বই ভর্তি ঘরে নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন তিনি। সেকেলে আসবাব আর একচালা দুর্গা প্রতিমার দীপ্তি থেকে চোখ সরিয়ে দেখা গেল তাঁকে। লেখার ঘরে তাঁর আস্ত পৃথিবী।
খাটবোঝাই বই। অমিতাভ ঘোষের ‘ফ্লাড অফ ফায়ার’, সুনীলের ‘সেই সময়’, হামিদ কুরেশি, মতি নন্দীর ‘বিজলিবালার মুক্তি’… পড়ছেন ইসমত চুঘতাই, কিন্তু লিখছেন ‘শালুক’য়ের মতো গ্রামের মেয়েকে নিয়ে। এই প্রথম কোনও মিডিয়াতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন একসঙ্গে ছ’টি সিরিয়ালের লেখক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। সারা বাংলার মানুষের পালস্ বুঝতে পারেন কী ভাবে? ‘‘সম্পর্ক, জীবন, প্রেম আর বিরহ দেখতেই মানুষ বেশি পছন্দ করে,” বলেই লম্বা কাগজে দ্রুত কলম চালাতে লাগলেন।
লেখার টেবিলের পাশেই গত রাতের কেনা একশো বই-য়ের সারি। বাংলার মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি তাঁর কল্পনা দিয়ে, একের পর এক বিখ্যাত চরিত্র সৃষ্টি করে। মধ্যরাত অবধি প্রোগ্রামারদের সঙ্গে মিটিং করে সকাল সকাল লিখতে বসেছেন, তাঁর নতুন ধারাবাহিকের স্ক্রিপ্ট। পাশাপাশি চলেছে চ্যানেলের জন্য নতুন ছবির কাজ। নতুন ছবির হিরোইন নির্বাচন করতে করতেই সাদা কাগজে লিখে ফেলছেন ‘এই ছেলেটা ভেলভেলেটা’র সংলাপ। এই ধারাবাহিকের উল্টো দিকের স্লটেই ‘পটলকুমার গানওয়ালা’। টেনশন হয় না?
‘‘হেলদি কমপিটিশন সব সময়ই ভালো। মাঠে নেমে যদি প্রতিপক্ষ জোরালো না পাই, তা হলে খেলার মজা আসে না। সাহানার (‘পটলকুমার’য়ের চিত্রনাট্যকার) কাজকে খুব শ্রদ্ধা করি। ওর ভাল কিছু হলে আমি খুশি হই,’’ একরাশ উড়ুক্কু চুল সরিয়ে বললেন বিদ্যা বালনের প্রথম বাংলা ছবি ‘ভাল থেকো’র চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায়।
জানা গেল ‘চোখের তারা তুই’, ‘পুণ্যিপুকুর’, ‘ইচ্ছেনদী’ —এই তিন ধারাবাহিকই টিআরপি-র রেটিংয়ে অন্য চ্যানেলে প্রচারিত একই সময়ের ধারাবাহিকগুলোর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
• সাবুদির স্বামী হয়ে সিরিয়ালে ফিরলেন সৌমিত্রদা
কী করে সম্ভব একটানা এত লেখা? ‘‘লেখাটা অভ্যেসের মতো। আর গল্পের চরিত্রগুলো মাথায় ঘুরতে থাকে। সিরিয়ালের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এতটাই ভাল কাজ করে যে তারাই আমার অনুপ্রেরণা। ওদের অভিনয়-ক্ষমতা দেখলে মনে হয় দারুণ সব চরিত্র তৈরি করি। আর সৌমিত্রদা, সাবিত্রীদি, মাধবীদি—ওঁরা তো সব লিজেন্ড।’’ লীনা বললেন, ‘‘‘জলনূপুর’ সিরিয়ালে দশ দিনের কাজ নিয়ে সৌমিত্রদাকে রাজি করিয়েছিলেন সাবুদি (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়)। আমরা বলেছিলাম সাবুদি তোমার বরকে ফিরতেই হবে সিরিয়ালে। আর সেই বর যদি কাউকে হতেই হয় তো সে সৌমিত্রদা,’’ বলতে বলতে লেখা থামালেন লীনা। এসি ফ্লোর ছাড়া শীতের পোশাক পরে ৮২ বছর বয়সে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে ভাবে একের পর এক শট দিয়েছেন, এমনকী অপছন্দ হলে নিজের থেকেই রিটেক করেছেন, তা দেখে বিস্মিত লীনা।
সিনিয়রদের সঙ্গে কাজ করে জীবনটাকে সহজ করে নিতে শিখেছেন তিনি। ‘সোনার হরিণ’ সিরিয়ালে টিআরপি পড়ে যাওয়ায় হঠাৎই একদিন অনুরোধ এসেছিল ওই সিরিয়ালের চিত্রনাট্য লেখার। কোনও দিনই ভাবেননি তাঁর লেখা ‘সোনার হরিণ’য়ের টিআরপি বাড়িয়ে দেবে। সেখান থেকেই শুরু। আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
• পীযূষ বলেছিল, ‘‘আমি ছুটি চাই’’
সৃষ্টির নেশায় মৃত্যু কেমন করে যেন জুড়ে আছে লীনার অন্তঃস্থলে। পীযূষের মৃত্যু আজও তিনি মেনে নিতে পারেননি। আর পারবেনই বা কী করে? চলে যাওয়ার আগে ফ্লোরে পীযূষের শেষ সংলাপ ছিল, ‘আমি ছুটি চাই।’ পীযূষের মুখে মৃত্যুর আগে এই সংলাপ কী করে বসিয়েছিলেন তিনি? ছটফটিয়ে উঠলেন লীনা। চোখের কোণে এক ফোঁটা জল... কখনও তাঁর চরিত্ররাই তাঁকে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ফেলেছে। ‘ইষ্টিকুটুমে’ বাহা আর অর্চিকে আলাদা করে দেওয়ায় খুনের হুমকিও পেয়েছিলেন তিনি! সম্পর্ক নিয়ে অজস্র লিখলেও কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনও ছুৎমার্গ নেই তাঁর। বললেন,‘‘আজকের সময় দাঁড়িয়ে কেউ যদি ভাবে কোনও মহিলা বা পুরুষ সারাজীবন একই মানুষের প্রেম নিয়ে থেকে যাবে, সেটা অবাস্তব।’’
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের কথা আজও তাঁর কানে বাজে—‘‘জীবনে সব পেলাম। ভালবাসা, খ্যাতি। কিন্তু আমার সংসার হল না। অনেক ছেলেমেয়ে নিয়ে ভরপুর সংসার করতে চেয়েছিলাম।’’ সংসার, যৌথ পরিবার, মা-মাসিদের হেঁসেলের গল্প বারে বারে তাঁর লেখায় ফিরেছে।
• শিক্ষিত ছেলেমেয়ে আসুক ইন্ডাস্ট্রিতে
নতুন প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে যদিও কিছুটা হতাশ লীনা। কারণ আজও কারও কিছু করার না থাকলে, কাজ না পেলে লোকে এসে বলে, ‘‘কিছু তো করার নেই। তাই ভাবছি সিরিয়াল করব।’’ নতুন প্রজন্মের এক ঝাঁক অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে কাজ করছেন তিনি। বললেন, ‘‘বিক্রম, দেবোত্তম, কৌশিক, জয় এবং অবশ্যই ঋষি কৌশিকের কথা বলতে চাই। নিজেদের তৈরি করার চেষ্টা আছে এঁদের। তবে দেখছি নতুন মেয়েদের অধিকাংশেরই অভিনয়ে মন নেই। ঈপ্সিতার
(‘কেয়াপাতার নৌকা’ ‘চোখের তারা তুই’) অনেক ভাল করা উচিত ছিল। নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগই মাচা আর নিজের প্রচার নিয়ে মেতে আছে।’’ তিনি চান আরও শিক্ষিত ছেলেমেয়ে এই ইন্ডাস্ট্রিতে আসুক।
স্বাদ বদলের কথা কি ভাবছেন লীনা? ‘পটলকুমার’, ‘গোয়েন্দা গিন্নি’, ‘মহানায়ক’...প্রশ্নটা তুলতেই থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘মানুষ আজও প্রেমের গল্প দেখতে ভালবাসে। সেই কারণে ‘দাদাগিরি’র মতো জনপ্রিয় টিভি শোয়ের উল্টো দিকের স্লটে ‘পুণ্যিপুকুর’য়ের টিআরপি বেশি। তবে ‘মহানায়ক’ নতুন প্রজন্মকে ওই সময়টা চিনতে শেখাবে। সেটা ভাল।’’ আজ অবধি তাঁর গল্পের টিআরপি মুখ থুবড়ে পড়েনি। কিন্তু তিনি জানেন, কালই তা হতে পারে। হিন্দি সিরিয়াল আর বাংলা ছবির প্ল্যানিংটাও শুরু করে দিয়েছেন তিনি এবং তাঁর পার্টনার শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়—যাঁর সাহায্য ছাড়া তিনি এতটা পথ পেরোতে পারতেন না।
একটা সময় ছিল বাসভাড়া না থাকায় কলকাতার রাস্তায় হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন। যৌথ পরিবারে বউয়ের পড়াশোনা নিয়ে নানা বাধা পেরোতে হয়েছে তাঁকে। কিছু মানুষের উৎসাহ না পেলে রান্নাঘরের সজনেতলায় বাসন মেজে জীবন কেটে যেত তাঁর।
• আমার দর্শক হোয়াটসঅ্যাপ করে না
হোয়াটসঅ্যাপে ঘন ঘন মেসেজ আসছে। ‘‘দিদি মেঘলার শাড়ির রংটা ঠিক আছে তো? আর কলমকারি ব্লাউজটা চলবে তো?’’ শুধু গল্প লেখাই নয়, চরিত্র সাজানোর দায়িত্বও চ্যানেলের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন লীনা। এক সময়ে তো কলকাতার ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে গিয়েছিল বাহা শাড়ি। নিজে ফেসবুকে কাজ সারলেও তাঁর গল্পের চরিত্ররা কেন হোয়াটসঅ্যাপ করে না? ‘‘আমার দর্শক মাঠ থেকে চাষ করে ফিরে টিভির সামনে বসে। তাঁদের জীবনে হোয়াটসঅ্যাপ নেই। আমার সৌভাগ্য শহরের দর্শকও আমার সিরিয়াল দেখে। সেটা আমার বাড়তি পাওনা।’’
নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন দীর্ঘকাল। সাক্ষাৎকার দিতে চান না। সন্ধে নামলেই তাঁর অফিসে সিরিয়াল পাড়ার অভিনেতা- অভিনেত্রীদের ঢল—কাজের জন্য, আড্ডার জন্য, পরামর্শের জন্য। শুধু গ্ল্যামার নয়, মাঝরাতে হঠাৎ আলাপ হওয়া পথচলতি মানুষও তাঁর পরম বন্ধু হয়ে থেকে গিয়েছেন। মাঝরাতে সব কাজ ফেলে তাঁর সঙ্গে দেখাও করে আসেন। জীবনটা আগের মতো থেকে গেছে। যেমন থেকে গিয়েছেন ওপার বাংলা থেকে দু’মুঠো অন্নের খোঁজে আসা ফিরোজা। এঁরাই তাঁর চিত্রনাট্যের চরিত্র। পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার। কিন্তু ফিরে যেতে চান শিয়ালদহের রেলওয়ে কোয়ার্টার্সের দিনগুলোতে। এক অধ্যাপিকা সাদা কাগজের ওপর লিখে চলেছেন জীবনের জলছবি। গল্প। উপন্যাস। সৃষ্টির সেই মায়া আজও তাঁকে ঘিরে আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy