Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Vijay Amritraj

Indian Tennis: সম্মান সেই বিজয় অমৃতরাজকে, ভারতের টেনিস কবে বিজয়ী হবে?

উইম্বলডন চলাকালীন সম্মানিত হলেন বিজয় অমৃতরাজ। সেটাই আরও বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ভারতীয় টেনিসের করুণ অবস্থা।

লিয়েন্ডার পেজ, বিজয় অমৃতরাজ, সানিয়া মির্জা

লিয়েন্ডার পেজ, বিজয় অমৃতরাজ, সানিয়া মির্জা গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

অনির্বাণ মজুমদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২২ ১৫:০৩
Share: Save:

তাঁর পরে কে? তাঁর আগেই বা কে? কেউ নেই!

তাঁর বিজয়ই একমাত্র অমৃত হয়ে রয়ে গিয়েছে ভারতীয়দের টেনিসে রাজত্বের জন্য। কেন? টাকার অভাব? প্রতিযোগিতার অভাব? নাকি আসল কারণ প্লেয়ারদের খেলার ধরন, কোচিংয়ের মান, কোর্টের মান? দেখা গিয়েছে, ২০১১ সালে বিশ্বে প্রথম দশে থাকা প্লেয়ারদের গড় উচ্চতা যা ছিল, ২০২২ সালে সেটা প্রায় ৫ সেন্টিমিটার বেড়ে গিয়েছে। এর ফলে ফার্স্ট সার্ভ পারসেন্টেজ, এস-এর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। শক্তিশালী সার্ভিস-নির্ভর আধুনিক টেনিসে ভারতীয় খেলোয়াড়রা পিছিয়ে পড়ছেন।

এই জল্পনা, আলোচনা এবং প্রশ্নের অবতারণা সাম্প্রতিক এক ঘটনায়। যেখানে টেনিসে বিশেষ অবদানের জন্য বিজয় অমৃতরাজকে সম্মানিত করেছে আন্তর্জাতিক টেনিস ফেডারেশন। লন্ডনে ‘গোল্ডেন অ্যাচিভমেন্ট ২০২১’ পুরস্কার দেওয়া হল তাঁকে। উইম্বলডন চলাকালীনই বিজয়কে দেওয়া হয়েছে এই সম্মান। অনেকে বলছেন বটে এর ফলে ভারতীয় টেনিস সম্মানিত হল। কিন্তু সম্মানের পাশাপাশি রূঢ় বাস্তবটাও দেখিয়ে দিয়ে গেল— সত্তর এবং আশির দশকে খেলা বিজয়ের পর ভারতের আর কোনও খেলোয়াড়কে এই পুরস্কারের যোগ্য মনে করা হল না!

পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত ‘ওপেন এরা’ এবং তার পরবর্তী সময়ে রমানাথন কৃষ্ণন, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, প্রেমজিৎলাল, নরেশ কুমার, রমেশ কৃষ্ণন, অমৃতরাজ ভাইয়েরা বিশ্বম়ঞ্চে ভারতীয় টেনিসকে একটা পরিচিতি দিয়েছিলেন। বিজয় দু’বার করে উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেনের সিঙ্গলসের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিলেন। জয়দীপ চার বার উইম্বলডন, দু’বার ফ্রেঞ্চ ওপেন, এক বার ইউএস ওপেন সিঙ্গলসের প্রি-কোয়ার্টারে উঠেছিলেন। রমানাথন দু’বারের উইম্বলডন সেমিফাইনালিস্ট।

লন্ডনে আন্তর্জাতিক টেনিস ফেডারেশনের ‘গোল্ডেন অ্যাচিভমেন্ট ২০২১’ পুরস্কার নিয়ে বিজয় অমৃতরাজ।

লন্ডনে আন্তর্জাতিক টেনিস ফেডারেশনের ‘গোল্ডেন অ্যাচিভমেন্ট ২০২১’ পুরস্কার নিয়ে বিজয় অমৃতরাজ। ছবি: টুইটার

সেই সময় বিশ্বটেনিসের ‘এবিসি’-তে ‘বি’ বিয়র্ন বর্গ এবং ‘সি’ (জিমি) কোনর্সের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছিলেন ‘এ’ অমৃতরাজ। ওপেন এরার আগে রমানাথন ক্রমতালিকায় তিন নম্বরে উঠেছিলেন। বিজয় এবং রমেশ যথাক্রমে ১৬ এবং ২৩ নম্বরে উঠেছিলেন।

কিন্তু তার পর? খানিকটা সানিয়া মির্জা ছাড়া আর কেউ নেই। লিয়েন্ডার পেজ, মহেশ ভূপতি ডাবলসে রাজত্ব করলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, টেনিস বলতে সিঙ্গলসই বোঝায়। ডাবলস বা ডেভিস কাপের ম্যাচও নয়। কলকাতায় জয়দীপ মুখোপাধ্যায় টেনিস আকাদেমিতে কোচিং করাতে এসে টনি রোশ বলেছিলেন, ‘‘এমন কোনও টেনিস প্লেয়ার নেই, যে ছোটবেলায় র‌্যাকেট হাতে তুলে নেওয়ার সময় বলেছে, আমি বিশ্বের এক নম্বর ডাবলস খেলোয়াড় হতে চাই। টেনিসে ওজন, সাফল্য, গুরুত্বের এক মাত্র মাপকাঠি সিঙ্গলস।’’

সিঙ্গলসই ‘চ্যাম্পিয়ন’ চেনানোর একমাত্র মাপকাঠি। তাই রজার ফেডেরার, রাফায়েল নাদাল, নোভাক জোকোভিচরা ডাবলস খেলেন না। ডেভিস কাপে লিয়েন্ডার-মহেশের সাফল্য রয়েছে। কিন্তু দেশের হয়ে খেলার সময় তাঁদের ফেডেরার, জোকোভিচদের এক বারের জন্যও সামলাতে হয়নি।

বিজয়ের পর আন্তর্জাতিক টেনিসে সিঙ্গলসে ভারতীয়দের সাফল্য নেই। এটিপি ট্যুর সার্কিটে সাফল্য পাওয়া তো দূরের কথা, সানিয়া ছাড়া ভারতীয়দের সে ভাবে খেলতেও দেখা যায়নি। ইউকি ভামরি ২০১৫ থেকে ২০২৮ পর্যন্ত ছ’টি গ্র্যান্ড স্ল্যামে খেললেও সবকটিতেই প্রথম রাউন্ডে হেরেছেন। জয়দীপ-বিজয়দের সময় যেখানে প্রথম ২০ বা ৩০ জনের মধ্যে নিয়ম করে একাধিক ভারতীয় খেলোয়াড়কে দেখা যেত, সেখানে এখন প্রথম দেড়’শ জনের মধ্যে একজনও নেই! ভারতের সেরা পাঁচ সিঙ্গলস খেলোয়াড়ের বিশ্ব ক্রমতালিকা বলছে— রামকুমার রমানাথন (১৬৯), প্রজ্ঞেশ গুণেশ্বরণ (২৮৭), মুকুন্দ শশীকুমার (৪৫১), সুমিত নাগাল (৫১৪) এবং অর্জুন খাড়ে (৫৩১)।

লিয়েন্ডার পেজ ও মহেশ ভূপতি।

লিয়েন্ডার পেজ ও মহেশ ভূপতি। ফাইল ছবি

ভারতীয় টেনিস তলানিতে কেন? অধুনা স্টার স্পোর্টসের বিশেষজ্ঞ হয়ে যাওয়া সোমদেব দেববর্মণের বক্তব্য, ‘‘এখন ভারতীয় টেনিস খেলোয়াড়দের সব থেকে বড় সমস্যা একাকিত্ব। টেনিস এমনিতেই খুব একার খেলা। ভারতে এখন পরিস্থিতি এমন, পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। কারও থেকে সামান্য সাহায্য পাওয়া যায় না। সরকারি, বেসরকারি কোনও স্তর থেকেই স্পনসর আসে না। সবটাই নিজেকে করতে হয়। এই একাকিত্বের অনুভূতিটা ভয়ঙ্কর।’’ স্পোর্টস চ্যানেলের বিশেষজ্ঞ ধারাভাষ্যকার তথা প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় আরও বলছেন, ‘‘এশিয়ার অন্য দেশগুলো, এমনকি, ইউরোপের ছোট দেশগুলোও ঠিক পথে এগোচ্ছে। আমরা পিছিয়ে পড়ছি। ওই দেশগুলো টেনিসের পরিকাঠামো গড়ে ফেলেছে। আমরা পারছি না। যে ভাবে চলছে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’’

দ্বিতীয় সমস্যা পর্যাপ্ত প্রতিযোগিতার অভাব। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড যে রকম ঘরোয়া ক্রিকেটের উপর জোর দিচ্ছে, সেখানে ভারতীয় টেনিস সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটছে। টেনিস পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবার আগে দরকার দেশ জুড়ে এটিপি চ্যালেঞ্জার এবং আইটিএফ ফিউচার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। ২০১৪ সালে ভারতে পাঁচটি চ্যালেঞ্জার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। ২০১৫ সালে চারটি। ২০১৮ সালে তিনটি। ২০১৯ সালে দু’টি। ২০২০ সালে একটি। তার পর অবশ্য কোভিডের জন্য কোনও প্রতিযোগিতা হয়নি।

২০১৯ সালে কলকাতার সাউথ ক্লাবে ডেভিস কাপের ম্যাচে ইটালির কাছে উড়ে যাওয়ার পরে গুণেশ্বরণ বলেছিলেন, ‘‘আমাদের তৃণমূল স্তর থেকে সাহায্য দরকার। ঠিক মতো কোচিং, আর্থিক সাহায্য দরকার। এর কোনওটাই আমাদের দেশে খেলোয়াড়রা পায় না। সেটা না থাকলেও বছরে অন্তত ২০টা প্রতিযোগিতায় খেলতে পারলেও হত। কিন্তু তা-ও হয় না। বিদেশে গিয়ে খেলে বেড়ানোর খরচ কে দেবে? একটা ঠিকঠাক সিস্টেম দরকার।’’

সানিয়া মির্জা।

সানিয়া মির্জা। ফাইল ছবি

টেনিসের সঙ্গে যুক্ত অনেকে মনে করছেন, এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে ‘ইটালি মডেল’ আদর্শ। কোভিডের আগে ইটালি ১৮টি চ্যালেঞ্জার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। তার মধ্যে ইতালিয়রা আটটিতে জিতেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ১৯ বছরের তরুণ জানিক সিনার। তিনি দু’টি প্রতিযোগিতায় জিতেছিলেন। ২০১৮ সালে প্রথম ১০০ জনের মধ্যে থাকা ইতালীয় খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল চার। ২০১৯ সালে দ্বিগুণ, আট। দু’টি ট্রফি জেতা সিনার র‌্যাঙ্কিংয়ে ৭৬৩ নম্বর থেকে চলে আসেন ৭৮ নম্বরে। এর পর এটিপি নেক্স জেন টুর্নামেন্টও জেতেন সিনার। সেটিও হয়েছিল ইটালিতে। এখন সিনারের র‌্যাঙ্কিং ১৩।

বেঙ্গল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তার কথায়, ‘‘চ্যালেঞ্জার প্রতিযোগিতা বেশি আয়োজন করলে ফেডারেশনের হাতে ওয়াইল্ড কার্ড থাকে। তখন প্রতিটি প্রতিযোগিতায় আয়োজক দেশের চার-পাঁচ জন অনায়াসে খেলতে পারে।’’

তথ্য বলছে, কোভিডের আগে ২০১৯ সালে স্পেনে সাতটি চ্যালেঞ্জার হয়েছিল। ফ্রান্সে ১৫টি। এখন প্রথম ১০০-এ ফ্রান্স, স্পেন এবং ইটালির খেলোয়াড়ের সংখ্যাই সব থেকে বেশি।

সোমদেব দেববর্মন।

সোমদেব দেববর্মন। ফাইল ছবি

প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় জয়দীপ ভারতে কোর্টের মান নিয়ে অসন্তুষ্ট। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এখন ঘাসের কোর্টগুলোকে ধরে ধরে হার্ড কোর্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এমন হলে ভারত থেকে খেলোয়াড় উঠবেই না। মন্থর কোর্টে খেলে তৈরি না হলে পায়ের পেশি শক্তিশালী হবে না। নাদাল, জোকোভিচরা ক্লে কোর্টে খেলেই বড় হয়েছে। সেই কারণে ওদের পা এত শক্তিশালী।’’

ভারতের ডেভিস কাপ দলের কোচ জিশান আলিও বলছেন, ‘‘ক্লে কোর্টে খেললে ধৈর্য বাড়ে। লড়াই করার শক্তি বাড়ে। টানা ১০-১৫টা শট খেলে কী করে একটা পয়েন্ট জিততে হয়, সেটা শেখা জরুরি। বিশেষ করে জুনিয়র স্তরে। কারণ, বেসলাইন থেকে উইনার মারার মতো শক্তি খুদে খেলোয়াড়দের থাকে না। ভারতের ক্লে কোর্টগুলো প্রায় হার্ড কোর্টের মতো। এতে বালির ভাগ বেশি থাকে। লাভের লাভ কিছু হয় না।’’

ফলে জুনিয়র স্তর থেকেই পিছিয়ে পড়ছে ভারতীয় টেনিস। এ বারের ফরাসি ওপেন টানা পঞ্চম গ্র্যান্ড স্ল্যাম, যেখানে জুনিয়র স্তরে একজনও ভারতীয় খেলেনি। জুনিয়র স্তরে প্রথম একশোয় ছেলেদের মধ্যে একজন ভারতীয়ও নেই। মেয়েদের মধ্যে প্রথম দুশোয় কোনও ভারতীয় নেই।

পরিসংখ্যান বলছে, ডেভিস কাপে গত সাত বছর ধরে ভারত নিয়মিত ভাবে এশিয়া-ওশেনিয়া গ্রুপে জিতে সরাসরি ওয়ার্ল্ড গ্রুপ প্লে-অফে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। কিন্তু প্রত্যেক বারই ওয়ার্ল্ড গ্রুপ প্লে-অফে ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার প্রতিপক্ষের কাছে হেরেছে।

রোগ অনেক। ওষুধও মোটামুটি জানা। কিন্তু ভারতীয় টেনিসকে সেই বিশল্যকরণী খাওয়াবেন কে? এটাই বড় প্রশ্ন। এর জবাব পাওয়া না গেলে বিজয়ের পর সম্মান জানানোর মতো আর কাউকেই হয়তো পাওয়া যাবে না!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy