আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে হুইলচেয়ারগ্রস্ত বিল ওরিলি একটা বার্তা পাঠিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকরকে। ‘‘তুমি আমার নাতির বয়সি। তাই যথেষ্ট স্বাধীনতা নিয়ে বলছি, ওয়ান ডে ক্রিকেট খেলো না। তা হলে ব্র্যাডম্যান হতে পারবে না।’’ অবশ্যই নিষ্ফল হয়েছিল সেই বার্তা। একদিনের ক্রিকেটের তখন এমনই ডগমগ বাজার যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যতই নবাগত হন সচিন, সেই ঊর্ধ্বমূখী বাণিজ্য থেকে মুখ ফেরাবেন কেন?
জাম্পকাট দু’হাজার ষোলো মে।
আরও এক কিংবদন্তি স্পিনার আবেদন রাখছেন আধুনিক ক্রিকেটের সচিনের কাছে। ‘‘বিরাট কী হবে এই তামাশা ক্রিকেট খেলে? ভাই আরসিবির হয়ে কেন এত ঘামরক্ত ঝরাচ্ছ? তোমার এই সব সোনার পারফরম্যান্স দেশের হয়ে দাও।’’
বক্তা বিষেণ সিংহ বেদী। কোটলা মাঠে তাঁকে না দেখে বাড়িতে ফোনে ধরেছিলাম। তা বেদী বললেন, ‘‘মাঠে যাব? বলছেন কী? আইপিএল তো ক্রিকেটের বেশ্যাবৃত্তি। আইপিএল নিয়ে আমি কিছু বলি না। কিছু লিখি না।’’
এ বারের আইপিএলের ক’টা ম্যাচ টিভিতে দেখলেন জিজ্ঞেস করায় বলেন, ‘‘একটাও পুরো দেখিনি। টিভিতে সে দিন যদি নিউজটা দেখার মতো না হয়, তা হলে অনেক সময় ঘোরাই। বেশিক্ষণ দেখার প্রশ্ন নেই। ওটা ক্রিকেটই নয়।’’
কিন্তু দর্শকদের দাবি কি সবার আগে বিবেচনার মধ্যে রাখা উচিত নয়? একটা খেলা বেঁচে থাকবে কি না, থাকলে কোন ফর্মে থাকবে, তারাই তো ঠিক করবে। বেদী যখন ভারত অধিনায়ক, নিশ্চিত হার জেনেও ১৯৭৭-’৭৮ ইডেন টেস্টের শেষ দিন ৮০ হাজার দর্শক হয়েছিল। আজ সেই এক শহর টেস্ট দেখতে আসে না, কেকেআর দেখতে উপচে আসে। তাদের ভাল লাগালাগিকে গুরুত্ব দেবেন না বেদী?
‘‘না দেব না। আমার কাছে তামাশা দেখতে ভিড় হওয়া পাবলিক ইম্পর্ট্যান্ট নয়। আমার কাছে অনেক জরুরি হল তরুণ ক্রিকেটারদের ভাল-মন্দ,’’ বলেন বেদী। যিনি আজও দিল্লি শহরতলিতে বাচ্চাদের নিয়ে ক্যাম্প চালান।
আর সাড়ে তিন মাস বাদে সত্তরে পা দেবেন বেদী। এটা তাঁর প্রাক-সত্তর জ্বরাগ্রস্ত হয়ে পড়া নয় তো? বিশ্বব্যাপী সেরা পেশাদাররা তো দেশের পাশে, এমনকী আগে, ক্লাবকে রাখেন। মেসি যত না আর্জেন্তিনার, তার চেয়ে বেশি বার্সেলোনার। রোনাল্ডো যত না পর্তুগালের, তার চেয়ে বেশি রিয়ালের। বেদী নিজেও তো নর্দাম্পটনশায়ারের হয়ে ১৯৭২-’৭৭ চুটিয়ে কাউন্টি খেলেছেন। কোহালিকে আজ বারণ করছেন কেন?
‘‘করছি কারণ আমি মনে করি কাউন্টি খেলাটা আমার ভুল হয়েছিল। প্রতি মরসুমে এতগুলো থ্রি ডে ম্যাচ খেলে, বল করে আমি নিজেকে ফুরিয়ে ফেলি। কোন ভারতীয় বোলার তখন এক মরসুমে ৩০০ ওভার বল করত? আমি করেছি,’’ এত বছর বাদে আজ আত্মসংশোধন করতে চান বেদী।
‘‘আমার ভয় হচ্ছে বিরাটের এই যে এত ভাল ভাল পারফরম্যান্স, সব ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে নিজেকে উজাড় করে দিতে দিতেই নষ্ট হয়ে যাবে,’’ বলেন দেশের হয়ে ২৬৭ উইকেট নেওয়া বেদী।
সচিন না বিরাট, কে এগিয়ে, বিশ্ব ক্রিকেটের এই সবচেয়ে টিআরপি-ওয়ালা বিতর্কে অংশ নেওয়ার কোনও কারণই দেখছেন না বেদী। ‘‘কী সব সাব স্ট্যান্ডার্ড বোলিং এখন। তার পর টি-টোয়েন্টিতে যা যা নিয়ম, সব বোলার-বিরোধী। মারলেই চার বা ছয়। একজন ব্যাটসম্যানকে জাজ করবেন কী করে? আমি ভাই টেস্ট ম্যাচ বুঝি। ওখানে তোমার কী গড়, আমি দেখতে চাই। (সচিন: অ্যাভারেজ ৫৩.৭৮, কোহালি: ৪৪.০২)।’’
বিশুদ্ধবাদীরা ওয়ান ডে নিয়েও তো তেমনই আপত্তি তুলেছিলেন যা আজ টি-টোয়েন্টি নিয়ে বেদী তুলছেন। তাতে তো সে জিনিসটা মিলিয়ে যায়নি। বরঞ্চ বেড়েছে। বেদী এ বার রেগেই যাচ্ছেন, ‘‘ক’বছর বীর বিক্রমে চলল ওয়ান ডে ক্রিকেট? অলরেডি তো বুড়োটে দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। টেস্ট ক্রিকেট সেখানে বেঁচে আছে একশো ঊনচল্লিশ বছর ধরে।’’
প্রৌঢ় সর্দারের চূড়ান্ত ঘোষণা, এই ক্রিকেট টানা চালিয়ে গেলে বিরাট তার দাবি মেটাতে নিঃশেষ হয়ে যাবেন। ‘‘আরে সচিন তো চব্বিশ বছর খেলেছে। এ কত দিন খেলে, দেখাই যাক না,’’ প্রিয় কলেজপড়ুয়া ভাইপো চোখের সামনে চেন স্মোকার হয়ে গেলে স্নেহশীল কাকা যেমন দুঃখ পান, বেদীর গলাতেও সেই দুঃখের রেশ।
‘‘বিরাট এত ট্যালেন্টেড একটা ছেলে। কী ব্যাটটাই না করে। কিন্তু ওকে ইতিহাসের ডাক শুনতে হবে। বাণিজ্যের নয়। আমার ভয়, সেটা কোনও দিনই হয়তো ওর কানে যাবে না।’’
শুনতে শুনতে আবার বিরানব্বইয়ের ওরিলি মনে পড়ে গেল। সচিন আর বিরাট কি তা হলে কোথাও নানা ভাবে এক সুতোয় মিলেই যাচ্ছেন? টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাটিং গড় যতই শ্রেণিবিভাগ করে রাখুক!
বেদীকে এটা আর জিজ্ঞেস করার মানে হয় না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy