অমলিন: ভারতীয় ফুটবলের সেই বিখ্যাত ত্রয়ী। চুনী-পিকে-বলরাম। ফাইল চিত্র
কয়েক মাস আগে যুবভারতীতে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা কোচ রহিম সাহেবের নামে তৈরি হতে যাওয়া একটি ছবির শুটিংয়ে শেষ বার পিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। চুনীও (গোস্বামী) এসেছিল সে দিন। পিকে এবং চুনী দু’জনেই এসেছিল হুইল চেয়ারে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল আমার দুই বন্ধুরই। দেখে খারাপই লাগছিল। পিকে আমাকে বলল, ‘বলরাম, কেমন আছিস? হাঁটতে পারছিস এখনও? আমি তো একদম পারিই না। মনে আছে, তুই আর আমি কত ম্যাচে এক সঙ্গে গোল করে দেশকে জিতিয়েছি। তোর পাস থেকে কত গোল করেছি আমি। বাংলাকে সন্তোষ ট্রফি দিয়েছি। কত আনন্দ করেছি বিদেশে খেলতে গিয়ে। আড্ডা দিয়েছি। মজা করেছি।’’ পি কে বলে যাচ্ছে আর আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কত স্মৃতি ভেসে উঠছে মনের ভিতরে।
দুটো অলিম্পিক্সে একসঙ্গে খেলেছি। দুটো এশিয়ান গেমস। সুদূর প্রাচ্য সফর থেকে চারদেশীয় প্রতিযোগিতা—কত আন্তর্জাতিক মঞ্চে দু’জনে খেলেছি দেশের জার্সিতে। গোলের ঠিকানা লেখা কত যে পাস বাড়িয়েছি ওর জন্য, তার হিসেব নেই। পিকে যেন তৈরিই থাকত আমার পাসের জন্য। মনে আছে ১৯৬০-এর রোম অলিম্পিক্সে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সেই গোলের কথা। আমি বল বাড়িয়েছিলাম। কী অসাধারণ গোল করেছিল পি কে। গোল করে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে আমি গোল করেও দেশকে জেতাতে পারিনি। প্রদীপের গোলটার পরে ম্যাচ ড্র করেছিলাম ফ্রান্সের সঙ্গে। সে বার ও-ই অধিনায়ক ছিল অলিম্পিক্সে। দু’জনে মাঠে আসার আগে শপথ নিতাম, সেরা ফুটবলটা খেলব। ও বরাবরই খুব মিশুকে। অনর্গল কথা বলে যেতে পারে। পুরো দলকে তাতিয়ে রাখত রোমে। মাঠে কখনও অধিনায়কোচিত মনোভাব নিয়ে সবার সঙ্গে মিশত না। নিজে গোল করতে না পারলে এসে ক্ষমা চাইত।
অসাধারণ বল কন্ট্রোল ছিল পিকের। বল পায়ে পড়লে ওকে রোখা ছিল অসম্ভব। প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে পারত। মুহূর্তে বিপক্ষের গোলের সামনে পৌঁছে যেত। আমি লেফট উইংয়ে খেলতাম। ও রাইট উইংয়ে। বল বাড়াতাম, পিকে কাট করে ভিতরে ঢুকে আসত। ছিন্নভিন্ন করে দিত বিপক্ষের রক্ষণ। কোচ রহিম সাহেব অনুশীলনে ওটাই করাতেন। একবার হল কী, কোনও একটা ম্যাচে আমি সে ভাবে বল বাড়াতে পারছিলাম না ওকে। মানে, প্রতিপক্ষ যারা ছিল তারা আমাকে কভার করছিল এমন ভাবে যাতে আমি পিকে-কে বল না বাড়াতে পারি। বিরতিতে হঠাৎই রহিম স্যর আমাকে ডেকে বললেন, তোমার সঙ্গে প্রদীপের কি কোনও সমস্যা হয়েছে? উনি সুভদ্র হলেও কড়া ধরনের ছিলেন। বোঝাতে চেয়েছিলেন, আমার সঙ্গে পিকে-র কোনও ঝগড়া হয়েছে কি না। বিরতির পরে অবশ্য আমার পাস থেকেই একটা গোল করেছিল পি-কে। যত দূর মনে পড়ছে ওটা কোনও একটা এশিয়ান গেমসের ম্যাচ হবে।
হায়দরাবাদের এক গ্রামে জন্ম আমার। আগেকার দিনে জন্মের সাল-তারিখ কেউ খেয়াল করত না। আসলে জন্ম হত বাড়িতে। এখনকার মতো কোনও সার্টিফিকেটের বালাই ছিল না। স্কুলে একটা তারিখ দিয়ে বাবা-মা ভর্তি করিয়ে দিতেন ছেলেকে। সেই ভাবেই আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল হায়দরাবাদের স্কুলে। সেই তারিখ ধরলে আমি পিকে-র চেয়ে বছর খানেকের বড় হব বোধহয়। কিন্তু দু’জনের মধ্যে তুই-তোকারির সম্পর্ক ছিল। আর সব চেয়ে বড় কথা, ১৯৫৬ থেকে ১৯৬২, আমি আর পিকে একসঙ্গে জাতীয় দলের জার্সিতে অসংখ্য ম্যাচ খেলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, কখনও কোনও দিন আমাদের মধ্যে কোনও মনোমালিন্য হয়নি। দু’জনেই গোল করা নিয়ে স্বার্থপরতা দেখাইনি। যে ভাল জায়গায় থাকত, তাকেই বল বাড়াতাম। পিকে-র সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, দু’জনেই মাঠে ছিলাম একে অন্যের পরিপূরক। পরবর্তী কালে চুনী আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় চুনী-পিকে-বলরাম তো ভারতীয় ফুটবলে মিথ তৈরি করে ফেলেছিল। আমি খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরেও ওরা দু’জনে খেলে গিয়েছে।
পিকে ছিল কমপ্লিট ফুটবলার। চুনীর সঙ্গে তুলনা করে এরকম দুঃখের দিনে বিতর্ক তুলতে চাই না। তবে এটা বলছি, অসাধারণ ড্রিবল ছিল পিকে-র পায়ে। গোলার মতো শট মারতে পারত। গোলের সামনে পিকে ছিল ভয়ঙ্কর। প্রচুর গোল করেছে। ক্লাব ফুটবলে আমার সঙ্গে ও কখনও খেলেনি। ও খেলত ইস্টার্ন রেলে আর আমি ইস্টবেঙ্গলে। কিন্তু দেশ বা রাজ্যের হয়ে আমি আর পিকে প্রচুর খেলেছি। সন্তোষ ট্রফিতে যে বার আমি অধিনায়ক হয়েছিলাম, সে বার খেলেনি। তখন ও ইস্টার্ন রেলে চাকরি পেয়ে ওখানেই খেলছে। কিন্তু যোগাযোগ ছিল। বাড়িতে গিয়ে ওর স্ত্রী, আমি, পিকে প্রচুর আড্ডা মারতাম। আরতি মারা যাওয়ার পরে মেয়েরা ওকে সারাক্ষণ আগলে থাকত। দুই মেয়েকে নিয়েই খুব গর্ব করত। নানা অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে দেখা হত মাঝেমধ্যে। এখনকার ফুটবলের হাল নিয়ে আলোচনা হত।
চুরাশি বছর বয়স হয়ে গিয়েছে আমার। সব কিছু মনে নেই। তবে যত দূর মনে পড়ছে, আমি যত দিন লাল-হলুদ জার্সিতে খেলেছি একবারও পিকে-র দল ইস্টার্ন রেল আমাদের হারাতে পারেনি। তাতে অবশ্য বন্ধুত্ব নষ্ট হয়নি। দু’জনে খেলার পরে মাঠেই গল্পে মেতেছি। মানুষ পিকে আমার কাছে অনন্য। ক্লাব ফুটবলে আমাকে হারাতে পারেনি কখনও। জীবন যুদ্ধেও হেরে গেল। মানুষের জীবনে মৃত্যু তো আসবেই। সেটাই অমোঘ নিয়ম। তা জেনেও যে মন সব কিছু মানতে চায় না। পি-কে র মৃত্যু আমার কাছে বড় দুঃসংবাদ। মনে হচ্ছে, আমারও তো বয়স হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy