Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৪

মায়া প্রপঞ্চময়

রেডিয়ো নিয়ে ওর আদিখ্যেতায় ওকে ঘরে-বাইরে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুনতে হলেও বেন্দা সে সব গায়ে মাখে না। ওর সেই শখের রেডিয়োটাই হঠাৎ করে বিগড়ে গিয়েছে! 

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৪
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: বহু বছর পরে অন্ধকারে বসে অতীতচারিতায় ডুবে যায় অনিকেত। মনে পড়ে, যৌবনে আত্মহত্যার চিন্তা করেছিল সে। গবেষণা ছেড়ে চলে আসে বাড়িতে। আসল কারণটা বলতে পারেনি বাবা-মাকে। চার্বাক দর্শনে বিশ্বাস ছিল তার। বুঝতে পেরেছিল অনামিকার সঙ্গে পরিচয় বদলে দিয়েছে তাকে। কিন্তু তার চিন্তায় ছেদ ফেলল চাঁদু। সে গ্রুপ ডি কর্মচারী, কিন্তু অনিকেতের সব খেয়াল রাখে। অন্য দিকে পুরুলিয়ার বান্দোয়ান রেঞ্জের ফরেস্ট গার্ডের চাকরি থেকে অবসর পেয়েছে বৃন্দাবন কুম্ভকার ওরফে বেন্দা।

একটাই সুবিধে, পুরুলিয়া জেলার প্রত্যন্ত এলাকা বান্দোয়ানে জন্ম-কর্ম হলেও বন্ধুবান্ধব, সঙ্গীসাথীদের মতো না হয়ে বেন্দা সারা জীবনে বিড়ি ছাড়া আর কোনও নেশার কবলে পড়েনি। কেবল রেডিয়োটাই ওর নিত্যসঙ্গী, চারিদিকের কেবল টিভি, ভিডিয়ো এমনকি মোবাইল নিয়েও তার আসক্তি নেই। রেডিয়োর অনুষ্ঠান কখন কোনটা, তা ওর মুখস্থ। রেডিয়ো নিয়ে ওর আদিখ্যেতায় ওকে ঘরে-বাইরে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুনতে হলেও বেন্দা সে সব গায়ে মাখে না। ওর সেই শখের রেডিয়োটাই হঠাৎ করে বিগড়ে গিয়েছে!

কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে মন দিয়ে করার উপায় আছে? রেডিয়োটা নিয়ে বসা ইস্তক নব্বই ছুঁই-ছুঁই বুড়ো বাপের গজগজানি শুরু হল, ‘‘দেখো ক্যানে, লবাবপুত্তর সাতসকালো রেডিয়ো লিয়ে বইসছ্যান, বুঢ়া বাপটোর ইদিক্যে য্যা প্যাটটো ফুইলে জয়ঢাকটো হইয়ে গ্যালছে সিদিকে কুন্যো ব্যাটার লজর লাই! কত্তোবার মাঠে ঘুরে বুলচি, কিন্তুক শালোর প্যাট আর কিলিয়ার হয় না। পাছটায় য্যানো রাব্বনের চিতা জ্বলতিছে। এ জীবনে ধিৎকার লেইগ্যে গ্যায়লো রে, বাপ!’’ শেষটায় হাহাকারের মতো শোনায় কথাগুলো। পরিণত বয়সে কোষ্ঠকাঠিন্যের চেয়ে বড় অভিশাপ আর নেই।

আগেকার বোকা-হাঁদা বেন্দা হলে রহস্যটা বুঝতে পারত না, কিন্তু বছর দেড়েক আগের একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্টের পরে মাথাটা বেশ খোলতাই হয়েছে ওর। ক’দিন ধরেই বাপের বিলাপ শুনতে শুনতে তিতিবিরক্ত হয়ে আজই ও সাতসকালে ছেলের বৌয়ের নজর এড়িয়ে রান্নাঘর হাঁটকে-পাঁটকে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখা নিষিদ্ধ বস্তুটা আবিষ্কার করে ফেলেছে। প্রায় অর্ধেক হয়ে যাওয়া দুশো গ্রামের লঙ্কাগুঁড়োর একটা প্যাকেট! লাতবৌয়ের সঙ্গে সবসময় খিটির-মিটির লাগিয়ে রেখেছে বুড়ো, ওর হাত থেকে বাঁচতে সাত-তাড়াতাড়ি বুড়োকে চিতায় তোলার জন্য ফিকিরটা এঁটেছে সনাতনের বৌ। বোধহয় তার মায়েরই পরামর্শে। প্রথমটায় খটকা লেগেছিল বেন্দার। খাওয়ার সময় বাপটা টের পায় না কেন? একটু ভাবতেই বুঝতে পেরেছে, এটা পাকা মাথার কাজ। বুড়োর মিষ্টিতে প্রবল আসক্তি। তাই দাদাশ্বশুরকে খেতে দেওয়ার সময় তরকারির বাটিতে বেশ খানিকটা লঙ্কাগুঁড়ো আর এক খাবলা গুড় মিশিয়ে দিলেই হল!

এক্ষুনি কথাটা বলে দিলে আর এক দফা লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়ে যাবে সকালবেলাতেই। নিজের দোষ এক কথায় মেনে নেওয়া এই প্রজন্মের ধাতে নেই। ফলে কথায় কথা বাড়বে। অথচ ওর রেডিয়োটা ঠিক করা খুব দরকার। রহস্যটা যখন জানা হয়েই গিয়েছে, সমাধান শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই অন্য কথায় কান না দিয়ে রেডিয়োটার কলকব্জা নিয়ে বসতে না বসতেই আর এক বিপত্তি। হঠাৎই বাড়ির বাইরে বাজখাঁই আওয়াজ, ‘‘বেন্দা, বাড়ি আচিস ন কি রা?’’

গলার আওয়াজে বেন্দা ভালই বোঝে, এটা মদনা কাহারের মার্কামারা গলা। ব্যাটা পাঁচফুটিয়া তালপাতার সেপাইটার গলায় ভগবান যেন মাইক ফিট করে দিয়েছে। মদন হল বান্দোয়ান হেডকোয়ার্টার বিটের বনশ্রমিক। বছর চারেক বাকি আছে অবসর নিতে। ও কিছু জবাব দেওয়ার আগেই মদনা সদর দরজা ঠেলে উঠোনে ঢুকে পড়ে। ‘‘হ্যাঁ দ্যাখ্য বাপ, চাকরি গ্যালচে বুল্যে কি বেত্যো ঘোড়ার পারা বাড়িতে বস্যে আছিস ন কি! ইদিকে বড়বাবু তুকে চারিদিকে খুঁজে বুলছে, বেবাক ভুল্যেই গ্যালচে যে বেন্দা এখন আর উয়ার বাঁধা পাইলট নাই বটেক। চল কেনে এক বার, দেক্যা করে শুনে লিবি কী দরকারটো পইড়ল্য।’’

ভাল বাইক চালাতে পারে বলে সব রেঞ্জারবাবুর কাছেই বেন্দার কদর। ট্রান্সফারের চাকরিতে রেঞ্জ অফিসার, বিট অফিসাররা আসে যায়। গ্রুপ ডি কর্মচারী বলে বেন্দা এক জায়গাতেই রয়ে গিয়েছে। যিনিই বড়বাবু হিসেবে বান্দোয়ান রেঞ্জের দায়িত্বে থাকুন, বেন্দাই হল তাঁর পাইলট। এত দিন ডাক পড়ত যখন-তখন এ ধার-ও ধার যেতে, বিশেষ করে হঠাৎ পুরুলিয়া যাওয়ার দরকার হলে। বেন্দার মনে হল এক বার বলে, ‘‘যেতে নাই পাইরব্য। আমি অখুন কারও কিন্যা গোলাম লই, স্বাধীন বটি।’’ কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও কথাই বার হল না।

দেড় বছর আগে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মাথায় চোট পেয়ে কী যে রোগ ধরল, পুরুলিয়ার বড় ডাক্তারবাবুও কুলকিনারা করতে পারল না। দাঁতভাঙা খটোমটো সব ইংরিজি বলে বেন্দাকে বুঝিয়ে দিল, এ রোগ সারবার নয়। ওর নাকি বর্তমান আর অতীতে ঘোরাফেরা করার রোগ হয়েছে। ও ভাববে অনেক কিছু মনে মনে, কিন্তু মুখ দিয়ে সবটা বেরবে না। এখনকার কথা সবটা মনে রাখতে পারবে না, তবে বিশ-তিরিশ বছর আগের কথা

স্পষ্ট ছবির মতো মনে ভাসবে। কোনওটা মনে পড়বে, কোনওটা পড়বে না, তার ওপর ওর হাত থাকবে না। এমনিতেই বেন্দা কম কথার মানুষ, রেঞ্জারবাবু মানে বড়বাবুর ফাইফরমাশ খাটে দিনে রাতে যখনই দরকার। বড়বাবুকে বাইকে চাপিয়ে রেঞ্জে বা রেঞ্জের বাইরে যে কোনও কাজের জায়গায় নিয়ে যাওয়া, অবশ্য দৌড় সেই পুরুলিয়া পর্যন্তই। মনে মনে বড়বাবুর গুষ্টি উদ্ধার করে বেন্দা সামনে ছড়ানো জিনিসগুলো গুছিয়ে মদনার সঙ্গে রেঞ্জ অফিসমুখো হল।

নাটা মদনও জানে, বেন্দার মাথা বিগড়েছে। আপন মনে বকবক করে, কখনও হাসে, কখনও চুপ করে থাকে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাবও দেয় না। যেন বোবায় ধরেছে। তার উপর যদি কেউ বলে যে সে পুরুলিয়া অফিসে শুনে এসেছে বেন্দার বদলি হচ্ছে মানবাজার বা কেন্দায়, তা হলে তো কথাই নেই। তার পিছু পিছু ঘণ্টাভর ঘুরবে আর হাত কচলাবে ওর সেই কাল্পনিক বদলিটা রুখে দেওয়ার জন্য। পরে যদি জানতে পারে যে ওকে নিয়ে মজা করা হচ্ছিল, তা হলে বেন্দার এক অন্য রূপ। গালাগালের বন্যা ছুটিয়ে দেয়! অবসর নেওয়ার পরে বদলির আর যে ভয় নেই, বেন্দা বুঝতে পেরেছে।

হঠাৎই যেন চনমনিয়ে ওঠে মদন। ‘‘তু টুকচেন আগে বাড় কেনে বেন্দা, হামি অখুনই আলি, আজ বুধোবার। হাটোবার, বুজলি কি ন।’’ বেন্দা হেসে ফেলে, কারণটা ও ভালই বুঝেছে। মদন তার শিকার পেয়ে গিয়েছে। সামনে গোটা চারেক আদিবাসী মহিলা জটলা করেছে। মদনা সে দিকে এগোয়। মেয়েগুলো সাপ্তাহিক দোকানবাজার করতে এসেছে অনেক দূর থেকে। দোকানিকে পুরো বিশ্বাস করতে বাধে, তাই খাকি উর্দির স্থানীয় গার্ডবাবুদের লোকাল গার্জেন হিসেবে বেশি ভরসা করে। বেন্দা জানে, মদন এখন মেয়েগুলোকে নিয়ে ওর সেটিং করা দোকানে যাবে। মেয়েগুলোর চাহিদা মতো চাল-ডাল-তেল-নুনের ফর্দ বানাবে নিজের অ্যাকাউন্টে, ওদের হাত থেকে টাকাগুলো নেবে দোকানদারকে চোখের ইশারা করে। মেয়েগুলোকে শুনিয়ে বলবে, ‘‘মালগুলান য্যানো অ্যাকনম্বরি হয়। আর হঁ, ওজোনটো ঠিকঠাক দিবি। দিক কইরলে মুশকিল আছে।’’ কার মুশকিল? সেটা অবশ্য পরিষ্কার হয় না। দোকানদারও ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে মাপে বিশ পার্সেন্ট মারতে শুরু করবে।

এই কাজ শুধু মদন করে না। এমন কয়েক জনের সঙ্গে দোকানিদের স্বার্থপূর্ণ সহাবস্থান বহু বছর ধরে চলে আসছে বান্দোয়ানে। বেন্দা যে সবটা বুঝতে পারে তা নয়। কেবল আশপাশের ঘটনাগুলো ওকে বুঝতে সাহায্য করে যে কাঁচা টাকা হাতে আসতেই এই ধরনের লোকগুলোর মধ্যে যত রকম সম্ভব চারিত্রিক বদগুণগুলো ফুটে ওঠে। তাই মাসের অর্ধেক যেতে না যেতেই বেতনের টাকা শেষ। বাজারে ধার শুরু।

বেন্দার নিজের চোখে দেখা, বেতনের দিনে পাওনাদারদের সঙ্গে ওদের চোর-পুলিশ খেলা। কিছু দিন আগেও ক্যাশে বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। রেঞ্জ অফিসার বেতনের টাকা নিয়ে স্টাফদের পেমেন্ট করবেন বলে হাঁ করে বসে আছে, অথচ কর্মচারীদের টাকা নেওয়ার কোনও তাগিদ নেই। বড়বাবু বেশি তাড়া দিলে বলছে, ‘‘টুকু ধিরজ রাখ্যেন ন স্যার, টাকাট্যো অখ্যনই লিলি! হাথ ব্যেথা করছেন আজ্ঞা, বেথাটোটুকু ক্যম হল্যেই লিব্য বটেক।’’

ব্যথা-বেদনা কিচ্ছু না। ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য রেঞ্জ অফিসের গেটের বাইরে পাওনাদার বাহুবলীদের ফাঁকি দেওয়া। যারা সকাল থেকে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে।

বেন্দার এ সব দেখে কষ্ট হত, কীভাবে ওরা মা লক্ষ্মীকে পাকিয়ে গোল করে জামার হাতার লুকনো ফাটলে, কলারের উল্টোদিকে, জুতো ও অন্তর্বাসের ভিতর বেতনের টাকা ভাগ ভাগ করে লুকিয়ে রাখছে। যাতে পাওনাদাররা প্যান্ট-জামার পকেট সার্চ করলেও কিছু টাকা ওদের খপ্পর থেকে বাঁচানো যায়! যদিও শেষ পর্যন্ত কোনও ফিকিরই কাজে আসে না। এইসব করতে করতে বান্দোয়ান বাজারের সব দোকানদারই ধারে মাল দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ফূর্তির নেশা বড় বালাই। বাগ বস্ত্রালয় থেকে ধারে দু’শো টাকার কাপড় কিনে একটু দূরের নাগ বস্ত্রালয়ে একশো আশি বা একশো পঞ্চাশ টাকায় বেচে দেওয়া যাতে নগদ টাকা হাতে নিয়ে কিছুটা ফূর্তি চলে। অল্পদিন পরে সে চালাকিও বন্ধ। শেষমেষ এই ফর্দ কেনার ধান্দা চালু হয়। যেটায় দু’পক্ষেরই কম বেশি লাভ থাকে।

পাঁচসাত ভাবতে ভাবতে কখন বেন্দা রেঞ্জ অফিসে পৌঁছে গিয়েছে বুঝতে পারেনি। চমক ভাঙে বড়বাবুর হুঙ্কারে, ‘‘কী রে ব্যাটা কুমারের পো, কথা যে কানেই যায় না। বলি, কোন ভাবের জগতে আছিস?’’ থতমত খেয়ে বেন্দা মিনমিন করে বলে, ‘‘কিছু না। আজ্ঞা বলেন কুথাক্যে যেতে হব্যে?’’ বড়বাবু ব্যাজার মুখে বলেন, ‘‘আমার মাথাক্যে যেতে হব্যে, হতভাগা! নবাবপুত্তরের এত ক্ষণে ঘুম ভাঙল, আবার দেয়ালা করা হচ্ছিল মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে। বলি, কীসের খোয়াব দেখা হচ্ছিল? এদিকে আমি মরছি নিজের জ্বালায়। ডিএফও অফিস থেকে খবর এসেছে, এখনই পুরুলিয়া হাসপাতাল আর মর্গে ছুটতে হবে। স্বপনবাবুর পোস্টমর্টেম বগ্যেরা করানোর জন্য।’’

নামটা শুনে চমকে ওঠে বেন্দা!

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Kanailal Ghosh Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy