘণ্টা দু’য়েক বিশ্রামের পর বিকেলে পৌঁছলাম তিন সাগরের পারে। বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের ত্রিবেণী সঙ্গম। ভারতের মানচিত্রটা মনে পড়ল। মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণতম বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছি। দূরে সুনীল সাগরের বুকে জেগে থাকা বিশাল প্রস্তরখণ্ডের উপর বিবেকানন্দের স্মৃতিবিজড়িত মন্দির। পাশেই অন্য একটি শিলায় ১৩৩ ফুট উঁচু বিখ্যাত তামিল কবি তিরুভাল্লুভারের মূর্তি।
আরও পড়ুন: উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ে জড়ানো মায়া চুম্বক
পশ্চিম আকাশ রাঙিয়ে সূর্য বিদায় নিল। পর্যটক ও স্থানীয় মানুষের সমাগমে তিলধারণের জায়গা নেই। কাছেই দেবী কন্যাকুমারী আম্মান মন্দিরে আরতি শুরু হয়েছে। দক্ষিণী বাদ্যযন্ত্রের সুরে মুখরিত চতুর্দিক। প্রায় ৩০০০ বছরের প্রাচীন। অধিষ্ঠিত দেবী কুমারীরূপী পার্বতীকে কেন্দ্র করে বেশ মজার উপাখ্যান প্রচলিত আছে। পার্বতী শিবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। শিবের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে দেবী কুমারী থাকার প্রতিজ্ঞা করেন।
ভাট্টাকোট্টাই ফোর্ট থেকে দেখা সুমুদ্র।
অন্ধকার ঘন হল। বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল মন্দিরে আলো ঝলমল করছে। কুমারী আম্মান মন্দিরের পাশ দিয়ে এগিয়ে বাজার এলাকা। কাছেই বাসস্ট্যান্ড। বড় বড় হোটেল, রেস্তরাঁ, দোকানের ভিড়। খুবই ঘিঞ্জি, জমজমাট পরিবেশ।
পদ্মনাভপুরম প্যালেস।
পরদিন খুব ভোরে ময়ূরের ডাকে ঘুম ভাঙল। এ দিকটায় প্রচুর ময়ূরের আনাগোনা। ভোর ৬টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম তিন সাগরের মিলনস্থলের কাছে। থিক থিক করছে ভিড়। ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিলাম। ঠিক ৬টা ৫ মিনিটে সূর্যোদয়ের আভাস দিতে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল মন্দিরে শঙ্খ বাজল। আকাশ মেঘলা। তাই মনোরম সূর্যোদয় দেখা থেকে বঞ্চিত রইলাম। শুধুমাত্র মন্দিরের পিছন থেকে দেখা দিল মেঘভাঙা রোদ্দুর।
সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে ফেরিঘাট পৌঁছে দেখি বিশাল লম্বা লাইন। বিবেকানন্দ রক যাওয়ার বোট এখান থেকেই ছাড়বে। মিনিট পাঁচেক লাইনে দাঁড়িয়েই বোঝা গেল, সারা দিন অপেক্ষা করলেও টিকিট কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে না। অন্য উপায়ও আছে, স্পেশাল টিকিট। সাধারণ টিকিটের মূল্য ৫০ টাকা, আর স্পেশাল টিকিট এর চার গুণ।
সময় বাঁচাতে স্পেশাল টিকিটে যাত্রা শুরু করলাম সকাল ১০টায়। সুবিশাল এই প্রস্তরখণ্ডের উপর ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁরই স্মৃতিতে ১৯৭০ সালে নির্মিত হয়েছে মন্দির। বিবেকানন্দ মণ্ডপম ও শ্রীপদ মণ্ডপম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। বিবেকানন্দ মণ্ডপমে স্বামীজির বিশাল মূর্তি ছাড়াও রয়েছে ধ্যানগৃহ, মেডিটেশন হল, বুক স্টোর। অনেকটাই বেলুড় মঠের মন্দিরের আদলে তৈরি। শ্রীপদ মণ্ডপমে আছে কন্যাকুমারী দেবীর পদচিহ্ন। সাগরঘেরা নীলাভ শোভা ও কন্যাকুমারী শহরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য মন কেড়ে নেয়।
এ পাড়ে ফিরলাম সাড়ে ১২টা নাগাদ। অক্টোবরের মাঝামাঝি। চড়া রোদ আর প্যাচপ্যাচে ঘামে প্রাণান্তকর অবস্থা। পরবর্তী গন্তব্য ভাট্টাকোট্টাই ফোর্ট। পথের দু’ধারে প্রচুর কলাবাগান। দূরে ছোট ছোট টিলা। ৫ কিলোমিটার চলার পর লিপুরম থেকে গাড়ি হাইওয়ে ছেড়ে ডান দিকের পথ ধরল। এক কিলোমিটার এগিয়েই পৌঁছে গেলাম ভাট্টাকোট্টাই ফোর্ট। যার অন্য নাম সার্কুলার ফোর্ট। সমুদ্রতীরবর্তী এই দুর্গটি নির্মাণ করেন ত্রাভাঙ্কোরের রাজা মার্তণ্ড বর্মা। উপকূলীয় প্রতিরক্ষা হিসেবে এটি নির্মিত হয়েছিল। দুর্গের উপর থেকে স্নিগ্ধ সাগর এক কথায় অনবদ্য। আকাশরঙা নীল আর সি-গ্রিন মিলেমিশে একাকার।
এক ডজন পদ সহযোগে দক্ষিণ ভারতীয় থালি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে হাজির হলাম সুচীন্দ্রম মন্দিরে। এখানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের একত্রে একটাই মূর্তি। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তিন দেবতার আলাদা ভাবে পুজো হয়।
বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ মন্দির থেকে বেরিয়ে ছুটলাম অনামী এক সৈকতের পথে। ১৪ কিলোমিটার চলার পর পৌঁছলাম পুথালাম। বড় রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ডান দিকের পথ ধরল। গ্রাম্য পরিবেশ। এলাকার নাম মানাকুড়ি। দু’কিলোমিটার গ্রাম্য পথের শেষে এক নির্জন সৈকতের সঙ্গে দেখা, চোথাভিলাই। সোনালি বেলাভূমির ধার ঘেঁষে নারকেল ও তালগাছের উপস্থিতি। গুটিকয়েক স্থানীয় মানুষ ছাড়া এক্কেবার ফাঁকা। দু’-এক জন স্নান করতে নেমেছে। বিচ লাগোয়া চিলড্রেন্স পার্ক। সাগরপারের ওয়াচ টাওয়ারে উঠে নীল সাগরের বিস্তার দেখতে দারুণ লাগে।
পিচের রাস্তার ওধারে ছোট্ট ঝুপড়িটায় বিশাল বড় হাঁড়িতে কফি তৈরি হচ্ছে কাঠের জালে। তালমিছরি, শুকনো আদা, গোলমরিচ, এলাচ দিয়ে ব্ল্যাক কফির নাম চুক্কু কফি। সঙ্গে মিরচি বড়া (স্থানীয় নাম মুলাক্কুবাজ্জি)। স্থানীয় স্বাদে বৈকালিক তৃপ্তি।
আকাশে হাল্কা মেঘ। সূর্য আজকের মতো বিদায়ের পথে। পশ্চিম আকাশটা লাল হতে হতে একটা সময় কালো হয়ে গেল। ফিরে চললাম কন্যাকুমারীর পথে।
কী ভাবে যাবেন: হাওড়া ও চেন্নাই থেকে সরাসরি ট্রেন যাচ্ছে কন্যাকুমারী। এ ছাড়া বিমানে বা ট্রেনে তিরুঅনন্তপুরম পৌঁছে গাড়িতে বা বাসে যাওয়া যায়। গাড়ির জন্য যোগাযোগ করতে পারেন: আর বিশ্বনাথন, ফোন: ৯৪৪৬১৭৬৫৮৬, ৮৯২১৩৯৩৬৫৭। এ ছাড়া নানা ভ্রমণ সংস্থাও গাড়ি ভাড়া দেয়। দরদাম করে নেবেন।
রাত্রিবাস: তামিলনাড়ু ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ‘হোটেল তামিলনাড়ু’।
ভাড়া ৮০০-৩৬০০। বুকিং ও বিশদ তথ্যের জন্য যোগাযোগ:
তামিলনাড়ু ট্যুরিজম
জি-২৬, দক্ষিণাপণ শপিং কমপ্লেক্স। ২, গড়িয়াহাট রোড (সাউথ), কলকাতা-৭০০০৬৮
দূরভাষ: (০৩৩) ২৪২৩৭৪৩২
ওয়েবসাইট: www.tamilnadutourism.org
এ ছাড়া বিভিন্ন মানের অনেক বেসরকারি হোটেল আছে।
ছবি: লেখক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy