তৈরি যুবভারতী। আর কিছুদিন পরেই এখানে বসবে বিশ্ব কাপের আসর। —নিজস্ব চিত্র।
ভিতরে ঢুকলেই চোখ দুটো ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। মনটাও। ঠিক দেখছি তো!
মাঠ, ড্রেসিংরুম, অনুশীলনের জায়গা, গ্যালারি— সর্বত্রই একটা আন্তর্জাতিক মানের ছাপ। এ কি আমাদের সেই চেনা যুবভারতী?
এতিহাদ, ন্যু ক্যাম্প, সান্তিয়াগো বের্নাবাও, ওল্ড ট্রাফোর্ড— সকলকে টেক্কা দিতে তো যুবভারতী প্রায় রেডি!
এত দিন যুবভারতী ছিল শুধুই আবেগের তারে বাঁধা। যুব বিশ্বকাপ তাতে পেশাদারিত্বের মীড় খেলিয়ে দিয়েছে যেন। গোটা মাঠ জুড়ে তাই বাজছে, ফুটবলের এক আন্তর্জাতিক সুর। যা বুঝিয়ে দিচ্ছে, হ্যাঁ, কলকাতাও পারে। কলকাতাও পেরেছে। পেরেছে যুবভারতী।
গত নভেম্বরে কেমন ছিল যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন?
জানতে পড়ুন
বিশ্বকাপের জন্য কতটা তৈরি যুবভারতী?
দেশের সেরা তো বটেই, এশিয়ার বৃহত্তম স্টেডিয়ামগুলির একটি এই যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। এই স্টেডিয়ামই বছরের পর বছর দেখেছে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আবেগের সেই লড়াইয়ে কখনও রক্তাক্ত হয়েছে মাঠ। কখনও বা গ্যালারি। সেই স্টেডিয়ামেই এ বার বিশ্বকাপের ছোঁয়া। হোক না অনূর্ধ্ব-১৭, তা-ও বিশ্বকাপ তো! বিশ্বের সেরা দেশগুলো খেলবে ভারতের ছ’টি ভেন্যুতে। যুবভারতী তার একটি। বিশ্বকাপের ফাইনালও উপহার পেয়েছে ভারতীয় ফুটবলের মক্কা কলকাতা।
ভিডিওয় দেখে নিন
১৯৮৪ থেকে ২০১৭। ফুটবলের নানা ওঠাপড়া দেখেছে এই স্টেডিয়াম। গত এক বছরে এক বারও ফুটবল গড়ায়নি সেই মাঠে। কার্যত ধ্বংসস্তূপের চেহারা নেওয়া প্রায় সাড়ে ৭৬ একরের বিশাল চত্বরের কাজ অনেকটাই হয়ে এসেছে। শেষবেলার কাজ চলছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। চওড়া হয়েছে রাস্তা। কংক্রিটের গ্যালারিতে বসেছে চেয়ার। পড়েছে রঙের প্রলেপ। চেয়ার বসানোর কাজ এখনও চলছে জো়রকদমে। সঙ্গে স্কোরবোর্ড। হুড়োহুড়ি যাতে না হয়, সে জন্য মেন গেট তো বটেই বাকি গুলোতেও বসছে চ্যানেল। নকল ঘাসের বদলে যুবভারতীর সবুজ এখন সত্যিকারের।
আরও পড়ুন
ত্রিদেশীয় সিরিজে নেই সুনীল, উদান্ত
সব মিলিয়ে সাজ সাজ রব যুবভারতী চত্বর জুড়ে। যদিও এ সব করতে গিয়ে কাটতে হয়েছে অনেক গাছ। বাইপাস থেকে ভিআইপি গেট দিয়ে ভিতরে যাওয়ার রাস্তাও বদলেছে অনেকটা। যুবভারতীকে বিশ্বমানের করে তুলতে কী কী করতে হল? দেখে নেওয়া যাক।
বাইপাসের উপরেই ছিল ভিআইপি গেট। সেই গেট বেশ কিছুটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাইপাসের উপর তৈরি করা হয়েছে একটি নতুন গেট। দুই গেটের মাঝে রয়েছে চওড়া রাস্তা। দুটো গেট পেরিয়ে ঢুকতে হবে মূল স্টেডিয়াম চত্বরে। সেখান থেকে মূল গ্যালারিতে পৌঁছনোর গেট পর্যন্ত ঢোকা এবং বাইরে যাওয়ার রাস্তাকে একাধিক ফুটবল মুডের স্ট্যাচু দিয়ে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
আমেরিকা থেকে আনা বার্মুডা ঘাসের মাঠ অনেকটাই তৈরি। প্রথমে আমেরিকা থেকে এই ঘাস এনে বেঙ্গালুরুতে রাখা হয় বেশ কয়েক দিন। ঘাস পুরো তৈরি হয়ে গেলে গাড়িতে সেই ঘাস নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। এই ঘাসের পুরো নাম রিভিয়েরা বার্মুডা গ্রাস। এই মুহূর্তে কলকাতাতেও ঘাস তৈরি হয়ে গিয়েছে খেলার জন্য। এই ঘাসের বিশেষত্ব, এটা সাধারণ ঘাসের তুলনায় অনেক বেশি সতেজ থাকে। পাশাপাশি খেলার গতিও বৃদ্ধি পায়। এই ঘাসের পিছনে খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এই একই ঘাস দিয়ে তৈরি হয়েছে স্টেডিয়ামের ভিতরের চারটি অনুশীলনের মাঠ।
অনুশীলনের মাঠ
স্টেডিয়ামের ভিআইপি গেটের ঠিক উল্টো দিকে ফিফার স্টেটাসের কথা মাথায় রেখে তৈরি হচ্ছে দুটো অনুশীলন মাঠ। এখানে থাকবে ড্রেসিংরুম— প্লেয়ার ও রেফারিদের জন্য। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী ম্যাচ স্টেডিয়ামের কাছেই হতে হবে ট্রেনিং গ্রাউন্ড। চারটি প্র্যাক়টিস গ্রাউন্ডের কথা ছিল। কিন্তু স্টেডিয়ামের ভিতরে জায়গা না থাকায় সাই-এর দুটো মাঠ এ জন্য ব্যবহার করা হবে।
ড্রেসিংরুম
অতীতে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে দু’দিক মিলিয়ে মোট চারটি ড্রেসিংরুম ছিল। এ বার সেই চারটি ড্রেসিংরুম করা হয়েছে এক দিকেই। ‘স্টেট অব দি আর্ট’ ড্রেসিংরুমে ফিফার নিয়ম মেনে রাখা হয়েছে লকার, বসার জায়গা ও মাসাজ টেবল। সঙ্গে প্রতি ড্রেসিংরুমে কম করে আটটি শৌচাগার থাকাটা বাধ্যতামূলক। এর সঙ্গেই থাকছে ম্যাচ অফিশিয়াল, বল বয়দের জন্য আলাদা ঘর।
গ্যালারি
২০১১-র আগে এই স্টেডিয়ামে ১ লাখ ২০ হাজার দর্শকের বসার জায়গা ছিল। এর পর সেটা কমিয়ে করা হয় ৮৫ হাজার। এই স্টেডিয়ামে ১৯৯৭ সালের একটি ডার্বি ম্যাচে সবচেয়ে বেশি দর্শক হয়েছিল, প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার। বিশ্বকাপের জন্য চেয়ার বসানোয় সেই জায়গা আরও কমেছে। এখন মোট ৮৫ হাজার বসার আসন রয়েছে।
স্পেশ্যালিটি বক্স
চারটি কাচের বক্স থাকছে গ্যালারিতে। তার মধ্যে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল, একটি ভিভিআইপি, একটি ভিআইপি এবং একটি প্রেস বক্স। প্রতি বক্সের উচ্চতা ৬৩ ফুট। বক্লের সামনে এমন কাচ থাকবে, যাতে কোনও ভাবেই মাঠ দেখতে অসুবিধে না হয়। বক্স ঘিরে থাকবে উচ্চমানের নিরাপত্তা এবং পাঁচতারা সুবিধা। এই বক্স তৈরির কাজ এখনও চলছে।
টানেল
ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে মাঠে ঢোকার টানেলেও বদল আনা হয়েছে। এত দিন এই টানেলের উচ্চতা ছিল সাড়ে ছ’ফুট। কিন্তু বিদেশি ফুটবলারদের উচ্চতার কথা মাথায় রেখে তা বাড়িয়ে সাত ফুট করা হয়েছে। এ নিয়ে ফিফার কোনও গাইড লাইন না থাকায় নিজেদের মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
• ১৯৮৪তে এই স্টেডিয়ামের উদ্বোধন হয়েছিল জওহরলাল নেহরু ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড কাপ দিয়ে।
• এই টুর্নামেন্ট এর পরে আবার হয়েছিল ১৯৯৫তে।
• প্রি-ওয়ার্ল্ড কাপ হয়েছে ১৯৮৫তে।
• সুপার সকার হয়েছে ১৯৮৬, ১৯৮৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৪-এ।
• ১৯৮৭তে হয়েছে তৃতীয় সাফ গেমস।
• ইউএসএসআর ফেস্টিভাল ১৯৮৮তে হয়েছে।
• ১৯৯২এ হয়েছে চার্মিনার চ্যালেঞ্জ ট্রফি।
• জার্মান তারকা ফুটবলার অলিভার কানের বিদায়ী ম্যাচ হয়েছিল ২০০৮-এ।
• ২০১১-য় আর্জেন্তিনা বনাম ভেনেজুয়েলার মধ্যে ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ।
• এ ছাড়া ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের বেশির ভাগ লড়াইয়ের সাক্ষীই এই স্টেডিয়াম।
অনেক স্মৃতি বুকে নিয়ে আরও এক নতুনের সামনে দাঁড়িয়ে যুবভারতী। এ বার বিশ্বকাপ। কলকাতা যদিও ভারতের গ্রুপ পর্বের ম্যাচ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু এখানে খেলবে ইরাক, চিলে, ইংল্যান্ড ও মেক্সিকোর মতো দল। এর পর কলকাতা দেখবে রাউন্ড অব ১৬ ও কোয়ার্টার ফাইনালের একটি করে ম্যাচ। তৃতীয় স্থান ও ফাইনাল ম্যাচও হবে কলকাতায়।
যুবভারতীর ফ্লাডলাইট বসে গিয়েছে আগেই।
চোখ, মন ধাঁধানো যুবভারতী এখন শুধু তাই বল গড়ানোর অপেক্ষায়।
—নিজস্ব চিত্র ও ভিডিও
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy