ব্রোঞ্জ জেতার পরে সাক্ষী। ছবি: পিটিআই।
দেশি ঘিয়ের পরোটার জন্য মনটা ছটফট করছে তাঁর।
দেশের মুখ উজ্জ্বল করার পরে মায়ের কাছে টেলিফোনে এই বায়নাই করেছেন রিও অলিম্পিক্সে ফ্রি-স্টাইল মহিলা কুস্তিতে ব্রোঞ্জ পদকের মালকিন! মা সুদেশ মালিক জানাচ্ছেন, ‘‘সেই ছোট থেকেই কারি-পকোড়া আর দেশি ঘিয়ের পরোটা পেলে আর কিছু চায় না মেয়েটা। তবে একসঙ্গে অনেকটা খায় না। খেলার ক্ষতি হবে বলে মিষ্টি তো ছোঁয়ই না।’’
রোহতকের ৪ নম্বর সেক্টরের ৪৫ নম্বর বাড়িটি আজ ভোররাত থেকে ওবি ভ্যান, ফ্ল্যাশ বাল্ব, বড়-ছোট রাজনৈতিক নেতা, আম-জনতা আর তাসা-ব্যান্ড পার্টির দখলে চলে গিয়েছে পুরোপুরি। আর এই প্রবল ধাক্কাধাক্কির মধ্যে বাতাসে উড়ছে হরিয়ানার লাড্ডু! গত কাল গোটা রাত জেগেছেন বাবা, মা ও দাদা। আর আজ সারাদিন বিরামহীন ইন্টারভিউ দেওয়ার ফাঁকফোকরে একটু জল খাওয়ারও ফুসরত পাননি। বাবা সুখবীর মালিকের কথায়, ‘‘ও যাওয়ার আগেই বলে গিয়েছিল, তোমরা চিন্তা কোরো না। পদক জিতেই ফিরব। মেয়ের হাবভাব দেখে বুঝতে পারছিলাম, আত্মবিশ্বাস টানটান।’’ আর মা জানাচ্ছেন, ‘‘আজ তো ও গোটা দেশবাসীকে আনন্দ দিচ্ছে। কিন্তু ও যে আমাদের পরিবারেও সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে সেটা ওর জন্মের দিনই বুঝতে পেরেছিলাম। সকাল ন’টায় দিনের আলো দেখেছিল ও। আর সে দিন দুপুরেই আমি সরকারি চাকরির চিঠি পাই।’’ হরিয়ানা সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরে সুপারভাইজারের পদে চাকরি করেন সাক্ষীর মা। আর বাবা দিল্লির সরকারি বাসের কন্ডাক্টর।
বাবা-মা সাধারণ চাকুরে হলেও দোতলা বাড়িটি কিন্তু চোখ ধাঁধানো। প্রতিবেশী দীপক খক্কর জানাচ্ছেন, মালিক পরিবার আদতে রোহতক থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সমৃদ্ধ গ্রাম মোখড়ার বাসিন্দা। প্রচুর জমিজমা। ফলে সাক্ষীর খেলাধুলোর কেরিয়ার গড়তে তেমন সমস্যা হয়নি। মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিকাল এডুকেশনে স্নাতকোত্তর পড়ছেন সাক্ষী। দাদা শচীন এক বহুজাতিক ফাস্ট ফুড চেনের ফ্র্যাঞ্চাইজি চালান। চেহারা দেখেই বোঝা যায় কুস্তি ও শরীরচর্চায় তিনি ছোট বোনের অন্যতম অনুপ্রেরণা। বললেন, ‘‘দশ-বারো বছর বয়স থেকেই ও কুস্তি-পাগল। আসলে রোহতক, ভিওয়ানি, হিসারায় মহিলা-কুস্তির দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য রয়েছে।’’
ব্রোঞ্জ জেতার পরে কোচ কুলদীপ সিংহের কাঁধে সাক্ষী। ছবি: পিটিআই।
মহিলাদের কুস্তি? শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যি এটাই। এবং সেটাই হরিয়ানার সাবেক ইতিহাস। কিন্তু পরবর্তী কালে মেয়েদের কুস্তি করা-খেলাধুলো-চলাফেরা নিয়ে খাপ পঞ্চায়েত প্রতি পদে ভুরু কুঁচকেছে। একটা সময় যে মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে সাক্ষীকেও। অলিম্পিক পদক কিন্তু তাই দিন বদলের স্বপ্নও দেখাচ্ছে। ইদানীং যে হরিয়ানা কন্যাভ্রূণ হত্যা, খাপ পঞ্চায়েত আর অনার কিলিং-এর জন্য বারবার লজ্জা কুড়িয়েছে, সেখানেই নারীশক্তির বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে চলেছেন সাক্ষী। সেটা এ দিন তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সকাল থেকেই পঞ্চায়েতের নেতারা ভিড় করে এসে মিঠাই দিয়ে যাচ্ছেন। কংগ্রেস সাংসদ দীপেন্দ্র হুডা তো বাক্যহারা। বারবার বলছেন, ‘‘বলে বোঝাতে পারব না কী আনন্দ হচ্ছে। কাল রাত থেকে যেন পিকনিক চলছে!’’ রাজ্য সরকার আড়াই কোটি টাকা পুরস্কার এবং চাকরির ঘোষণা করেছে সাক্ষীর জন্য।
মিষ্টিমুখ। সাক্ষীর মা-দাদা-বাবা। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।
এই প্রবল ধাক্কাধাক্কির মধ্যে এক কোণে বসে রয়েছেন সেই দু’জন মানুষ যাঁরা অষ্টপ্রহর সাক্ষীর পিছনে পড়ে না থাকলে আজকের দিনটি আসত কি না সন্দেহ। এঁদের দেখে ‘কোনি’র ক্ষিদ্দার কথা মনে পড়ে যেতে পারে অনেকের। এখানকার যে সরকারি ‘ছটুরাম’ স্টেডিয়াম আজকের ব্রোঞ্জজয়ীর আঁতুড়ঘর, এঁরা সেখানকার দুই মহিলা কোচ ঈশ্বর দাহিয়া ও মনদীপ। মনদীপের জন্য নাকি জান হাজির সাক্ষীর। জানা গেল, তিন বছর আগে পানিপথে বদলি হয়ে যান মনদীপ। তখন স্থানীয় নেতাদের কাছে ধর্না দেন সাক্ষী ও তাঁর সতীর্থরা। দাবি, এখান থেকে সরানো চলবে না মনদীপকে। ‘‘কোনও দিন পাঁচ মিনিটের জন্য দেরি করে আসতে দেখিনি সাক্ষীকে। কামাই তো দূরের কথা। সকালে তিন, সন্ধ্যায় আড়াই— দৈনিক সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার থেকে কম অনুশীলন করতে দেখিনি। অবিশ্বাস্য খাটতে পারে’’, জানাচ্ছেন মনদীপ। বাবা-মাও একমত। ‘‘আমরা বকাঝকা করে কোনও বিয়েবাড়িতে নিয়ে যেতে পারি না। তবে রাতে বাড়ি ফিরে এক পাতা ডায়েরি ও লিখবেই,’’ বললেন গর্বিতা মা।
জানার উপায় নেই ঠিক কী লিখেছেন সাক্ষী তাঁর ডায়েরির পাতায় রিও-র রূপকথা নিয়ে। ২৪ অগস্ট ফেরার কথা। প্রবল তাসা ও উল্লাসের মধ্যে এটা বোঝা যাচ্ছে, মেয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত উৎসব থামবে না রোহতকের এই পাড়ায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy