শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস: দ্য ফরগট্ন হিরো’ ছবির পোস্টার।
ভা রত স্বাধীন হয়েছে নেতাজির জন্যে। গাঁধীজির জন্যে বা জওহরলাল নেহরুর জন্য নয়।’ বললেন ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার। দক্ষিণ কলকাতায় তাঁর বাড়িতে বসে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন, দূরদর্শনে নেতাজি সম্পর্কে তথ্যচিত্রের জন্য। বললেন, নেতাজির আইএনএ’র ব্রিটিশ-বিরোধী যুদ্ধের কথা জানতে পেরে, ভারতে ব্রিটিশ ফৌজের মধ্যে আনুগত্য টলে গিয়েছিল। ব্রিটিশ শক্তি বুঝতে পারল, এই সেনাদের দিয়ে এত বড় দেশ তারা আর ধরে রাখতে পারবে না। সে জন্যেই ভারত ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ব্রিটিশদের নিতে হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার সেই তথ্যচিত্রে বলেছিলেন, ১৯৪৫-এর অগস্টে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি যে মারা যাননি, তার একটা বড় প্রমাণ: ব্রিটিশ গোয়েন্দা দফতরের ডকুমেন্ট। ওই বিমান দুর্ঘটনার তারিখের অনেক পরে, ব্রিটিশ গোয়েন্দা দফতরের কলকাতা অফিস লন্ডন অফিসের কাছে জানতে চাইছে, নেতাজিকে হাতে পাওয়া গেলে তারা কী করবে। লন্ডন অফিস জানাচ্ছে, নেতাজিকে নিয়ে কী করা উচিত, তা তারা যথাসময়েই জানাবে। রমেশচন্দ্র বলেছিলেন, এই সব তথ্য নিয়ে কারও যদি আপত্তি থাকে, তবে তাঁরা ব্রিটিশ ডকুমেন্ট দেখে নিতে পারেন। এই তথ্যচিত্রে সমাজের নানা স্তরের মানুষ তাঁদের ভাবনা, বিশ্বাসের কথা প্রকাশ করেছিলেন খোলাখুলি ভাবে। সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল এই সত্য— নেতাজি তখনও মানুষের মনে এক দৃপ্ত প্রেরণার অগ্নিশিখা। তাই তথ্যচিত্রটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আজও এক অগ্নিশিখা’। তথ্যচিত্রটি শেষ করতে গিয়ে ওই একই নামে আমার লেখা কবিতার দুটি লাইন ব্যবহার করেছিলাম, ‘মানচিত্রে এক অগ্নিশিখা/ বুকে আজও এক অগ্নিশিখা।’
নেতাজিকে নিয়ে নানা ধরনের মতামত ও বিশ্লেষণ প্রকাশের এক মুক্তমঞ্চ হয়ে উঠেছিল তখন দূরদর্শন। নেতাজি-গবেষক পূরবী রায় জানিয়েছিলেন, নেতাজির সঙ্গে কমিউনিস্টদের যোগাযোগের কথা। তাঁর মত, নেতাজিকে ভারত ছেড়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন প্রাক্তন গদর পার্টির সদস্যরা। ১৯৪৫-এর ১৮ অগস্ট তাইহোকুতে কোনও বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেনি। নেতাজি চলে গিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। তিনি স্তালিনের সময়ে সেখানে নিরাপদে ছিলেন। সেই সময়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাতায়াত করতে দেওয়া হয়নি। স্তালিনের মৃত্যুর পর, ১৯৫৬ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট দলের ২০-তম কংগ্রেসে স্তালিনের মতাদর্শের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার প্রবলতার সময় নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস থেকে তিনটি টেলিগ্রাম আসে— নেতাজি রাশিয়াতে আছেন। তা হলে কি রাশিয়াতে ১৯৫৬ সালেই নেতাজির জীবনের সমাপ্তি ঘটে? এই প্রশ্ন তোলেন অধ্যাপিকা পূরবী রায়। ঠিক উলটো মত জানিয়েছিলেন নেতাজির পরিবারের সদস্য, সাংবাদিক আশিস রায়। তিনি বলেছিলেন, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছে এবং রেনকোজি মন্দিরে নেতাজির ভস্মাধারে তাঁর সোনায় বাঁধানো একটি দাঁত রক্ষিত আছে, সেটির ডিএনএ পরীক্ষা করলেই প্রমাণিত হবে, এই ভস্ম নেতাজিরই।
বিদেশি নেতাজি-গবেষক লেনার্ড গর্ডন জোর দিয়েছিলেন নেতাজির জীবন ও কর্মপ্রবাহে তাঁর দাদা শরৎচন্দ্র বসুর প্রভাব, সহযোগিতা ও অবদান বিষয়ে। দুই ভাইয়ের ব্রিটিশ-বিরোধী ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। অনিতা বসু পাফ আমাদের অনুষ্ঠানে জানান, তাঁর কাছে তাঁর বাবা নেতাজি এক ইতিহাস-পুরুষ। বাবা সম্পর্কে তাঁর কোনও ব্যক্তিগত স্মৃতি নেই। মায়ের কাছে ছেলেবেলা থেকে শুনেছেন, ইতিহাস পড়ে জেনেছেন। আর এখন ভারতে এসে তাঁর আত্মীয়স্বজন ও অন্যদের কাছে নেতাজি সম্পর্কে জেনে তিনি যেন নবজন্ম লাভ করেছেন।
২০০৪ সালে শ্যাম বেনেগাল ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস: দ্য ফরগট্ন হিরো’ কাহিনিচিত্রটি তৈরি করেন। তিনি আমাদের অনুষ্ঠানে সুগত বসুকে বলেছিলেন, এই সিনেমাটা করতে গিয়ে কী ভাবে তিনি নেতাজিকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন।
আমাদের এই সমস্ত কাজে কলকাতার নেতাজি ভবনের সহযোগিতার কথা মনে পড়ে। অতুলেন্দু সেন ছিলেন অডিয়ো-ভিস্যুয়াল বিভাগের দায়িত্বে। নেতাজির ফোটো, বক্তৃতা, ফিল্মের অংশ আমাদের জোগান দিতে সব সময় তৎপর থাকতেন। সহযোগিতা করতেন আইএনএ-র প্রাক্তন সেনা, নেতাজি ভবনের সঙ্গে যুক্ত নগসুন্দরমও।
নেতাজিকে নিয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তাঁর ভাষণ শুনতে শুনতে, তাঁর গভীর প্রত্যয়ী দেশপ্রেম এবং তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা ও দর্শনের কথা পড়তে পড়তে নেতাজি হয়ে উঠলেন আমার জীবনের ‘হিরো’।
বর্মা থেকে মণিপুরে যে পথ ধরে আইএনএ ফৌজ এসেছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে, সেই পথ ধরে আমাদের টিম গিয়েছিল ইতিহাসকে খুঁজে দেখতে। শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত গিয়েছিলেন ক্যামেরা টিম নিয়ে, জেনেছিলেন সেখানকার মানুষ তখনও কেমন নেতাজি-আবেগে উদ্দীপ্ত, আপ্লুত। ঐতিহাসিক তথ্য হচ্ছে, ওই অঞ্চলে চার বার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আইএনএ ফৌজ অসীম বীরত্ব নিয়ে যুদ্ধ করে। মণিপুরের ময়রাং-এ তারা আইএনএ-র পতাকা উত্তোলন করে, বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করে। অবশ্য নেতাজি নিজে মণিপুরে আসেননি। কিন্তু লোকবিশ্বাস, তিনি এসেছিলেন। আমাদের ক্যামেরার সামনে স্থানীয় এক ব্যক্তি একটি নদী দেখিয়ে বলেছিলেন, সেই নদীর ধারে নেতাজির সঙ্গে তাঁর বাবার প্রথম দেখা হয়। তার পর তাঁরা দুজনে সেখানে অনেক আলোচনা করেন। আর এক জন তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন নেতাজির নামে এক বিদ্যালয়। ময়রাং-এ নেতাজিকে নিয়ে মিউজিয়ামটির কথা ফিল্মে বিশেষ ভাবে তুলে ধরা হয়। ‘অফ দ্য বিট্ন ট্র্যাক: ময়রাং’ নামে এই ফিল্মটির গবেষক ছিলেন নিত্যপ্রিয় ঘোষ। আইএনএ ফৌজ যখন ময়রাং অঞ্চলে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত, প্রকৃতি বিরূপ হয়ে উঠল, প্রবল বৃষ্টি শুরু হল, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সন্ধিক্ষণে জাপানিরা তখন মার খাচ্ছে, তার ফলে আইএনএ-কে যে অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা রক্ষা করতে পারল না। ফলে আইএনএ-র সেনারা সাহস ও প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হন। ৫ জুলাইয়ের ঐতিহাসিক ভাষণে নেতাজি সেনাবাহিনীর সামনে বলেছিলেন ‘কমরেডস! সৈনিক! তোমাদের রণহুঙ্কার হোক ‘চলো দিল্লি’। এই স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে আমাদের মধ্যে কে কে বেঁচে থাকবে, আমি জানি না। কিন্তু আমি এ কথা জানি, শেষ পর্যন্ত আমরা জিতবই।’— তাঁর সেই অক্ষয় বিশ্বাসের কথাগুলো আমরা বর্মা থেকে মণিপুরের সেই ঐতিহাসিক পথে পথে যেন ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হতে শুনেছিলাম।
pankajsaha.kolkata@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy