নগরকীর্তন: চওক এলাকা। মধ্যযুগের সুলতানি আমল থেকে এই শহরের নাম ফৈজ়াবাদ। আপাতত, যোগী আদিত্যনাথের নির্দেশে এর নামও অযোধ্যা!
পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুর এসে পড়েছে পুরনো দুর্গের শরীরে। নবাবি অওধ-এর প্রথম রাজধানী এই ফৈজ়াবাদ শহরের ‘ফোর্ট ক্যালকাটা’। অবহেলিত সেই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের সামনেই ফটফটি স্ট্যান্ড। বেঞ্চি-পাতা, ছোট্ট চা-সামোসার দোকান রফিক মিঞার। ময়লা পাজামা-পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা, এই নাম কেন? চাচা এখানকার অঘোষিত টুরিস্ট গাইড। জি কে খুব স্ট্রং। বললেন, কলকাতা তখন ব্রিটিশ বণিকদের রাজধানী। হেরে গেলেও সুলতানের কাছে রাজ্য ছিল। কলকাতার নামে কিল্লা গড়ে নিজের গৌরব বাড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। জানি না এটাই কারণ কি না!
ঘর্ঘরা নদীর দুই শাখায় ঘেরা ক্যান্টনমেন্ট নগরী এই ফৈজ়াবাদের নতুন নাম দিয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ। ফৈজ়াবাদ এখন অযোধ্যা। কিন্তু ১৭৬৪-তে বক্সারের যুদ্ধে হেরে গিয়ে নবাব সুজাউদদৌলা কলকাতা দুর্গ গড়িয়েছিলেন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে।
চাচা যেন এলাকার মোড়ল। মোবাইল ফোনে ডেকে পাঠালেন আসাদ আহমেদকে। স্থানীয় সমাজবাদী যুবনেতা। ধুলো উড়িয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে এলেন। বললেন, জানেন, ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম, তখন এলাকায় কোনও টেনশন ছিল না। বাবরি মসজিদের মধ্যেই ছিল মূর্তি। নিয়মিত রামলালার পুজোও হত। ঠাকুরদার সময় থেকেই পুজোর কথা শুনেছি। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ তো দেখিনি। ’৮২-৮৩ থেকে শুরু হল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। এটুকু বলে উঠেই আচমকা আসাদ বললেন, মোটর সাইকেলে বসে পড়ুন। আপনাকে একটা দারুণ জিনিস দেখাব।
সেনা ছাউনি এলাকার ভিতর চলে এলাম হুস করে। মাথায় হেলমেট নেই। চাচাকে পয়সাটা পর্যন্ত দেওয়া হল না। পৌঁছলাম ডোগরা রেজিমেন্টের তৈরি এক অসাধারণ রামসীতা মন্দিরে। ১৯৬৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এটি তৈরি হয়। ডান দিকে গায়ত্রী মাতা, রাধাকৃষ্ণ, বাঁ দিকে দুর্গা আর লক্ষ্মীনারায়ণ। অষ্টধাতুর শিব। মহিষাসুরমর্দিনীও আছেন। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ঘর্ঘরা নদীর গুপ্তার ঘাটে। ঘাটেও আছে ৩০০ বছরের পুরনো রামসীতা মন্দির। পাশেই গড়ে উঠেছে বিরাট মল।
উপেক্ষিত এই ফৈজ়াবাদ। সুজাউদদৌলার মকবরা। গোলাপবাড়ি। সেখানেই শায়িত তিনি। চক এলাকায় আছে অসাধারণ তিনটি প্রাচীন মসজিদ। ফৈজ়াবাদ থেকে অযোধ্যার বিতর্কিত রামজন্মভূমি এলাকা মাত্র সাত কিলোমিটার। অযোধ্যায় রামমন্দিরের কাছে টেঢ়ী বাজারেই ছিল আসাদদের বাড়ি। ২০০৫-এর জুলাইয়ে এক ভূতুড়ে জিপ নিয়ে লস্কর-ই-তইবার সন্ত্রাসবাদীরা বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি প্রাঙ্গণের ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকে আক্রমণ চালায়। প্রাচীরের কাছেই রামজন্মভূমি পুলিশ স্টেশন। এলাকায় প্রচুর মুসলমান পরিবারের বাস আজও। রামজন্মভূমির নামে এক অস্থায়ী মন্দির হয়েছিল সেখানে। তা ধ্বংস করাই ছিল জঙ্গিদের লক্ষ্য।
আসাদ জমিদারবাড়ির ছেলে। বাবা নিয়মিত হজ যাত্রা করতেন। ঠাকুরদার নাম হাজি ফেকু। মক্কা-মদিনা গিয়েছেন অনেক বার। টেঢ়ী বাজার মসজিদের মৌলবি ছিলেন ঠাকুরদা। সে বার জঙ্গিদের সেই সন্ত্রাস প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সব জঙ্গিই মারা গিয়েছিল। ভাঙাচোরা জিপটা আজও থানার জমিতে ভূতের মতো পড়ে আছে। কিন্তু ২০০৫-এর জুলাইয়ের পর আসাদরা দুই ভাই মিলে ওখান থেকে পালিয়ে ফৈজ়াবাদে চলে আসেন।
এই সেই অযোধ্যা। ভোটের আগমনি রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। বিতর্কের অবসান হয়নি। বহু প্রশ্ন অমীমাংসিত। শুধু স্থানীয় আখড়ার সাধুরাই নন, বহিরাগত রাজনেতাদের প্রতিযোগিতামূলক রামলালা দর্শন শুরু হয়ে গেছে। মুম্বই থেকে সপরিবারে এলেন উদ্ধব ঠাকরে। ঘন ঘন আসছেন যোগী আদিত্যনাথ। কিন্তু এই এলাকার স্থানীয় মানুষের সঙ্গে একান্তে কথা বললে বোঝা যায়, তাঁরা উদ্বিগ্ন। অসন্তুষ্ট। বিরক্ত। ফলাহারী বাবা নামক হনুমানগঢ়ীর এক সাধুকে এলাকার সব ধর্মের মানুষ মান্য করেন। আখড়ায় গিয়ে দেখলাম, হিন্দিতে লেখা স্কন্দপুরাণ পড়ছেন বাবাজি। বললেন, মন্দির হোক, মন্দির হলে দেশবিদেশের মানুষ আসবে। পর্যটনকেন্দ্র হবে অযোধ্যা। ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে। অশান্তি চাই না। তাতে লাভ কার? কিন্তু কত দিন হল, মন্দির তো আজও হল না।
আসলে অযোধ্যা মানেই হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, তা নয়। বৌদ্ধ, জৈন, এবং সুফি মুসলমানদের কাছেও এ পবিত্র শহর। বৌদ্ধরা বলেন, এই এলাকাকে তাঁরা অতীতে বলতেন, সাকেত। হর্ষবর্ধনের আমলে হিউয়েন সাং এ দেশে এসেছিলেন, তিনিও অযোধ্যায় গিয়েছিলেন। কারণ, বৌদ্ধ যোগাচার ঘরানার দুই দার্শনিক অসঙ্গ ও বসুবন্ধু একদা এই অযোধ্যার বৌদ্ধ বিহারে থাকতেন। তবে হিউয়েন সাঙের আমলে এই জনপদ ছিল জঙ্গল। ডাকাতদের আস্তানা।
ক্ষুদ্র হলেও, আজও বৌদ্ধ জনসমাজ আছে অযোধ্যায়। সুনীত মৌর্য প্রতিদিন ফৈজ়াবাদ থেকে অযোধ্যায় শিক্ষকতা করতে যান এক স্কুলে। ১৯৭২-এর ১ সেপ্টেম্বর অযোধ্যায় জন্ম তাঁর। মা শাকসব্জি চাষ করেন, বাবা উত্তরপ্রদেশে সরকারি কর্মচারী। সুনীত বললেন, আমরা বৌদ্ধ। কিন্তু বাবা ছোটবেলায় রামায়ণ পড়ে শোনাতেন। শিবপুরাণ বৌদ্ধরাও খুব পড়েন, জানেন? বললাম, শিবপুরাণ কেন? স্কুলশিক্ষক বললেন, ‘‘বেনারসে যক্ষপুজো হত। সেই যক্ষরাই পরে হয়ে গেল শিবভক্ত। বৌদ্ধ সাহিত্যেও যক্ষপুজো আছে। ১৯৮৩ সালে, তখন আমি ক্লাস সেভেনে, প্রথম শুনলাম হিন্দু-মুসলমান ঝগড়া। অযোধ্যায় আজও বৌদ্ধ দর্শন সোসাইটি আছে। আমরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে প্রচার করছি, মন্দির হোক, কিন্তু স্লোগান দেবেন না।’’ শুধু বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান অথবা সুফিরা এ কথা বলছেন তা নয়। স্থানীয় ব্রাহ্মণ যুগলকিশোরও মনে করেন, এই রাজনৈতিক তোলপাড়ে লাভ নেই। মন্দির হোক, কিন্তু তার আগে এখানে দরকার চাকরি।
আর হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক? অযোধ্যা বরাবর ছোট্ট এলাকা। সুলতানি আমল থেকে এটি ফৈজ়াবাদের অন্তর্গত। ‘ফৈজ়’ মানে ভাল। যেখানে মনোরম জলহাওয়া, তারই নাম ফৈজ়াবাদ। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে মনে হল, আজকের ভারতের অজ্ঞানতা, ধর্মীয় অশিক্ষার অন্ধকার বুঝতে হলে অযোধ্যাই আসল এলাকা। বাবরি-কাণ্ডের পর অনেকের ধারণা দাঁড়িয়েছে, হিন্দু আর মুসলমান বরাবরই যুযুধান দুই সম্প্রদায়। এই ধারণার কোনও ইতিহাসগত ভিত্তি নেই। মুঘল আমলের শেষ দিকে অওধ প্রায় স্বাধীন রাজ্য হিসেবে দৌড় শুরু করে। তার নবাবরা ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের। মুঘলরা ছিলেন সুন্নি। মাদ্রাসা, মক্তব চালানোর জন্য কিছু সুন্নি পরিবারের কর তাঁরা মকুব করেছিলেন। শিয়া নবাবরা সেই বন্দোবস্ত তুলে দেন। কিন্তু সেটা শিয়া-সুন্নি লড়াইয়ের কারণে নয়। রাজকোষের তহবিল বাড়ানোর লক্ষ্যে। লখনউয়ের এক সুন্নি শিক্ষাকেন্দ্রে কখনওই হাত দেননি শিয়া নবাবরা। কারণ সেখানে নবাবি আমলের আমলা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় হিসাবপত্র, দর্শন ও বিজ্ঞান শেখানো হত। আজকের ভারতে সেই ঐতিহ্য অবলুপ্ত।
২০০১-র সেন্সাস রিপোর্ট অনুসারে অযোধ্যার স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন ৭৫,০০০ মাত্র। এখন কত বাড়বে? এ তো নতুন ঘটনা কিছু নয়, ১৯৪৯ সালে ২২-২৩ ডিসেম্বর হিন্দুরা মন্দিরে রামলালার মূর্তি স্থাপন করেন। তার পর চোরাগোপ্তা ধোঁয়া ছিল, বিস্ফোরণ হয়নি। মসজিদে যে সব মুসলমানেরা প্রার্থনা করতে আসতেন, স্বাভাবিক ভাবেই জুতো খুলে সেখানে ঢুকতেন তাঁরা। এই ভারত জানে না, তাঁদের জুতো আগলাতেন স্থানীয় হিন্দুরাই।
ফৈজ়াবাদের টাউন হল পুরসভা অসাধারণ সুলতানি স্থাপত্য। নাম বদলালেই কি সেই ইতিহাস মুছে যাবে? ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব দফতর ও ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ়-এর অতীত সন্ধানের গবেষণা আজও চলছে। সুপ্রিম কোর্টেও বিষয়টি বিচারাধীন। গবেষণার মাধ্যমে আজও সত্যের সন্ধান হয়নি। অথচ এই নিরিবিলি, নানান ধর্মের মানুষের জনপদ রাজনৈতিক বহিরাগতদের তাণ্ডবনৃত্যের মঞ্চ হয়ে উঠছে। অযোধ্যার ভূমিপুত্ররা শান্তি চাইছেন। কর্মসংস্থান চাইছেন। কোনও এক ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। এই ধ্বংসে অযোধ্যাবাসী কী পেলেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy