অপ্রতিরোধ্য: দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের পাল্টা শাসন ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালির। রবিবার সেঞ্চুরিয়নে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিন তাঁর ব্যাটিংয়েই জবাব দিচ্ছে ভারত। ছবি: রয়টার্স।
জাতীয় তারকা আগেই হয়ে গিয়েছেন। খেলাধুলোর জগৎ থেকে দেশের সেরা মুখ বলা হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ থেকে আরও বৃহত্তর আকাশে উড়তে শুরু করে দিলেন বিরাট কোহালি।
ক্রিকেট বিশ্বে জোরাল তর্ক চলছে, জেট গতিতে এগিয়ে চলা বিরাট তাঁর ‘আদর্শ’ সচিন তেন্ডুলকরের রেকর্ড ভাঙতে পারবেন কি না। সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু তেন্ডুলকর-পরবর্তী যুগে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক নায়কের মুকুট যে এখন তাঁরই মাথায়, সেটা রবিবাসরীয় সেঞ্চুরিয়ন পার্কে দেখে নেওয়া গেল।
হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করে তিনি ড্রেসিংরুমের দিকে ঘুরে সেনানায়কের মতো গর্বিত ভাবে ব্যাট তুললেন। আর ঠিক তখনই সুপারস্পোর্ট পার্কের জায়ান্ট স্ক্রিনে এক দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট ভক্তের টুইট ভেসে উঠল— ‘যাকেই সমর্থন করি না কেন, কোহালিকে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়’!
দু’বছর আগের উইম্বলডন সেন্টার কোর্ট মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেমিফাইনালে অ্যান্ডি মারে-কে হারাচ্ছেন এক কিংবদন্তি। খেলোয়াড়দের চেয়ারের ঠিক পিছনে বসে থাকা এক টেনিস ভক্তের দু’হাতে তুলে ধরা পোস্টার ধরা পড়ল টিভি ক্যামেরায়— ‘কোয়ায়েট প্লিজ। জিনিয়াস অ্যাট ওয়ার্ক’।
চোখ বন্ধ করে কল্পনা করা যাক। অ্যান্ডি মারে খেলছেন। কিন্তু নিজেদের ছেলের প্রতি সমর্থন ভুলে উইম্বলডন কি না তাঁর প্রতিপক্ষের মায়ায় আচ্ছন্ন। টেনিসে এ রকম চরিত্র এক জনই থাকতে পারেন— রজার ফেডেরার। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে যিনি ফেভারিট। অবিসংবাদী নায়ক। যাঁর খেলার সময় কোনও লাইন অব কন্ট্রোল কাজ করে না। সব দেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: হার্দিক ম্যাজিকে ম্যাচে ফিরল ভারত
টেনিসের বিশ্ব মানচিত্রে ভারত নেই। ক্রিকেটে আছে। ভারতীয় খেলাধুলোয় যিনি রজার ফেডেরার, সেই সচিন তেন্ডুলকরকে নিয়ে এ রকম চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি থাকত। অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ড— যেখানে যেতেন সচিন, হুড়মুড়িয়ে সেখানকার ক্রিকেট ভক্তরা মাঠে এসেছেন তাঁর খেলা দেখতে। কোহালিকে নিয়ে ঠিক সে রকমই একটা আবেগ সেঞ্চুরিয়নের সুপারস্পোর্ট পার্কে দেখা গেল। সুইমিং পুল থেকে বার্বিকিউ—সব জায়গাতেই এ দিন কোহালিয়ানার জয়জয়কার।
সচিন তেন্ডুলকরীয় সংকল্প এবং সাধনা ভারত অধিনায়কের ব্যাটিংয়ে দেখা গেল সচিনের পয়মন্ত মাঠে। কেপ টাউনের মতো অফস্টাম্পের বাইরে ব্যাট বাড়িয়ে দেননি। খেলেছেন কম, ছেড়েছেন বেশি। না হলে যখন তিনি ব্যাট করতে নামলেন, ফের ভারতীয় ব্যাটিংয়ের মাথার উপর কালো আকাশ তৈরি হয়েছে। কে এল রাহুল কট অ্যান্ড বোল্ড হওয়ার পরের বলেই ‘দেওয়াল’ ধসে পড়ল। অহেতুক ঝুঁকি নিতে গিয়ে রান আউট চেতেশ্বর পূজারা। মাঠের আম্পায়ার টিভি রিপ্লে চাইলেও সকলেই বুঝতে পারছিল, পূজারার পতন ঘটেই গিয়েছে।
সেঞ্চুরিয়নে ড্রেসিংরুম থেকে অন্তত পঁচিশটি সিঁড়ি বেয়ে ব্যাটসম্যানকে মাঠে নামতে হয়। সুনীল গাওস্কর রবিবার সকালেই বলছিলেন, ‘‘শূন্য রানে আউট হওয়া মানে ব্যাটসম্যানের পক্ষে বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। দৌড়ে দৌড়ে এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে নামো। আবার তক্ষুনি ফিরে এসো।’’ কে জানত, লিটল মাস্টার বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই পূজারার ক্ষেত্রে এই আশঙ্কাটাই সত্যি হবে।
দশম ওভারে ভারত ২৮-২, সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন তিনি। আশেপাশে ভারতের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে অনেক কোহালি-ভক্ত। কিন্তু তাঁরাই যে সব নয়। এর বাইরেও যে একটা দুনিয়া অপেক্ষা করছে তাঁকে রক্তাক্ত করার জন্য। সমালোচকদের দুনিয়া বসে আছে আক্রমণ করার জন্য। তার মধ্যে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশও যে রয়েছে, তিনি জানেন।
সেঞ্চুরিয়নের পরিবেশ কেপ টাউনের মতো প্রতিকূল নয় মোটেই। পিচ তুলনায় অনেক পাটা। যা দেখে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন তারকারা তুলোধনা করছেন পিচ প্রস্তুতকারককে। গ্রেম স্মিথ টুইট করেছেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে স্পিনার তিরিশ ওভার বল করছে, কখনও দেখিনি। উইকেট যে বানিয়েছে, তার কাছে প্রচুর জবাবদিহি চাওয়া উচিত’।
গত কয়েক দিন ধরেই খুব গরম চলছে এখানে। সেই কারণে পিচ আরও শুকনো হয়ে উঠছে। কে জানত, দু’বলের মধ্যে এ সবই ভোজভাজির মতো উবে গিয়ে চাপ তৈরি হয়ে যাবে! দশম ওভারেই দুই উইকেট পড়ে যাওয়ার পরে কোহালির শরীরটা যখন বাইশ গজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, মার্ক টোয়েইনের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে গেল— ‘শীতলতম দিন আমি দেখেছি সান ফ্রান্সিসকোর এক গ্রীষ্মে!’ কোহালিরও কি আজ বলার পালা— কেরিয়ারের শীতলতম দিন এসেছি সেঞ্চুরিয়নের এক গ্রীষ্মে! টিভি স্টুডিওতে বসে আছেন বিশারদেরা। দিল্লির প্রাক্তন সতীর্থ বীরেন্দ্র সহবাগও ছাড়ছেন না। টিভি চ্যানেলে বসে দাবি তুলছেন, ব্যর্থ হলে কোহালি নিজেকে বসিয়ে দিক পরের টেস্টে। তাপমাত্রা মাপক যন্ত্র যতই পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি দেখাক, ভিতরে তো বরফশীতল হয়ে যাওয়ার কথা যে, এখানে ব্যর্থ হওয়া মানেই বিরোধী কোরাস আরও বেড়ে যাবে।
এ দিনই একটা পরিসংখ্যান দেখাচ্ছিল টিভি-তে যে, চলতি বছরে টেস্টে স্টিভ স্মিথ করেছেন ১৩০৫ রান। কোহালি এই ইনিংসের আগে পর্যন্ত করেছেন ১০৫৯। এটা শুধু টেস্টের হিসেব। সীমিত ওভারের ক্রিকেট ধরলে স্মিথকে অনেক পিছিনে ফেলে দেবেন বিরাট। কিন্তু সে সব কে মনে রাখে? দেশের মাঠে ডাবল সেঞ্চুরি করে এসেছেন কি না, সে সব অতীত। বিদেশের কঠিন পরিবেশে রান করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাতে পাশ করতে হবে। না হলে সেঞ্চুরিয়নেও ব্যর্থ হওয়া মানে দল তো তলিয়ে যাবেই, তাঁকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হবে।
মাঠে মর্নি মর্কেল, কাগিসো রাবাডাদের এবং মাঠের বাইরে সহবাগদের বাউন্সার সামলে দিনের শেষে তিনি ৮৫ অপরাজিত। ভারত বিপর্যস্ত, কোহালি অনমনীয়। একা কুম্ভ হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার তিন পেসারকে সামলেছেন প্রত্যয় নিয়ে। তিন পেসারই ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিবেগে টানা বল করে গেলেন। একটা সময় দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফ্যাফ ডুপ্লেসি বডিলাইন নীতিও প্রয়োগ করলেন। কেন যে একা খলনায়ক হয়ে এখনও থেকে গিয়েছেন জগলাস জার্ডিন এবং তাঁর প্রিয় পেসার হ্যারল্ড লারউড!
তাতেও টলানো যায়নি কোহালির অধ্যাবসায়। সত্তরের ঘরে এক বার জোরাল এলবিডব্লিউয়ের আবেদন এবং রিভিউ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু ভারতের আশা বাঁচিয়ে রেখে তিনি আছেন। সঙ্গে হার্দিক পাণ্ড্য ১১ রানে অপরাজিত। কোহালি ক্লাসিকের পরেও ভারত ১৮৩-৫। দক্ষিণ আফ্রিকার ৩৩৫ অলআউটের চেয়ে এখনও ১৫২ রানে পিছিয়ে।
এর পরেও কোহালি নিজেও জানেন, টেবল মাউন্টেনেই বড়জোর উঠতে পেরেছেন। এখনও কার্যত এভারেস্ট অভিযান বাকি রয়েছে। সোমবার সকালে এসে আবার লড়াইয়ের পতাকা পুঁতে দিতে হবে সুপারস্পোর্ট পার্কে। তার পর ফের শুরু করতে হবে ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে এভারেস্ট অভিযান। দক্ষিণ আফ্রিকার রান তো টপকে যেতেই হবে, ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে গেলে বেশ কিছু রানের ‘লিড’-ও নিতে হবে। যাতে শেষ ইনিংসে খারাপ উইকেটে তাঁদের বেশি রান তাড়া করতে না হয়।
ভারতীয় দল বাসে করে বেরনোর সময় যে দৃশ্য দেখা গেল, তাতে আরও নিশ্চিত হওয়া গেল, কোহালি এখন আন্তর্জাতিক তারকা। টিম বাসের পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রচুর ভক্ত। তাঁদের মধ্যে ভারতের জাতীয় পতাকা যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমন দক্ষিণ আফ্রিকার পতাকাও রয়েছে। সকলে বাইরে দাঁড়িয়ে ডেকে চলেছেন, ‘কোহালি, কোহালি’। তিনি বেরিয়ে আসা মাত্র গর্জন উঠল। কোহালি অটোগ্রাফও দিয়ে গেলেন।
সেঞ্চুরিয়নের হৃদয় জিতেই নিয়েছেন। অভাবনীয় লড়াই জারি রেখে ম্যাচ জেতার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন কি না সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy