Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
অচেনা জয়ে দিনবদলের জয়ধ্বনি

কুম্বলে-টোটকা কাজে লাগিয়ে বোলিং সাফল্য

থমথমে মুখ নিয়ে প্রেস কনফারেন্স রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে দুই ইংরেজ সাংবাদিকের ঝামেলা। ‘সো সিলি, সো সিলি’ বলে গজগজ করছিলেন এক জন। অন্য জনও উত্তেজিত। বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ‘‘তুমি যদি ভাল ব্যাট করতে না পারো, তা হলে টেস্ট জিতবে কী করে?

বিজয়ী-মেজাজ। সোমবারের কোহালি-অশ্বিন। বিশাখাপত্তনমে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

বিজয়ী-মেজাজ। সোমবারের কোহালি-অশ্বিন। বিশাখাপত্তনমে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

রাজীব ঘোষ
বিশাখাপত্তনম শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৯
Share: Save:

থমথমে মুখ নিয়ে প্রেস কনফারেন্স রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে দুই ইংরেজ সাংবাদিকের ঝামেলা।

‘সো সিলি, সো সিলি’ বলে গজগজ করছিলেন এক জন। অন্য জনও উত্তেজিত। বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ‘‘তুমি যদি ভাল ব্যাট করতে না পারো, তা হলে টেস্ট জিতবে কী করে? দেখলে কী ভাবে মাত্র ৫৫ রানের মধ্যে সাত-সাতটা উইকেট পড়ে গেল! জাস্ট আনবিলিভেবল!’’

ভারতের টেস্ট জয়ের পর সফরকারী দেশের সাংবাদিকরা নিজেদের মধ্যে ভারতের র‌্যাঙ্ক টার্নার বা স্পিনারদের তাণ্ডব নিয়ে আলোচনা না করে নিজেদের দলের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করছেন, এতেই কি মনে হয় না যে, দিন বদলে গিয়েছে?

যেমন ২৪৬ রানে টেস্ট জেতার পর বিরাট কোহালিদের বাঁধনছাড়া উল্লাস নেই। কারণ, সিরিজ এখনও অনেক বাকি। সেলিব্রেশনটা তুলে রাখা হল সিরিজ জয়ের দিনের জন্য। অশ্বিন অবশ্য গেলেন বিশাখাপত্তনম বন্দরে নৌসেনার এক জাহাজে, নেভি অফিসারদের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে।

যেমন, শুধু স্পিনাররা নন, পেসাররাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দলের জয়ে সামিল হচ্ছেন।

যেমন ঘূর্ণি উইকেট না পেলেও কুছ পরোয়া নেই। তাতেই জেতার মানসিকতা তৈরি হওয়া।

বিশাখাপত্তনমে পা রাখার আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল টেস্টের এই উইকেটে বল দ্বিতীয় দিন থেকেই ঘুরবে। তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে নাকি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই গানটাও মনে পড়তে পারে, ‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক, এই দুনিয়া ঘোরে বনবন বনবন, ছন্দে ছন্দে কত রং বদলায়, রং বদলায়।’

ম্যাচের রং বদলাল ঠিকই। বনবন করে ঘুরলও। তবে ভারতীয় স্পিনারদের হাত থেকে ছিটকে বেরনো বল যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘুরল অ্যালিস্টার কুকের ব্যাটসম্যানদের মাথা।

সোমবার, টেস্টের শেষ দিনও সেই ঘূর্ণি কোথায় ওয়াইএসআর রেড্ডি স্টেডিয়ামের বাইশ গজে, যা নাকি দ্বিতীয় দিন থেকেই পাওয়া যাবে বলা হয়েছিল? আনকোরা টেস্ট স্পিনার জয়ন্ত যাদবকে তো সমানে সোজা বল করে যেতে হল, নির্দিষ্ট একটা লাইন-লেংথ বজায় রেখে। যেটা আগের দিন খেলার পর প্র্যাকটিস করিয়ে তাঁকে একেবারে পাখি পড়ানোর মতো বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অনিল কুম্বলে।

বাধ্য ছাত্রের মতো সেটাই করলেন জয়ন্ত। তাতেই ইংরেজ মিডল ও লোয়ার অর্ডারের তিনটে উইকেট নিয়ে নিলেন হরিয়ানার নতুন অফস্পিনার। উইকেট পেলেন মহম্মদ শামিও। দ্বিতীয় ইনিংসে জো রুটকে তো তিনিই ফেরালেন। কিন্তু এমন উইকেটে ৪০৫-এর টার্গেট নিয়ে নেমে ইংল্যান্ডের ৮৭-২ থেকে ১৪২-৭ হয়ে যাওয়া। ১৫৮-এ অল আউট। মাত্র ৮৩ রানের মধ্যে দশটা উইকেট পড়ে যাওয়া। এ সবই যেন অবিশ্বাস্য।

সেই জন্যই বোধহয় সেই আলোচনাটা বিদেশের মিডিয়ায় নেই। পছন্দের উইকেট বানিয়ে টেস্ট জয়ের অভিযোগটা এ বার আর তেমন উঠতে দেখা যাচ্ছে না, যা উঠেছিল গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের সময়।

লন্ডনের দ্য টেলিগ্রাফ-এর ওয়েবসাইটে স্যর জেফ্রি বয়কট শুধু লিখেছেন, ‘‘আমার মনে হয় ভারত নিজেদের যতটা ভাল মনে করে, ওরা ততটা নয়। আর ইংল্যান্ডকে যতটা খারাপ ভাবে ভারত, ততটা খারাপও ওরা নয়। দ্বিতীয় টেস্টের মার্জিন থেকে দু’দলের সঠিক ব্যবধানটা মোটেই বোঝা যায় না।’’ ইংল্যান্ড এই ব্যবধানটা ঘুচিয়ে কী ভাবে ফিরে আসবে, সেটা তো পরের কথা। তবে তাদের ফিরে আসতে গেলে যে এর চেয়ে অনেক ভাল পারফরম্যান্স দেখাতে হবে, তা এ দিন স্বীকার করতে দ্বিধা করলেন না কুক।

সোমবার বিকেলে খেলার শেষে উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা গেল, দু’দিকের ক্রিজের সামনে একটা ভাল মতো রাফ তৈরি হয়েছে। চার দিন ধরে বোলারদের জুতোর স্পাইকের খোঁচায় ওই রাফ বা খড়খড়ে ভাব তৈরি হয়েছিল দুই ক্রিজের সামনে। এটা লক্ষ্য করেই অনিল কুম্বলে শনিবার তৃতীয় দিন খেলার পরে বেশ কিছুক্ষণ জয়ন্ত যাদবকে নিয়ে পড়েছিলেন ওই রাফে বল ফেলে কী করে কাজে লাগাতে হবে, তার তালিম দিতে। রাফে পড়ে বল যেমন লাফিয়েছে, তেমনই ঘুরেছেও। শেষ দু’টো উইকেট নিয়ে হ্যাটট্রিকের মুখেও ছিলেন তিনি। হ্যাটট্রিক না হলেও টেস্ট অভিষেকটা খারাপ হল না জয়ন্তের। ব্যাটে ৬২ রান করা ছাড়াও ২৩ ওভার বল করে চারটে উইকেট। কুম্বলে এ ভাবেই অশ্বিনের উপর থেকে চাপ কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সমানে।

মহম্মদ শামি, উমেশ যাদবরাও ওই রাফ থেকে যথেষ্ট ফায়দা তুলেছেন। দু’জনেই উইকেট তোলার পাশাপাশি ইংল্যান্ডকে চাপে রেখে যান সারা ম্যাচে। স্পিনার ও পেসারদের যে এই টিমওয়ার্কে বেশ খুশি কোহালি। খেলার শেষে বললেন, ‘‘আজ শামি দুটো উইকেট পেয়েছে। উমেশ প্রথম ইনিংসে ব্রেক থ্রু দিয়েছিল আমাদের। ওদের ছোট ছোট স্পেলে বল করিয়ে উপকার পাওয়া যাচ্ছে। এতে স্পিনাররাও ফ্রেশ থাকতে পারছে। দলের বোলারদের যে এ ভাবে একে অন্যের কাজে লাগানো যাচ্ছে, তাতে টিমেরই ভাল হবে। তা ছাড়া শামি, উমেশ যে আগের দিন নতুন বলে ১৪৫ কিমি গতিতে বল করে গেল সমানে। এটাও তো কম বড় পাওয়া নয়।’’

ভারতীয় দলের প্রাক্তন বোলিং কোচ বেঙ্কটেশ প্রসাদ যেমন বেঙ্গালুরু থেকে বললেন, ‘‘আমরা তো দেখছি, ভারতকে শুধুই কোহালি আর অশ্বিন জেতাচ্ছে। এটা এক দিক থেকে যেমন ভাল, আবার খারাপও। ওদের সাপোর্ট দেওয়ার মতো যে কেউ আছে, এই টেস্টে সেটা বোঝা গেল। এটাই বা কি কম ভাল খবর?’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘গত কয়েক মাস ধরে অশ্বিনের উপর যা চাপ পড়ছে, এটা কমানো দরকার ছিল। দেশের মাঠে র‌্যাঙ্ক টার্নার করা মানে তো অশ্বিনের উপর চাপটা বেড়ে যাওয়া। কিন্তু রাজকোট, বিশাখাপত্তনমের মতো উইকেটে যত খেলা হবে, ততই ভাল হবে। ওয়ার্কলোডটা সে ক্ষেত্রে বাকি বোলারদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। বাকিরাও সুযোগ পাবে উইকেট তোলার।’’ ইংল্যান্ড অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক অবশ্য ভারতীয় বোলারদের সম্পর্কে বলছেন, ‘‘ওরা সত্যিই ভাল বোলার। তবে সুপারম্যান নয়। রাজকোটে আমরা ওদের বিরুদ্ধে সাতশো রান তুলেছিলাম, চারটে সেঞ্চুরি করেছিলাম। তবে শেষ ইনিংসে ওরা খুব ভাল করেছে।’’

যে ব্যবধানে ইংল্যান্ড হারল, সেই রানটা কিন্তু কোহালির ব্যাট থেকেই আসা। প্রথম ইনিংসে ১৬৭ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৮১। প্রথম ইনিংসে পূজারা, কোহালি আর অশ্বিনের ব্যাটই ভারতকে সাড়ে চারশোর উপর রান তুলতে সাহায্য করেছিল। দ্বিতীয় ইনিংসেও সেই কোহালিই ত্রাতা।

ব্যাটসম্যানদের এই অফ ফর্ম ভাবাচ্ছে কোহালিকে। কিন্তু বোলাররা সেই ঘাটতি দূর করে দেওয়ায় আপাতত তা খুঁচিয়ে ঘা করতে চান না। কোন ক্ষতের প্রলেপ দিতে হবে, সেটা তো তাঁর ভালই জানা। সঙ্গে এ-ও জানেন যে, এখন টিমের এই রোগের চিকিৎসাও শুরু করতে হবে। তাঁকে এখন শুধু টিম ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন বলা যাবে না বোধহয়, ডক্টর কোহালিও বলতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Anil Kumble Indian Spinners
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE