ভক্ত: ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের ফিটনেসও যাচাই করতেন শচীন দেববর্মণ। ফাইল চিত্র
তাঁর সুরের জাদুতে মুগ্ধ ভারতবাসী। বলিউডের বিখ্যাত প্রযোজক, পরিচালকেরা হাজারো চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। বন্ধ হয়ে গিয়েছে গানের রেকর্ডিংও। কিন্তু শচীন দেববর্মণ উদাসীন। তাঁর মন জুড়ে শুধুই ইস্টবেঙ্গল।
প্রতি বছরই রোভার্স কাপের সময় বহির্জগৎ থেকে নিজেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে নিতেন সুরসম্রাট। সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে চলে আসতেন ইস্টবেঙ্গলের টিম হোটেলে। সেখান থেকেই ম্যাচ দেখতে যেতেন কুপারেজ স্টেডিয়ামে। ইস্টবেঙ্গল জিতলে ফুটবলারদের টিম হোটেলে পৌঁছে দিয়ে তবে বাড়ি ফিরতেন। যত দিন ইস্টবেঙ্গল দল বম্বেতে (তখনও মুম্বই হয়নি) থাকত, এটাই ছিল শচীনকর্তার রোজনামচা।
ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষে শচীনকর্তার নানা কাণ্ড মনে পড়ে যাচ্ছে ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন তারকাদের। কিংবদন্তি সুরকারের ফুটবলপ্রেমের কথা সুরজিৎ সেনগুপ্ত প্রথম জানতে পেরেছিলেন ১৯৭১ সালে রোভার্স কাপ খেলতে গিয়ে। তাঁর কথায়, ‘‘আমি তখন খিদিরপুর ক্লাবের হয়ে রোভার্স কাপে খেলতে গিয়েছি। এক দিন কুপারেজ স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতে গিয়ে ভিআইপি গ্যালারিতে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম। সেই সময় চেয়ারে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম লেখা থাকত। আমি দেখলাম, দু’টো চেয়ারে লেখা রয়েছে শচীন দেববর্মণের নাম। ভাবলাম, হয়তো ছেলের রাহুলের জন্য আরও একটা চেয়ার বুক করে রেখেছেন। মাঠেই এক জনকে জিজ্ঞেস করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে হেসে বললেন, দু’টোই শচীন দেববর্মণের চেয়ার। একটায় উনি বসেন। আর একটায় পা রাখেন খেলা দেখার সময়ে।’’
তিন বছর পরে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে রোভার্স কাপে খেলতে গিয়ে শচীনকর্তার সঙ্গে আলাপ সুরজিতের। সেই বছরেই মুক্তি পেয়েছে ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘প্রেম নগর’-এর মতো ছবি। তার আগের বছরে ‘অভিমান’। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী— শচীনকর্তার সুরের মূর্ছনায় মজে। ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারেরাও সবাই তাঁর গানের ভক্ত। সুরজিৎ শোনালেন কিংবদন্তি সুরকারের সঙ্গে তাঁর আলাপ হওয়ার আশ্চর্য কাহিনি, ‘‘তখন ইস্টবেঙ্গলের কোচ ছিলেন প্রদীপদা (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়)। ম্যাচের দিন সকালে হঠাৎ সবাইকে ডেকে পাঠালেন নিজের ঘরে। কী ব্যাপার, প্রদীপদা কি টিম মিটিং করবেন? ওঁর রুমে গিয়ে দেখলাম, শচীন দেববর্মণ বসে আছেন। উনি আসলে দেখতে চাইতেন, আমরা ফিট কি না। ম্যাচের আগে কার্যত ফিটনেস টেস্ট দিতে হত শচীনকর্তার কাছে।’’ এখানেই শেষ নয়। সুরজিৎ যোগ করলেন, ‘‘আমরা মাঠে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে হোটেল থেকে বেরোনোর সময় দেখলাম, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শচীনকর্তা। পাশে প্রদীপদা। প্রত্যেকের পিঠে এক বার আলতো চাপড় দিতেন। কেউ যদি একটু এগিয়ে যেত, তাঁকে আবার পিছিয়ে আসতে হত। ওঁর সংস্কার ছিল, প্রত্যেকের পিঠ চাপড়ে দেওয়া।’’ সুরজিৎই জানালেন, রোভার্স কাপের সময় গান রেকর্ডিং বন্ধ রাখতেন। বললেন, ‘‘এক বার মাঠ সমস্যার জন্য প্রায় এক মাস পিছিয়ে গিয়েছিল রোভার্স কাপ। প্রযোজক-পরিচালকদের তো মাথায় হাত। যত দিন ইস্টবেঙ্গল খেলবে, শচীন দেববর্মণকে পাওয়া যাবে না।’’
সমরেশ চৌধুরীর অভিজ্ঞতাও কম আকর্ষক নয়। বললেন, ‘‘প্রতিদিনই প্রাতরাশের পরে প্রদীপদা আমাদের ক্লাস নিতেন। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ। বিরক্ত হলেন প্রদীপদা। আমাকে বললেন, দেখো তো, কে এল এই সময়! আমি দরজা খুলে তো অবাক। ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শচীন দেববর্মণ। উত্তেজনায় বাঙাল ভাষাতেই চিৎকার করে উঠলাম, শচীনকর্তা আইসে তো। প্রদীপদাও লাফিয়ে উঠে ওঁকে ভিতরে ডেকে নিয়ে এলেন। কিন্তু ক্লাস পণ্ড হয়ে যাচ্ছে দেখে প্রদীপদা আমাকে বললেন, শচীনকর্তাকে তোমার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও।’’ সমরেশ যোগ করলেন, ‘‘সে-বছর স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রদীপদা বললেন, শচীনকর্তাকে তোমার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও। ক্লাস শেষ করে আমরা সবাই যাব দেখা করতে। আমার স্ত্রী তো দারুণ খুশি। সবাই আমার ঘরে এসে শচীনকর্তার সঙ্গে দেখা করে গেল। কিন্তু তার পরেও উনি ছিলেন। মধ্যাহ্নভোজ সেরে আমার ঘরেই বিকেল ৪টে পর্যন্ত বিশ্রাম নিলেন।’’
ইস্টবেঙ্গলের প্রতি এতটাই দুর্বলতা ছিল যে, ছেলে রাহুল দেববর্মণকেও ভর্ৎসনা করতে ছাড়েননি কিংবদন্তি সুরকার। সেই ঘটনা মনে পড়লে এখনও হাসেন সুরজিৎ। বললেন, ‘‘ম্যাচের দিন হোটেল থেকে নিজের গাড়িতে করেই ফুটবলারদের কুপারেজ স্টেডিয়ামে নিয়ে যেতেন শচীনকর্তা। সে-দিন পঞ্চমও (রাহুল) এসেছিল। ওঁর গাড়িতেও কয়েক জন উঠেছিল। সবাই গাড়িতে উঠে পড়েছে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে প্রদীপদাকে বললেন, চলো এ বার আমরাও রওনা হই। সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চমের গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে বেরিয়ে গেল। থমথমে হয়ে গেল শচীনকর্তার মুখ।’’ ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা বল প্লেয়ার হাসতে হাসতে যোগ করলেন, ‘‘শচীনকর্তা বাঙাল ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ওই গাধাটার গাড়িতে কে কে আছে? প্রদীপদা বললেন, সুধীরেরা আছে। শুনে তখনই বললেন, এর পর থেকে যেন আর কেউ যেন ওর গাড়িতে না-ওঠে।’’
রাহুল দেববর্মণের গাড়িতে সে-দিনের সওয়ারি সুধীর কর্মকার অবশ্য অনেক পরে শুনেছিলেন এই কাহিনি। তিনি বললেন, ‘‘রোভার্স কাপে ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলেই মাঠে আসতেন। বাড়িতে আমাদের নিমন্ত্রণ করতেন। অবশ্য আমরাই মুখিয়ে থাকতাম ওঁর বাড়ি যাওয়ার জন্য। পঞ্চমের সঙ্গেও দেখা হয়ে যেত। আমাদের গানের রেকর্ড উপহার দিয়েছিলেন শচীনকর্তা। অসাধারণ মানুষ ছিলেন। সঙ্গীত আর ইস্টবেঙ্গল ছিল ওঁর জীবন জুড়ে। রাহুলেরও একই রকম ইস্টবেঙ্গল-প্রেম ছিল।’’
ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের আবহে ভারতীয় ফুটবলের আর এক কিংবদন্তি গৌতম সরকারেরও মনে পড়ে যাচ্ছে শচীন দেববর্মণের নানা কাহিনি। বললেন, ‘‘শচীনকর্তা আমাকে আর সুধীরকে খুব ভালবাসতেন। এক দিন আমাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। গাড়ি থেকে নেমেই আমার আর সুধীরের কাঁধে হাত রেখে বসার ঘরে ঢুকলেন। ভিতরে তখন শচীনকর্তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন নবাব মনসুর আলি খান পটৌডী, শর্মিলা ঠাকুর, রাকেশ রোশন। আর কারা ছিলেন, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ভিতরে ঢুকেই বললেন, কারা আইসে দ্যাখো তোমরা। আমরা তো স্তম্ভিত।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘আমাদের জন্য মহম্মদ রফি, কিশোরকুমার, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলেদের রেকর্ডিং বন্ধ করে দিতেও দু’বার ভাবেননি। আমরা একসঙ্গে কত বার চা খেয়েছি। শুধু তা-ই নয়। কিশোর, রফিরা আমাদের দিকে কাজুবাদামের প্লেটও এগিয়ে দিয়েছেন বহু বার। ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলে সব কাজ বাতিল করে দিতেন। যে-সম্মান আমরা পেয়েছি, তা কখনও ভুলতে পারব না।’’
দর্শকের ভিড়ে গ্যালারিতে কখনওই খুব একটা উচ্ছ্বাস দেখাতেন না শচীন দেববর্মণ। কিন্তু প্রিয় দল হারছে দেখলে খেলা শেষ হওয়ার আগেই স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেন। জিতলে ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের জন্য অপেক্ষা করতেন। সবাইকে টিম হোটেলে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরতেন। এমনই ছিল ইস্টবেঙ্গলের প্রতি শচীনকর্তার ভালবাসা।
অনুলিখন: শুভজিৎ মজুমদার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy