Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Wimbledon 2023 Final

অতিমানবের নতুন উচ্চতা? না মহাকায়বধ? আনন্দবাজার অনলাইনে উইম্বলডন থেকে লিখলেন অতিথি লেখক

মনে হচ্ছিল একবিংশ শতাব্দী নয়, ফিরে গিয়েছি দু’হাজার বছর আগেকার পুরনো রোমে। বসে আছি কলোসিয়ামের গ্যালারিতে আর আমার দু’চোখ দেখছে এক চিরন্তন লড়াই।

picture of Novak Djokovic and Carlos Alcaraz

রবিবার কোন কাব্য রচিত হতে চলেছে উইম্বলডনের সবুজ প্রাঙ্গণে? এক অতিমানবের নতুন উচ্চতা ছোঁয়ার ‘দাস্তান’? নাকি মহাকায়বধ পর্ব? (বাঁ দিকে) নোভাক জোকোভিচ এবং (ডান দিকে) কার্লোস আলকারাজ। ছবি: সংগৃহীত।

উজ্জ্বল সিন্‌হা
উজ্জ্বল সিন্‌হা
লন্ডন শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৩ ১২:৩৬
Share: Save:

সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। সেদিন মানে গত শুক্রবার। সারাদিন ধরে বৃষ্টি ঝরল একটানা, নিরবিচ্ছিন্ন। কখনও গুঁড়িগুঁড়ি, কখনও টিপটিপ আবার কখনও বা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মনখারাপ করা স্লেটরঙা আকাশ থেকে নেমে এসে স্যাঁতসেঁতে করে দিচ্ছিল সব কিছু।

লন্ডন শহরের পূর্ব প্রান্তের শোরডিচ থেকে অনেকটা রাস্তা যেতে হবে। তাই একটু আগেভাগেই রওনা দিয়েছিলাম। এমনিতে ঘণ্টাখানেকের পথ। কিন্তু বৃষ্টিজনিত কারণে লেগে গেল আরও ত্রিশ মিনিট। আসলে একটু বৃষ্টি পড়লেই এখনও এই শহরে ট্র্যাফিক এগোয় শামুকের গতিতে। বেশ মিল কলকাতার সঙ্গে। মানতেই হবে! গাড়ির জানলার সদ্যস্নাত কাচের লেন্সে স্লো-মোশনে ধরা থাকছিল বিরল পেন্টিংয়ের মতো জলছবি সব।

উইম্বলডনের কাছে পৌঁছে দেখলাম ফ্লুরোসেন্ট কমলা রঙের উর্দি গায়ে নানা বয়সের, নানা দেশের মানুষ নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমাদের গাড়িগুলোকে একটু তাড়াতাড়ি এগিয়ে দিতে। যাতে বিশ্বের সুন্দরতম খেলার প্রদর্শনীতে পৌঁছে যাই আমরা, সময়মতো। গাড়িতে আসতে আসতে ভাবছিলাম, জানি লন্ডনে এটাই দস্তুর। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল, জানিয়েছিল আবহাওয়া অ্যাপ। বৃষ্টি পড়বে সারাদিন ধরে। কিন্তু তবুও, এমন কালে মন বিষণ্ণ হয় না কোন পাষণ্ডের?

ছাতা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম খেলা দেখার উত্তেজনায়। তাই বিধুর মন আর সিক্ত শরীরে প্রবেশ করেছিলাম অল ইংল্যান্ড লন টেনিস ক্লাবের চত্বরে। ১১ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে সেন্টার কোর্ট অবধি অনেকটা জায়গা। দেখলাম বৃষ্টি একটুও টসকাতে পারেনি খেলা দেখতে আসা মানুষদের উৎসাহকে। সুভেনিরের দোকানগুলোয় বিকিকিনি চলছে পুরোদমে। বিভিন্ন খাবারের স্টলের সামনে সর্পিল লাইন। ঈষৎ হলুদ রঙের ক্রিমসঞ্জাত খুনখারাবি-গাঢ় গোলাপি রঙের স্ট্রবেরি কিনতে হামলে পড়ছে প্রথম বিশ্বের সুবেশ-সুবেশারা। আমার তালিকায় এটা বাকি রয়ে গিয়েছে বৎসরকাল! এবার আর ভুলব না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। একবার অন্তত খেয়ে দেখতেই হবে, কী মধু আছে এই গোলাপি মায়ায়।

কাঁটায় কাঁটায় দেড়টার সময় খেলা শুরু হল। একদিকে তিনি। নোভাক জোকোভিচ। এবারের টুর্নামেন্টে এটিপি র‌্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় বাছাই। উল্টো দিকে জ্যানিক সিনার। গত ১০ এপ্রিলে ঘোষিত এটিপি র‌্যাঙ্কিংয়ে ৮ নম্বর শীর্ষবাছাই সিনার মন্টে কার্লোর বাসিন্দা। এখনও ২২টি বসন্ত পার হয়নি জীবনে। ২০২০ সালে, ১৯ বছর বয়সে সোফিয়া ওপেন জিতে তিনি সর্বকনিষ্ঠ প্লেয়ার হিসাবে এটিপি খেতাবের অধিকারী হন। সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসাবে পাঁচটি খেতাব জিতেছেন তিনি। এক বিরল কৃতিত্ব, যা ২০০৮ সাল থেকে অধরা ছিল টেনিস জগতের কাছে। কার কাছে ছিল সেই খেতাব ২০০৮ সাল থেকে, যা তিনি চূর্ণ করেছেন? তাঁর নাম নোভাক জোকোভিচ! সেই মেঘলা দিনে, বৃষ্টি আটকাতে সেন্টার কোর্টের ওপর যান্ত্রিক উপায়ে টাঙিয়ে ফেলা দুধ-সাদা শামিয়ানার নীচে, ২০০৮ মুখোমুখি ২০২৩-এর!

শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হয় তিল তিল করে, নিরলস প্রয়াসের মাধ্যমে। শুক্রবার উইম্বলডনের প্রথম সেমিফাইনালে জোকোভিচ।

শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হয় তিল তিল করে, নিরলস প্রয়াসের মাধ্যমে। শুক্রবার উইম্বলডনের প্রথম সেমিফাইনালে জোকোভিচ। ছবি: রয়টার্স।

গ্যালারিতে বসে বার বার বিভ্রম হচ্ছিল। স্থান, কাল পাত্র গুলিয়ে যাচ্ছিল কেবল। মনে হচ্ছিল একবিংশ শতাব্দী নয়, ফিরে গিয়েছি দু’হাজার বছর আগেকার পুরনো রোমে। বসে আছি কলোসিয়ামের গ্যালারিতে আর আমার দু’চোখ দেখছে এক চিরন্তন লড়াই। অভিজ্ঞতা বনাম তারুণ্য। প্রত্যয় বনাম দ্বিধা। অতিমানবিক শ্রেষ্ঠত্ব বনাম নেহাতই মানবিক সামান্য ভুলত্রুটি!

পৌনে তিন ঘণ্টার লড়াইয়ে স্ট্রেট সেটে হেরেছেন জ্যানিক, এটাই লেখা থাকবে টেনিসের ইতিহাসে। আমি মনে রেখে দেবো একটি তত্ত্ব। একটি জীবনদর্শন। যা আমাদের শেখায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হয় তিল তিল করে, প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত নিজেকে সংযত রেখে, ক্ষণিকের সামান্য সব বিচ্যুতির ফাঁদ থেকে নিজেকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর, নিরলস প্রয়াসের মাধ্যমে। যেমনটা করেছেন নোভাক জোকোভিচ। জ্যানিক ভাল খেলোয়াড়। নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি এখানে ফিরে আসবেন বার বার। আরও নতুন নতুন পালক লাগুক তাঁর শিরস্ত্রাণে, তা-ই চাইব আমরা সকলে। কিন্তু তার আগে চাইব তিনি হৃদয়ঙ্গম করবেন শ্রেষ্ঠ হওয়ার সাধনা সহজ নয়। সে পথ কুসুমাকীর্ণ নয়, বড় কঠিন সে যাত্রা।

এবারের টুর্নামেন্টে আমি শুরু থেকেই ড্যানিল মেদভেদেভে আচ্ছন্ন ছিলাম নানা কারণে। ২০২২-এ তিনি দ্বিতীয় বাছাই থেকে তিন সপ্তাহ এটিপি র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষবাছাই ছিলেন নোভাককে পিছনে ফেলে। বর্তমানে গত জুন মাস থেকে তৃতীয় বাছাই এই টেনিসযোদ্ধা। গত বছরে উইম্বলডনে খেলা নিষেধ ছিল রাশিয়ান খেলোয়াড়দের জন্য। তাই এ বছর তাঁকে নিয়ে চাপা ঔৎসুক্য ছিল খানিক। এই প্রথম এই টুর্নামেন্টে তিনি সেমি ফাইনালে উঠেছেন। কোয়ার্টার ফাইনালে ইউব্যাঙ্কসের সঙ্গে খেলাটায় শুরুতে চাপে থেকেও শেষে গিয়ে জিতলেন অবিশ্বাস্য দক্ষতায়। আমার মনে হয়েছিল, দিনের দ্বিতীয় খেলাটা নিশ্চয় হাড্ডাহাড্ডি হবে। আমরা একটা টান টান অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকব। সঙ্গীদের নিয়ে দুটো খেলার মাঝের বিরতিতে ক্রিম দিয়ে স্কোনস, নানাবিধ স্যান্ডুইচ আর ম্যাকারুন দিয়ে (সঙ্গে সেই হালকা হলদেটে ক্রিমের সঙ্গে গোলাপি ফল! খুব একটা সুবিধার কিছু নয়। দারুণ ভাল বিপণনের উদাহরণ হিসেবে মনে রাখব) পুরোদস্তুর বিলিতি খাওয়া সেরে কফিতে চুমুক দিয়ে লাউঞ্জের টিভি’র দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল! সেন্টার কোর্টে তখন নির্মম সংহার শুরু হয়েছে।

সিটে ফিরে এসে ভাল করে লক্ষ্য করলাম তাঁকে। মুখে অল্প বয়স হওয়ার সুবাদে এখনও ব্রণ বার হওয়ার দাগ সুস্পষ্ট। গালের দুপাশে গজানো দাড়ি নরম, কোমল। রোম বলা যায় অনায়াসে। ঠোঁট দুটো সব সময় একটু একে অপরের থেকে আলাদা। মনে হচ্ছে শুধু নাক নয়, মুখ দিয়েও শ্বাস নিতে থাকতে হবে তাঁকে। রক্তে ভরে নিতে হবে আরও আরও অক্সিজেন। যাতে অনায়াসে, প্রায় প্রতিবার, ১৩০ মাইল বা তারও বেশি বেগে সার্ভিস করার ইন্ধন কম না পড়ে যায়। মাত্র ২০ বছর বয়স তাঁর। কিন্তু চোখে চোখ পড়লে সম্ভ্রম হয়। লহমায় বোঝা যায় তিনি আসলে অন্য ধাতুতে নির্মিত। টেনিসদেবতা তাঁর জন্য অনেক স্বপ্ন দেখে রেখেছেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

দু’ঘণ্টার কম সময়ে মেদভেদেভকে হেলায় হারালেন তিনি। শুধু শক্তিশালী সার্ভিস নয়, শুধু ক্ষিপ্র ফোরহ্যান্ড রিটার্ন নয়, তাঁর ড্রপশট আর নিখুঁত প্লেসমেন্ট তৃতীয় বাছাই মেদভেদেভকে নিতান্তই সাধারণ করে তুলল অনায়াসে। তৃতীয় সেট শেষ হওয়ার অনেক আগেই দেখলাম গ্যালারি একটু একটু করে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। খেলাটা তখন এতই জোলো আর একপেশে লাগতে শুরু করেছে। আমাদের পিছনের সিট থেকে উঠে চলে গেলেন আমির খান। সঙ্গে পুত্র-কন্যাকে নিয়ে।

টেনিস সাম্রাজ্যের নতুন ‘কনকুইস্তাদোর’! সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষকে সংহারের পর।

টেনিস সাম্রাজ্যের নতুন ‘কনকুইস্তাদোর’! সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষকে সংহারের পর। ছবি: রয়টার্স।

রবিবার লন্ডনে রোদ উঠেছে চমৎকার! তেরছা হয়ে নেমে-আসা মিঠে, চকচকে আলো পিছলে যাচ্ছে গ্যালারির সবুজ রঙের সিটগুলোর ওপর। গাড়িতে না এসে টিউবে এসেছি। একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়ার জন্য। এখনও গ্যালারি বেশ ফাঁকা, সবে গুণিজনেরা আসতে শুরু করেছেন। আমি বসে বসে ভাবছি, সেদিন খেলা শেষে কী বলেছিলেন বছর কুড়ির সেই বালক? “আমি জানি উনি গত এক দশককে এখানে হারেননি। উনি কিংবদন্তি, এ বিষয়ে আমরা সবাই অবগত। তবে এ সময় ভীত হওয়ার সময় নয়। এখন ক্লান্ত হলে চলবে না।”

উনি যা বলেননি, তা ওঁর শরীরের ভাষা বলছিল সুস্পষ্ট ভাবে। উনি খেলতে চান। জিততে চান। মনে রাখবেন, ২০০৬ সালের পর ইনিই সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় এখানকার ফাইনাল ম্যাচে। ওঁর আগে কে ছিলেন সেই সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় ২০০৬ সালে? রাফায়েল নাদাল।

কার্লোস আলকারাজ, এটিপি র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষবাছাই বিস্ময়। রাফায়েল নাদালের সঠিক উত্তরাধিকারী, টেনিস সাম্রাজ্যের নতুন ‘কনকুইস্তাদোর’। তাঁর উল্টো দিকে কাকে দেখবো আমরা? তাঁর নাম নোভাক জোকোভিচ। যিনি বলেছেন, রবিবারের ফাইনালের জন্য তাঁর বয়স ১০ বছর কমে এখন ২৬! উনি ২০১৩ সালে ফেরত যেতে চান। যখন শুরু হয়েছিল তাঁর অপ্রতিরোধ্য দশকব্যাপী বিজয় অভিযান।

রবিবার কোন কাব্য রচিত হতে চলেছে এই সবুজ প্রাঙ্গণে? বীরগাথা? এক অতিমানবের নতুন উচ্চতা ছোঁয়ার ‘দাস্তান’? নাকি মহাকায়বধ পর্ব? যা আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দেবে, আসলে সবাই নশ্বর। এমনকি অতিমানবরাও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE