স্মরণীয়: কলকাতা ময়দানে আজও ফুটবলপ্রেমীর মুখে মুখে ফেরে সত্তর দশকে শ্যাম থাপার সেই অনবদ্য ব্যাকভলি। ফাইল চিত্র
ডার্বি! গত তিপান্ন-চুয়ান্ন বছর ধরে এই শব্দটার সঙ্গে আমি পরিচিত। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ মানেই আমার কাছে আবেগের বিস্ফোরণ।
আমি মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল—দুই বড় ক্লাবের হয়েই এই সম্মানের যুদ্ধে গোল করে দলকে জিতিয়েছি। কখনও ইডেন থেকে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে ফিরেছি সমর্থকদের কাঁধে চেপে। কখনও বা সবুজ-মেরুন সমর্থক জড়িয়ে ধরে তাঁর মুখটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ‘‘মারুন এই মুখে থাপ্পড়। ইস্টবেঙ্গলে আপনি খেলার সময় প্রচুর গালমন্দ করেছি। আজ আমার প্রায়শ্চিত্তের দিন।’’ বলেই কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে। মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, বাঙালি না হয়েও বাঙালির এ রকম নিখাদ ভালবাসা আমি মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ডার্বিতে না খেললে কোথায় পেতাম? এই ডার্বি ম্যাচের আকর্ষণ কোনও দিন ফিকে হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা যখন নিজেদের সেরা সময়ে এই ম্যাচটা খেলেছি, তখন পৃথিবীটা অন্য রকম ছিল। এখন সেই পৃথিবী অনেক বদলে গিয়েছে। কিন্তু ডার্বি ম্যাচের আকর্ষণ এখনও একই রকম রয়েছে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ডার্বির আমেজ কখনও নষ্ট হতে পারে না।
ডার্বি ম্যাচে আমার প্রথম গোল ১৯৭০ সালে। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে কলকাতা লিগে। বল বুকে রিসিভ করে জোরালো ভলিতে কলকাতা লিগের ম্যাচে গোল করেছিলাম আমি। কিন্তু দুঃখের বিষয় ম্যাচটা দ্বিতীয়ার্ধে প্রবল বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়েছিল। রেফারি পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করে দেন। তবে সেই দুঃখের মাঝেও একটা সুখবর বয়ে এনেছিল এই ম্যাচ। কারণ এই গোলটার জন্যই আমি ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যাই। তার পরে আমি মুম্বই চলে গিয়েছিলাম তিন বছরের জন্য। খেলতাম মফতলালের হয়ে।
যাক সে কথা, ফিরে আসি সেই ১৯৭৫ সালে। সে বার মরসুমের শুরুতে প্রয়াত শান্তদা (মিত্র) আমাকে ফোন করেছিলেন মুম্বইয়ে। বলেন, ‘‘হাবিব-আকবর দল ছেড়ে চলে গিয়েছে মহমেডানে। এ বার লিগ জিতলে মহমেডানের টানা পাঁচবার লিগ জয়ের রেকর্ড ভাঙতে পারব। তুমি ইস্টবেঙ্গলে চলে এসো।’’ ওঁর অনুরোধেই মুম্বইয়ে চাকরি ছেড়ে চলে এসেছিলাম ইস্টবেঙ্গলে রেকর্ড করার জন্য। বলতে দ্বিধা নেই আমার কেরিয়ারের সেরা বছর সেই ১৯৭৫।
সে বার আমাদের কোচ প্রদীপদা জ্বালাময়ী সব কথাবার্তা (বন্দ্যোপাধ্যায়) বলতেন। আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘‘রেকর্ড গড়তে না পারলে তোমাকে সমর্থকরা গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে দেবে। দেখিয়ে দাও হাবিব-আকবর চলে গেলেও ইস্টবেঙ্গলের সমস্যা হয় না।’’
পঁচাত্তরের সেই আইএফএ শিল্ড ফাইনালে আমি জোড়া গোল করেছিলাম। কিন্তু আমার ডার্বি ম্যাচে সেরা গোল ওই ম্যাচে নয়। সেরা গোল পঁচাত্তরের লিগে। মাঝমাঠে থ্রো-ইন থেকে বল ধরে সুব্রত ভট্টাচার্য-সহ মোহনবাগানের চার ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোল করে এসেছিলাম। জল-কাদা ভরা সেই মাঠে আমাকে ধরতেই পারেনি মোহনবাগান রক্ষণ। সেই ম্যাচ আমার গোলেই জিতে ফিরেছিল ইস্টবেঙ্গল। ওটাই আমার জীবনের সেরা গোল। আক্ষেপ সেই ম্যাচ টিভিতে দেখায়নি। তাই এই ম্যাচের কোনও ভিডিয়ো নেই। যাঁরা এই ম্যাচটা দেখেছিলেন, তাঁরা আজও বলেন, গোলটা অনেকটা ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার গোলটার মতো। গোলটার পরেই ক্লান্ত হয়ে মাঠের মধ্যে বসেই সতীর্থদের অভিনন্দন গ্রহণ করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম বুকের উপর থপ্ করে কী একটা পড়ল। ভাল করে দেখলাম, সেটা একটা বিশাল ইলিশ মাছ। তার পরেই দেখলাম, এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক মাছটা নিয়ে মাঠে দৌড়ে ঢুকে পড়েছেন। তাঁর পিছনে ১০-১২জন পুলিশ। দেখলাম, সেই সমর্থক বলছেন, ‘‘এই ইলিশটা তোমার।’’ এগিয়ে গিয়ে আগে পুলিশের হাত থেকে সেই ইস্টবেঙ্গল সমর্থককে উদ্ধার করে নিরাপদে গ্যালারিতে পাঠালাম। তার পরে পুলিশকেই ওই ইলিশ মাছ দিয়ে ফের মাঠে নেমে পড়লাম। এই বয়সে এসে আজও ওই সমর্থককে খুঁজছি। এই লেখা তিনি যদি পড়েন, তা হলে দয়া করে যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই ম্যাচের পরেই সমর্থকদের ঘাড়ে চেপে বৃষ্টির মধ্যে ইডেন থেকে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে ফিরেছিলাম।
এ বার আসি পাঁচ গোলের সেই ম্যাচে। ম্যাচের আগে প্রদীপদা দুরন্ত ‘ভোকাল টনিক’ দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন। ওই ম্যাচে পেনাল্টি নষ্ট করার পরে সুব্রত ভট্টাচার্য আমাকে অনেক কিছু বলছিল। ওতেই আমার রাগ চড়ে গিয়েছিল। বলেছিলাম, আজ তোদের গোলের মালা পরাব। তার আগে পাঁচ মিনিটেই প্রথমে গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দিয়েছে সুরজিৎ সেনগুপ্ত। তার পরে আমি। ২৪ মিনিটে সুভাষ ভৌমিকের ক্রস থেকে আমার গোল। ৩৮ মিনিটে রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়ের গোল। আমি, সুভাষ আর সুরজিৎ সেনগুপ্ত মাঝমাঠে নিজেদের মধ্যে বল দেওয়া নেওয়া করছিলাম। সেই ফাঁকে মোহনবাগান বক্সের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল র়ঞ্জিত মুখোপাধ্যায়। সেই বল ধরে মোহনবাগান ডিফেন্ডার নিমাই গোস্বামীকে কাটিয়ে জোরালো শটে ৩-০ করে রঞ্জিত। এই তিন গোলের পরেই মোহনবাগান রক্ষণ কার্যত ভেঙে পড়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে সুরজিৎ সেনগুপ্ত ফের গোল লক্ষ করে শট নিয়েছিল। সেই শট ‘রিবাউন্ড’ হলে ফাঁকা গোলে বল ঠেলে দিই আমি। ম্যাচের একদম শেষ লগ্নে ৫-০ করে শুভঙ্কর সান্যাল।
আমার জীবনের সেরা ডার্বি ম্যাচ হিসেবে আমি তিনটে ম্যাচকে রাখি। তার মধ্যে পঁচাত্তরের পাঁচ গোলের কথা মনে হলেই বেদনা ভর করে। ডার্বির ওই সেরা ম্যাচটায় ইস্টবেঙ্গলের পাঁচ গোলের মধ্যে দু’টো গোলই ছিল আমার। সেই ম্যাচে আমি পেনাল্টি নষ্ট করেছিলাম। তাই ম্যাচের পরে আনন্দের মাঝেও বড় ম্যাচে হ্যাটট্রিক করতে না পারার একটা দুঃখ যেমন ছিল, তেমনই সে দিন বর্ষীয়ান মোহনবাগান সমর্থকদের আমি অনেককেই দেখেছিলাম কাঁদতে। যাঁদের অনেকেই আমার পিতৃসম ব্যক্তিত্ব। ম্যাচের পরে যা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ধাক্কাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল পরদিনের খবরের কাগজ পড়ে। উত্তর কলকাতায় উমাকান্ত পালোধি বলে এক মোহনবাগান সমর্থক আত্মহত্যা করেছিলেন প্রিয় দলের পরাজয়ে। সেই খবর পড়ে আনন্দের মাঝেই মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে নিজেকে বলেছিলাম, কোনও দিন মোহনবাগানে খেলার সুযোগ আসে, তা হলে এ রকম দুর্দান্ত খেলেই ওঁদের খুশি করার চেষ্টা করব। যে সুযোগ ঈশ্বর আমাকে দিয়েছিলেন পরবর্তী কালে।
অভিনন্দন: বড় ম্যাচে জয়ের পরে শ্যাম থাপাকে চুম্বন কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ফাইল চিত্র
১৯৭৭ সালে এলাম মোহনবাগানে। মোহনবাগান জার্সিতে সে বার শিল্ডে আমি গোল করে মোহনবাগানকে জিতিয়েছিলাম। আটাত্তরের লিগে ডার্বি ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে আমার সেই ব্যাকভলিতে গোল। মোহনবাগান জার্সি গায়ে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে এটাই আমার সেরা গোল। গোলটার সময় সুভাষ ভৌমিক বলটা বাড়িয়েছিল মহম্মদ হাবিবকে। ‘বড়ে মিয়াঁ’ হাবিব সেই বল হেড করে আমাকে যখন বাড়াচ্ছে, তখন ইস্টবেঙ্গল রক্ষণ আমার দিকে তেড়ে আসছে। তাই দেরি না করে শূন্যে শরীর ছুড়ে দিয়ে ব্যাকভলিতে গোলটা করি। সে বার পুজোর সময় হাওড়ার বিভিন্ন মণ্ডপে আমার ব্যাকভলি আলোকসজ্জায় চলে এসেছিল।
সে দিন গোলের পরে মোহনবাগান সমর্থকরা মিষ্টির হাঁড়ি আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রাতে বাড়ি ফিরে আমার মনে হয়েছিল, ইস্টবেঙ্গল জার্সি গায়ে বড় ম্যাচে গোল করে যে মোহনবাগান সমর্থকদের কাঁদিয়েছি, আজ তাঁদের মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম। সে দিন ম্যাচের পরে মোহনবাগান ক্লাবের সর্বময় কর্তা ধীরেন দে আমাকে বিশাল মিষ্টির হাঁড়ি উপহার দিয়েছিলেন। ওই ম্যাচের পরে যেখানে খেলতে যেতাম, সেখানেই লোকে ব্যাকভলি দেখতে চাইত।
ডার্বির বড় ব্যবধান
আইএফএ শিল্ড ফাইনাল ১৯৭৫: ইস্টবেঙ্গল ৫ মোহনবাগান ০
কলকাতা লিগ ১৯৩৬: ইস্টবেঙ্গল ৪ মোহনবাগান ০
রাজা মেমোরিয়াল শিল্ড ফাইনাল ১৯৩৭: মোহনবাগান ৪ ইস্টবেঙ্গল ০
কলকাতা লিগ ২০১৫: ইস্টবেঙ্গল ৪ মোহনবাগান ০
দ্বারভাঙা শিল্ড ১৯৩৪: মোহনবাগান ৪ ইস্টবেঙ্গল ১
কোচবিহার কাপ ১৯৪৭: মোহনবাগান ৪ ইস্টবেঙ্গল ১ (দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে প্রথম ডার্বি ম্যাচ ছিল)
ফেডারেশন কাপ ১৯৯৭: ইস্টবেঙ্গল ৪ মোহনবাগান ১
আইএফএ শিল্ড ২০০৫: ইস্টবেঙ্গল ৪ মোহনবাগান ১
আই লিগ ২০০৯-’১০: মোহনবাগান ৫ ইস্টবেঙ্গল ৩
(যদিও এই ম্যাচটি বড় ব্যবধান হিসেবে ধরা হয় না। তবে ডার্বির ইতিহাসে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এটিই। ৮ গোল)
আই লিগের বৃহত্তম ব্যবধান ২০০৯:
ইস্টবেঙ্গল ৩ (রহিম নবি ২, সুনীল ছেত্রী) মোহনবাগান ০
অনুলিখন: দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy