Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ক্রিকেট বিশ্ব সিডনি সেমিফাইনাল নিয়ে বিভাজিত

লারা বললেন, অস্ট্রেলিয়াকে আমার নড়বড়ে লাগছে

তিনি ব্রায়ান লারা! পরিষ্কার হিসেব যেখানে মাইকেল হোল্ডিং, সেখানে তিনি নেই। বহু বছর ধরেই নেই। তিনি মাইকেল হোল্ডিং! ভিভের অধীনে খেলতে মজা পাচ্ছিলেন না বলে ২৪৯ টেস্ট উইকেট নিয়েও এক মুহূর্তে খেলা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভিভের কথাই শোনেননি তো কে লারা! শনিবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ঘোর দুর্যোগের দিনে ক্রিকেট বিশ্ব হতচকিত হয়ে দেখল একই মঞ্চে দু’জনে একসঙ্গে! প্রথমে লারা, তার পর হোল্ডিং। আনুষ্ঠানিক সিট-ডাউন ডিনারের মাঝে দু’জনের প্রায় পরপর বক্তৃতা।

অভাবিত ভাবে একই মঞ্চে: আগে-পরে বক্তৃতা দিয়ে গেলেন লারা, হোল্ডিং। সিডনির অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন গ্রেগ চ্যাপেলও। তবে শ্রোতা হিসেবে।

অভাবিত ভাবে একই মঞ্চে: আগে-পরে বক্তৃতা দিয়ে গেলেন লারা, হোল্ডিং। সিডনির অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন গ্রেগ চ্যাপেলও। তবে শ্রোতা হিসেবে।

গৌতম ভট্টাচার্য
সিডনি শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০৩:১৭
Share: Save:

তিনি ব্রায়ান লারা! পরিষ্কার হিসেব যেখানে মাইকেল হোল্ডিং, সেখানে তিনি নেই। বহু বছর ধরেই নেই।

তিনি মাইকেল হোল্ডিং! ভিভের অধীনে খেলতে মজা পাচ্ছিলেন না বলে ২৪৯ টেস্ট উইকেট নিয়েও এক মুহূর্তে খেলা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভিভের কথাই শোনেননি তো কে লারা!

শনিবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ঘোর দুর্যোগের দিনে ক্রিকেট বিশ্ব হতচকিত হয়ে দেখল একই মঞ্চে দু’জনে একসঙ্গে! প্রথমে লারা, তার পর হোল্ডিং।

আনুষ্ঠানিক সিট-ডাউন ডিনারের মাঝে দু’জনের প্রায় পরপর বক্তৃতা। তা স্টেজের সবচেয়ে কাছের টেবলটায় যে ভদ্রলোক বসে আছেন, তিনি এই ইভেন্টের জন্যই দুপুরে সস্ত্রীক ব্রিসবেন থেকে এসেছেন। আবার রোববার ফেরত চলে যাবেন। প্লেনে ছিলেন বলে গাপ্টিলের ইনিংসটা তাঁর দেখা হয়নি। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন, “কী ভাবে সাজিয়েছে ওর ইনিংস? কী ধরনের ব্যাট ব্যবহার করছিল?” একই টেবলে তিনি আর লারা। দু’জনের কাছেই ভিড়। তাঁর নামটা বলা হয়নি— গ্রেগ চ্যাপেল।

পাশের টেবলে হোল্ডিংকে এরই মধ্যে দু’তিন জন ধরল। আমরা মাইকেল হোল্ডিং না হয়েও বুঝতে পারি আজকের দিনে আপনার মনের ওপর দিয়ে কী ঝড় বইছে! ওয়েলিংটনের হত্যাকাণ্ডে অবশ্যই আপনি বিচলিত!

হোল্ডিং কিছুটা রুক্ষ ভাবে বললেন, “আমার হাতে বল থাকত ১৯৮৫-তে। এখন ২০১৫। এখন আমি এ সব শুনে কী করব!” পাশ থেকে হোল্ডিংয়ের অস্ট্রেলিয়াবাসী ঘনিষ্ঠ বন্ধু বললেন, “মাইকি এমন একজন মানুষ যে পেছনে চক্কর খায় না। জীবনে সামনে এগোয়। তা ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ এত হেরেছে যে, ও সিস্টেম থেকেই সেই ব্যক্তিগত খারাপ লাগাকে সরিয়ে দিয়েছে।”

সিডনি ক্রিকেট মাঠের ভেতর চার তলার বিশাল বক্সে এলবিডব্লিউ ট্রাস্টের চ্যারিটি ডিনার ছিল শনিবার। খুবই ফর্ম্যাল অনুষ্ঠান। পুরুষরা কোট-টাই ছাড়া ঢুকতে পারবেন না। মহিলারাও ক্যাজুয়্যাল পোশাকে চলবে না। সেই সিডনি মাঠে ঢুকে উইকেটের পাশে এক ঝলক দাঁড়াবার সুযোগ হল। আপাতত সাদা আচ্ছাদনে ঢাকা কিন্তু অন্তত কৌতূহল, খুললে কী বার হবে? স্পিন সহায়ক দেখাবে? না কি ক্লার্ক যা চাইছেন তেমন পিচ? শ্রীনির মাধ্যমে ভারত জোর দিয়ে সেটার ব্যবস্থা করবে? না কি স্থানীয় চাপ জিতবে? ক্লার্কের দাবি মতো ডিজাইনার সারফেস হবে?

গাপ্টিলের বিস্ফোরক ডাবল সেঞ্চুরি আর আইসিসি প্রধানের বাংলাদেশ ম্যাচের আম্পায়ারিং নিয়ে নজিরবিহীন বিবৃতির আলোচনা সর্বত্র। কিন্তু তাকে ছাপিয়েও এখন সেমিফাইনাল। শনিবার মাঠের ভেতর গিয়ে বোঝা গেল কত পরিবর্তন করা হয়েছে। পুরনো অনেক স্ট্যান্ড ভেঙে ফেলা হয়েছে। নামকরণ তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন প্লেয়ার্স ড্রেসিংরুমের দিকটা ব্র্যাডম্যান আর মন্টি নোবেল স্ট্যান্ড। উল্টো দিকে ভিক্টর ট্রাম্পার আর বিল ও’রাইলি স্ট্যান্ড। অস্ট্রেলীয় এবং বিশ্ব ক্রিকেটের এক-একজন অমর যুগপুরুষ নিজের নিজের জায়গায় বিশ্রামরত। শুধু নামগুলোর দিকে চোখ গেলেও মাঠটা ঘিরে অসীম শ্রদ্ধাবোধ হয়।

ঐতিহাসিক যে সব ম্যাচ সিডনি ক্রিকেট মাঠে ঘটে গিয়েছে তার বিচারে এ বারের বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল নিছকই একটা কমা। আইকন সদৃশ কিছু নয়। অথচ বিশ্বকাপের দমকা হাওয়ায় তারই পারফিউম চার দিকে। সিডনি বাস টার্মিনাস এবং সেন্ট্রাল স্টেশনের আশেপাশে এ দিন কিছু বিশ্বকাপ বিলবোর্ড লক্ষ্য করা গেল। অবশেষে! কিন্তু অবশেষে উদিত হওয়ার আগেই তো সেমিফাইনাল নিয়ে আলোচনা উদয় হয়ে গিয়েছে— কারা জিতবে?

সকালে অ্যাডিলেড থেকে সিডনি আসার সময় আধুনিক ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত মাইক আথারটন বললেন, “মনে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।” আথারটনের ক্রিকেট দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা মোটেও তাঁর সাবেকি ব্যাটিং স্টাইলের মতো নয়। বরং বেশ অভিনব। পরের বার কলকাতায় গেলে ইডেন আরও ভাল করে বোঝার জন্য শহরের জনজীবনে উঁকিঝুঁকি দেবেন। যেমন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউস যাবেন। এ হেন কেমব্রিজ শিক্ষিত প্রাক্তন অধিনায়কও কিন্তু দ্বিতীয় সেমিফাইনাল ঘিরে নতুনত্ব কিছু দেখছেন না। তাঁর মনে হচ্ছে গোটা অস্ট্রেলিয়ান গ্রীষ্মের তুলনায় ভারত অনেক লড়বে। ম্যাচটাকে টাইট করবে। কিন্তু শেষে হারবে। সিডনি মাঠ চত্বরে পেয়ে গেলাম ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথম খেলা ক্রিকেটার গুরিন্দর সাঁধুকে। এই তো গত জানুয়ারিতে ভারতের বিরুদ্ধেই তাঁর ওয়ান ডে আবির্ভাব।

ছয় ফুট চার ইঞ্চি মতো লম্বা গুরিন্দর একটুও না ভেবে বললেন, “অস্ট্রেলিয়া। সেমিফাইনালে ফিঞ্চ রান করবে আর ফাইনালে ওয়ার্নার।” এ দিন অস্ট্রেলিয়ান দৈনিকে ডিন জোন্স ম্যাচ নিয়ে একটা কলাম লিখেছেন। তাতে ধোনি আর রবি শাস্ত্রীর বিরাট প্রশংসা করে ভারত যে এ বার যুঝবে, তার পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছেন।

হোল্ডিং অবশ্য বরাবরের মতোই চাঁছাছোলা। “দেখুন অস্ট্রেলিয়া বেটার টিম। তবে ওরা জিতবে কি না আমি বলতে পারছি না। বেটার টিম যে সব সময় জেতে না সেটা তিরাশির লন্ডনের কথা চিন্তা করলেই বুঝবেন।” তুমুল হাততালি হল। কিন্তু সেই আওয়াজের ফাঁক দিয়েও বোঝা গেল, পুরনো ব্যথা থেকে হোল্ডিংয়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজের আজও রক্ত ঝরে।

লারাকে কিছুটা দুঃখিতই দেখাল। বারবার বলছিলেন, “আজকের হারটা ভীষণ হতাশাজনক।” মনে হল তাঁর প্রিয়তম শহর সিডনিতে থাকলেও ওয়েলিংটনের হত্যালীলা ভুলতে পারছেন না। বরদাস্ত হচ্ছে না। “কী যে চলছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে। রোগটা অনেক গভীরে। শুধু প্লেয়ারদের দোষ দিয়ে হবে না,” বললেন লারা। আজ যেন পলিটিক্যালি কারেক্ট বলার মতো মানসিকতাই নেই তাঁর। সব খিঁচড়ে রয়েছে। নইলে এত বছর পর কেন বলবেন, “সচিন আর আমাকে নিয়ে ক্রমাগত তুলনা বিরক্তিকর এবং অপ্রয়োজনীয় ছিল। দু’জন এন্টারটেনার এক সময়ে এলেই তাদের মাপতে হবে কেন?” ওয়ার্ন আর মুরলীর মধ্যে তফাত কী, তা-ও আজকের মেজাজে বলে দিলেন। “ওয়ার্ন ম্যাচ থেকে কখনও সরে যেত না। প্রথম এক ঘণ্টা আমাকে আউট করতে না পারলেও আমি জানতাম যে কোনও সময় ওর হাত থেকে একটা অসাধারণ ডেলিভারি বেরিয়ে যেতে পারে। মুরলীকে কিন্তু প্রথম আধ ঘণ্টা খেলে দিলে ও ভেঙে পড়ত। ওয়ার্নের সেই মনের জোরটা ওর ছিল না বলে ওকে আমি দু’নম্বরে রাখব।”

সিডনি ক্রিকেট মাঠেই তো লারার সেই অমর ২৭৭! সিডনি হারবার ব্রিজে সারা রাত পার্টি করে যে টেস্টটা খেলতে এসেছিলেন, এ দিন স্বীকার করলেন। এখানে এলে বোধহয় ব্যাট ছাড়াও তিনি স্ট্রোক খেলেন। এমনই প্রিয় সারফেস। নইলে ভরা সমাবেশকে অবাক করে দিয়েই কেন বলবেন, “অস্ট্রেলিয়াকে আমার নড়বড়ে লাগছে। অ্যাডিলেডেও খানিকটা নড়বড়ে লেগেছে। এক-এক সময় আমার মনে হচ্ছিল স্টিভ স্মিথ বুঝি একটা উইকেটে খেলছে। আর ওয়াটসন সহ বাকিরা অন্য পিচে।”

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আবার ত্রিনিদাদের রাজপুত্রের সঙ্গে একমত নন। তিনি মনে করেন ওয়াহাব রিয়াজ স্পেলটা করার সময় অস্ট্রেলিয়ার ওই যে টেনশনের সময়টা, সেটা আসা খুব স্বাভাবিক। “আরে ভারতকেও জিম্বাবোয়ে আর একটা লম্বা সময় বাংলাদেশ ম্যাচে কামড়েছে। ওইটুকু থাকবেই।”

আস্তরণের নীচে কী নিয়ে অপেক্ষা করছে সিডনির বাইশ গজ?

এমসিজিতে বাংলাদেশের দিন মাঠ ভরেনি। কিন্তু সেমিফাইনালের দিন এসসিজি ভরা নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। একমাত্র কৌতূহল, ভারত কি জনসমর্থনে প্রভূত এগিয়ে হোম সেমিফাইনাল খেলবে?

জানার জন্য মাত্র চার দিনের অপেক্ষা। হোল্ডিং-লারা কবে মিটবে তার আভাস কিন্তু পাওয়া গেল না। দু’জনকে বসানো হল কাছাকাছি। কিন্তু দুটো আলাদা টেবলে। হোল্ডিং তাঁর বক্তৃতায় নাম না করে বললেন, “আমার কমেন্ট্রিতে অনেকে দুঃখ পেয়ে সরে গিয়েছে। বাউন্সার খাওয়া কোনও কোনও ব্যাটসম্যান যেমন আমার সঙ্গে পরবর্তীকালেও বন্ধুত্ব করেনি। তেমনই তারাও আসেনি। কিন্তু আমি কী করব? যা দেখি তাই খোলাখুলি টিভিতে বলি। কারও মন রাখা আমার সম্ভব নয়।”

গ্রেগ চ্যাপেল নীচে বসে সব শুনছেন আর হাসছেন। তাঁকে বিশ্বকাপের কোনও ম্যাচ বা অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে না কেন? চ্যাপেল প্রশ্নটা ‘ডাক’ করে গেলেন। তাঁকে সিডনিতে দেখে মনে পড়ল, এই মাঠেই তো সৌরভকে প্রথম প্র্যাকটিস দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের পরপর। তার পরই তো মুগ্ধ হওয়া সৌরভের তাঁকে কোচ হিসেবে ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব।

আপাতত গ্রেগ-সৌরভ দু’জনেই সিডনিতে। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে। অথচ মনে হয় না কেউ কারও খবরও রাখেন বলে। লারা-হোল্ডিংয়ের মতোই। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের তো ফল জানা যাবে বিষ্যুদবার। এই সম্পর্কগুলোর চূড়ান্ত রিপোর্ট বোধহয় স্থগিতই রয়ে গেল!

ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE