Advertisement
১৩ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

উত্তাল সময়সন্ধির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর

ক বি মণিভূষণ ভট্টাচার্য গত শতকের সত্তরের বছরগুলিতে এ দেশের এক উত্তাল সময়সন্ধির এবং বাগ্‌রুদ্ধ মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তীব্র যন্ত্রণা ও শাণিত ব্যঙ্গ— এই ছিল তাঁর প্রতিবাদের দুটি মুখ।

কবি মণিভূষণ, আলোচনা ও নিজস্ব সংলাপ। সম্পা. আলো ভট্টাচার্য। পরি. দে’জ, ৫০০.০০

কবি মণিভূষণ, আলোচনা ও নিজস্ব সংলাপ। সম্পা. আলো ভট্টাচার্য। পরি. দে’জ, ৫০০.০০

পবিত্র সরকার
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

ক বি মণিভূষণ ভট্টাচার্য গত শতকের সত্তরের বছরগুলিতে এ দেশের এক উত্তাল সময়সন্ধির এবং বাগ্‌রুদ্ধ মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তীব্র যন্ত্রণা ও শাণিত ব্যঙ্গ— এই ছিল তাঁর প্রতিবাদের দুটি মুখ। তাঁর কবিতা ওই সময়কার উচ্চারণভীরু সাধারণ মানুষকে যেমন আশা ও সাহস জুগিয়েছে তেমনই তরুণ দুঃসাহসীদের পথে আলো দেখিয়েছে। আমরা আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি যে, এই কবি, যিনি প্রত্যক্ষ ভাবে কোনও সংঘবদ্ধ রাজনীতির সঙ্গে কোনও দিন যুক্ত হননি, এবং যাঁর প্রথম দিককার কবিতায় ব্যক্তিগত বৃত্তকে অতিক্রমণের উৎসাহ খুব কম দেখিয়েছেন, তিনি কী ভাবে দেশ ও সমাজের এই বৃহৎ ক্ষেত্রে এমন নির্ভীক প্রত্যয়ে এসে দাঁড়ালেন এবং কী ভাবে তাঁর কবিস্বরূপের এমন আক্ষরিক অর্থে ‘বৈপ্লবিক’ জন্মান্তর ঘটল। মণিভূষণের নিজের ভাষায় “একদল মহাপ্রাণ যুবকের সমাজ বদলের অঙ্গীকারকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কণ্ঠরোধ করেছিলো। একজন প্রকৃত নাগরিক হিসাবে সেই জল্লাদ সময়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাবার জন্য গান্ধীনগরে রাত্রি কবিতার জন্ম।” তবে ‘গান্ধীনগরে রাত্রি’তে মণিভূষণ তাঁর নিজের প্রতিনিধি হয়ে উঠলেও ১৯৭১-এর ‘উৎকণ্ঠ শর্বরী’ থেকেই তাঁর অভিমুখের পরিবর্তন কিছুটা লক্ষ করা যায়। তাঁর প্রতিবাদ আরও বিশিষ্টতা পায় এইখানে যে, কোনও বিখ্যাত বা জনপ্রিয় পত্রিকাকে তিনি এই প্রতিবাদের বাহন করেননি, কিছুটা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অজস্র পরিচিত-অপরিচিত ক্ষুদ্র পত্রিকায়, প্রায় আন্ডারগ্রাউন্ড বা ভূতলবর্তী আন্দোলনের মতো তিনি তাঁর কবিতাকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, এবং সেখান থেকেই তাঁর পাঠক ও অনুরাগীরা তাঁকে সাগ্রহে সংগ্রহ করে তাঁকে নিজেদের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু মণিভূষণ যখন চলে গেলেন তখন তাঁর যাওয়ার কথা ছিল না, তিনি তাঁরই ‘রাজহাঁস’-এর এই সব পদবন্ধের মতো ‘উদয়াচলের কথা’ বলে, ‘আংশিক ঋণ শোধ করে’ চলে গিয়েছিলেন।

মণিভূষণ তাঁর জীবিতকালে যথেষ্ট সমাদর পাননি (তাঁর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘সরকারি বেসরকারি ব্যক্তিগত কোনোরকম সাহায্যের প্রস্তাব কখনো আসেনি’) এবং এখন যথেষ্ট পরিমাণে পঠিত হন না (‘সাম্প্রতিক ঔদাসীন্য বিস্ময়কর’), এই রকম একটি অভিমান থেকে কবিপত্নী আলো ভট্টাচার্য এই গ্রন্থটির সংকলনে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর ভূমিকায় এই অভিমানের কথা আছে, থাকাই স্বাভাবিক। অন্য অনেকের ক্ষেত্রেও দেখেছি, সময়ের চিহ্নকে বেশি করে ধারণ করতে যাঁরা অগ্রসর হন সেই নির্বাচিত সময় তাঁদের বহন করে নিয়ে চলে যায়, বিবর্তিত সময় অন্যদের ভাসিয়ে সামনে নিয়ে আসে। এর প্রতিবিধান সব সময় কবির নিজের হাতে থাকে না। এক, কবি যদি নিজে ‘চিরকেলে’ কিছু সূত্র ধরে রাখেন তাঁর কবিতায়, তা হলে তার কাছে বার বার আমাদের পৌঁছাতে হবে—মণিভূষণের কবিতায় সে রকম সূত্র কম নেই। শুধু ‘রাজহাঁস’ সিরিজের প্রেমের চমৎকার সনেটপ্রতিম কবিতাগুলিই নয়, তাঁর ‘পদ্ধতি’র মতো বহু কবিতাও তো শঙ্খ ঘোষের কথায় ‘যে কোনো দেশের যে কোনো সময়ের কবিতা।’ আর দ্বিতীয়ত, যদি ওই যে কোনও সময়ের উপর আমরা ভরসা না-ই করি, তাঁর নিজের ওই সময়টাই বৃত্তাকারে বা শঙ্খাবর্তের মতো ফিরে ফিরে আসে, একটু-আধটু ভোলবদল করে, তখন তাঁর বিদ্রুপ, প্রতিবাদ আর জ্বালার কবিতা নতুন করে আমাদের কণ্ঠে আমরা তুলে নিতে পারি। ভারতে আর এই রাজ্যে সেই সময় হয়তো বার বার ফিরে আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়। সেই লগ্নে যাতে মণিভূষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কবি আমাদের হাতের নাগালে থাকেন, সেই লক্ষ্যে আলো ভট্টাচার্যের এই প্রয়াস মহত্ত্বপূর্ণ বলা যায়, বৃহত্তর বাঙালি সমাজের যে কাজ করার ছিল, সে কাজ তিনি করে আমাদের কৃতজ্ঞ আর দায়ভাগী করলেন।

বইটি দুটি পর্বে বিভক্ত, প্রথম পর্বে মণিভূষণ সম্বন্ধে আলোচনা আর স্মৃতিচারণ, আর দ্বিতীয় পর্বে (সম্পাদকের শিরোনাম ‘নিজস্ব সংলাপ’) মণিভূষণের রচনা-সংকলন। রচনাগুলির সংরূপমাত্রা লক্ষ করলে বাঙালি পাঠক রীতিমতো বিস্মিত হবেন, কারণ অধিকাংশের কাছে কেবল কবি হিসেবে পরিচিত মণিভূষণ আরও যে কত কী লিখেছেন, নিজেকে কত ভাবে বিস্তার করেছিলেন তা তাঁদের বেশিরভাগের কাছে অজ্ঞাত ছিল বলেই মনে হয়। মণীন্দ্র গুপ্ত যেমন বলেছেন ‘একমাত্র ‘গান্ধীনগরের রাত্রি’ বইতে তাঁকে আটকানো উচিত নয়।’ এ বইয়ের সাক্ষ্যে হয়তো বলা যাবে, শুধু কবিতাতেও তাঁকে আটকানো উচিত নয়। গদ্য তো তিনি লিখেইছেন— আছে চট্টগ্রামের পাহাড়-সমুদ্রের শৈশব-স্মৃতি, আছে সমরেশ বসু সম্বন্ধে একটি চমৎকার মূল্যবিচার, নজরুল বিষয়ে রচনা— যাতে আছে ‘কবিতা দু ধরনের। ঘুম পাড়াবার কবিতা, ঘুম তাড়াবার কবিতা।’ আছে বিষ্ণু দে, মধুসূদন, সুকুমার রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্বন্ধে চমৎকার আলোচনা— যা তাঁকে তীক্ষ্ণধী সাহিত্যবোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরে, লিখেছেন ছোটদের জন্য গদ্য, ছোটদের জন্য লিমেরিক, (বড়দের জন্য) ছোটগল্প, একটি অসমাপ্ত নাটক, একটি মহাকাব্যের ভূমিকা হিসেবে ‘ভগীরথ’ কবিতা, আর অনুবাদও করেছেন ব্রেশ্‌ট, আর্নস্ট টলার প্রভৃতির কবিতা, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন একাধিক, যার মধ্যে তাঁর নিজের কথাগুলি অকপটে বলেছেন। চিঠিপত্রগুলিও তাঁর ভিতরকার মানুষটিকে আরও কাছে নিয়ে আসে। সেই সঙ্গে ‘কবির জীবন’, ‘কালপঞ্জী’, ‘গ্রন্থপঞ্জী’, সংকলনের লেখক পরিচিতি এবং পারিবারিক ও অন্যান্য আলোকচিত্র, পাণ্ডুলিপির ছবি, সম্পাদনার সামগ্রিক অভিমুখটিকে স্পষ্ট করে। ফলে মণিভূষণকে যাঁরা সমগ্র ভাবে জানতে চান তাঁদের জন্যও এই গ্রন্থনা এক উত্তম উপহার।

আলোচনাগুলির মধ্যে শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাগুলি মণিভূষণের ঐতিহাসিক অবস্থান এবং কবিত্বের চরিত্র সম্বন্ধে যেমন আমাদের সমৃদ্ধ করে তেমনই আলোচনায় সুজিৎ ঘোষ, নমিতা চৌধুরী, সব্যসাচী দেব, সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়, মৃদুল দাশগুপ্ত, দেবারতি মিত্র, মিহির চক্রবর্তী কিছুটা ব্যাপক ও বিচিত্র পরিসর তৈরি করেন মণিভূষণকে নিয়ে। আলো ভট্টাচার্য আর সায়ন ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণ স্বাভাবিক কারণেই অন্তরঙ্গ এবং মর্মগ্রাহী।

সম্পাদনার যত্ন থাকলেও, যোগেন চৌধুরীর সুদৃশ্য প্রচ্ছদে শোভিত (৮১৫ + ৩২ পৃষ্ঠার) বইটিতে কিছু ছাপার ভুল থেকে গেছে। আরও আশা করি যে, মণিভূষণের একটি রচনাসমগ্র প্রকাশে কোনও অগ্রণী প্রকাশক উদ্যোগী হবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

protest bokk review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE