Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

৮০০ যাত্রী নিয়ে হাওড়া থেকে পুরী, মাঝপথে সলিলসমাধি, বাঁচলেন না প্রায় কেউই

হাওড়ার ঘাট থেকে আটশো যাত্রী নিয়ে পুরী রওনা হয়েছিল স্টিমার। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়, সলিলসমাধি হয় সব যাত্রীর। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা ভাবিয়েছিল কবিকেও। হাওড়ার ঘাট থেকে আটশো যাত্রী নিয়ে পুরী রওনা হয়েছিল স্টিমার। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়, সলিলসমাধি হয় সব যাত্রীর। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা ভাবিয়েছিল কবিকেও।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সুনন্দনকুমার সেন
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

হাওড়ার চাঁদপাল ঘাটে ভিড়। ১৮৮৭ সালের ২৫ মে— ‘স্যর জন লরেন্স’ নামে একটা বড় স্টিমার দাঁড়িয়ে ঘাটে। ক্লাইভ ঘাট স্ট্রিটের ম্যাকমিলান অ্যান্ড কোম্পানির স্টিমার। এই কোম্পানির ব্যবসা ছিল সমুদ্র পথে যাত্রী পরিবহণের। স্যর জন লরেন্স-ও যাত্রীবাহী স্টিমার, গন্তব্যস্থল পুরী। সে সময়ে কলকাতা থেকে পুরী যেতে জলপথই একমাত্র ভরসা। সমুদ্রপথে প্রথমে বালেশ্বর, সেখান থেকে কটক। কটক থেকে পায়ে হেঁটে বা অন্য যানবাহনে পৌঁছতে হত পুরী।

চাঁদপাল ঘাটে ভিড় হওয়া খুব স্বাভাবিক। পুণ্যলাভের আশায় পুরী বাঙালির প্রিয় গন্তব্য। স্টিমারে চড়তে যে বিপুল সংখ্যক যাত্রী সে দিন ঘাটে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগ মহিলা। ধনী ও অভিজাত পরিবারের মহিলারা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন দরিদ্র পরিবারের প্রচুর সধবা ও বিধবা মহিলাও। হাওড়া, হুগলি, চব্বিশ পরগনা থেকেও প্রচুর যাত্রী এসেছিলেন। দুশোরও বেশি পুরীর পান্ডাও নাকি ওই স্টিমারেই ফিরছিলেন পুরী। বড় স্টিমার, সামনের ও পিছনের ডেক মিলিয়ে প্রায় ৭২৫ জন যাত্রী ধরে। ১৮৮৭ সালে জাহাজ কোম্পানি পুরী যাওয়ার স্টিমার ভাড়া ধার্য করেছিল তিন টাকা দু’পয়সা। কিন্তু চাহিদা নাকি এতই ছিল যে টিকিটের দাম বেড়ে হয় পাঁচ টাকা দুই পয়সা। অতিরিক্ত লাভের আশায় কোম্পানি প্রায় সব যাত্রীকে পুরী নিয়ে যেতে উদ্যোগী হয়। স্টিমারে ওঠামাত্র যাত্রীদের কাছে আরও এক টাকা দাবি করে বসে। যারা সেই দাবি মানেননি, তাঁদের নাকি নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল! এমন যাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় আশিরও বেশি।

স্টিমারের ক্যাপ্টেন ছিলেন জন আরভিং— কোম্পানি নিযুক্ত অন্যতম অভিজ্ঞ ও সাহসী ক্যাপ্টেন। প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা ছিল তাঁর। অতীতে এক বার ওড়িশায় প্রবল ঝড়ের মধ্যে পড়েও দক্ষ হাতে যাত্রীদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। সে বারও তিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন এই স্টিমারেরই।

অসংখ্য যাত্রী রওনা হয়ে গেলেন পুরীর পথে। কিন্তু সে দিন তাঁরা ভাবতেও পারেননি, কোন নিয়তি অপেক্ষা করে আছে তাঁদের জন্য। বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত হয়েছিল এক নিম্নচাপ, শক্তি বাড়িয়ে তত ক্ষণে যা পরিণত প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। এই প্রাকৃতিক পরিস্থিতি যে তখনকার আবহাওয়া দফতরের অজানা ছিল তা নয়। যাত্রার দিন সকালেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, সমুদ্র উত্তাল হবে, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবর্তী স্থলভাগে আছড়ে পড়বে প্রবল ঘূর্ণিঝড়। জাহাজ কোম্পানি সম্ভবত এই খবর জেনেও চেপে যায়। যথাসময়ে আছড়ে পড়ল প্রবল ঘূর্ণিঝড়। হুগলি নদীতে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে স্ট্র্যান্ড রোড-সহ আরও কিছু এলাকায় নদীর জল ঢুকে পড়ল।

কলকাতা থেকে ২৫ মে রওনা হয়ে দিন তিনেকের মধ্যে কলকাতায় ফিরে আসার কথা ছিল স্যর জন লরেন্স-এর। কিন্তু চার-পাঁচ দিন পরেও স্টিমারটির কোনও হদিশ মিলল না। জুন মাসের গোড়ায় সংবাদপত্রে একটি খবর প্রকাশিত হল— কলকাতার দিকে আসা অন্য একটি জাহাজের নাবিক শ’য়ে শ’য়ে লাশ দেখতে পেয়েছেন! পরবর্তী কালে যে কয়েকটি লাশ উদ্ধার হল, তার মধ্যে পাওয়া গেল ক্যাপ্টেন জন আরভিং-এর বিকৃত লাশও। যে ক’টি ‘নেটিভ’দের মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখা যেতে গিয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশই মহিলা। বোঝা গেল, স্যর জন লরেন্স স্টিমারটি গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারেনি, মাঝসমুদ্রে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পড়ে তলিয়ে গিয়েছে। শয়ে শয়ে নরনারীর অসহায় সলিল সমাধি ঘটল।

ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে স্টিমারটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে আরও বিপদে পড়ে। স্টিমারের ধারণ ক্ষমতা ছিল ৭২৫, বন্দর দফতরের তথ্য অনুসারে সে দিন যাত্রীসংখ্যা ছিল ৭৩২। কিন্তু এর সপক্ষে নিশ্চিত কোনও প্রমাণ বন্দর দফতর দিতে পারেনি। সংবাদপত্রের তথ্য অনুসারে সে দিন স্টিমারে আটশোরও বেশি যাত্রী ছিল। স্টিমার ডুবে গিয়েছে জেনেও কোম্পানি প্রথমে ঘটনাটি পুরো চেপে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সংবাদপত্রে হইচইয়ের ফলে এক সময় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আদালতে মামলা হয়। কোনও যাত্রীই জীবিত ছিলেন না, তাই আদালত প্রত্যক্ষ কোনও সাক্ষীও পেল না। যে ক’জন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন ওই যাত্রীদের আত্মীয়স্বজন। ‘নেটিভ’দের সাক্ষ্য স্বাভাবিক ভাবেই আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আদালতের রায় কোম্পানিকে সরাসরি দায়ী না করে দায়ী করল স্টিমারের মৃত ক্যাপ্টেনকে। ক্যাপ্টেনের গোয়ার্তুমি আর ঝুঁকির জন্যই নাকি এই কাণ্ড হয়েছিল।

ইতিহাসের পাতা থেকে হয়তো মুছেই যেত এই মর্মান্তিক ঘটনা। গেল না দুটি স্মৃতিফলকের কারণে। আজও হাওড়ার জগন্নাথ ঘাটে গেলে দেখতে পাওয়া যায় একটি ধূসর মলিন ফলক। সে দিন স্টিমারডুবির ফলে যে অসংখ্য যাত্রীর সলিলসমাধি হয়, তাঁদের স্মরণে এই ফলকটি লাগানো হয়েছিল জগন্নাথ ঘাটে। আর একটি ফলক আছে হাটখোলা দত্তপাড়ার গলির মধ্যে একটি বাড়ির দেওয়ালে। কয়েকটি লাইনে বলা আছে, সে দিনের ঘটনায় মৃত্যু হয় এই বাড়ির গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর। আর ১৮৮৭-র আষাঢ় মাসে এই ঘটনাকে মনে করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন কবিতা ‘সিন্ধুতরঙ্গ’। ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থে আজও অমর সেই লাইনগুলো— ‘‘জল বাষ্প বজ্র বায়ু লভিয়াছে অন্ধ আয়ু, নূতন জীবনস্নায়ু দানিছে হতাশে,/ দিগ্বিদিক নাহি জানে, বাধাবিঘ্ন নাহি মানে, ছুটেছে প্রলয়-পানে আপনারি ত্রাসে!/ হেরো মাঝখানে তারি আট শত নরনারী বাহু বাঁধি বুকে/ প্রাণে আঁকড়িয়া প্রাণ, চাহিয়া সম্মুখে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Steamer Disaster Rabindranath Tagore Depression
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy