পরিসংখ্যানে পিছিয়ে থেকেও সর্বকালের সেরাদের মধ্যেই থাকবেন সেরিনা। ছবি: রয়টার্স
যে কোনও মুহূর্তে উপস্থিত হতে পারে অবসরের মহালগ্ন। সম্পূর্ণই ছিল আয়োজন। উইম্বলডন, টরন্টো, ওহিয়ো— পর পর তিনটি প্রতিযোগিতার প্রথম রাউন্ডেই বিদায়। পরাজিতের নাম সেরিনা উইলিয়ামস!
যতই তাঁর ঝুলিতে ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম থাক, স্বপ্নের সেই দৌড় থেমে গিয়েছে ২০১৭ সালেই। এক বছর টেনিস থেকে দূরে থাকা সেরিনা বিশ্ব ক্রমতালিকায় কোথায়? ৬০৫। পারবেন না কি জ্বলে উঠতে? প্রশ্ন, আশঙ্কা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা— পূর্ণ করে রেখেছিল আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামের সমস্ত দর্শকাসন। সামনে প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় বাছাই অ্যানেট কোন্টাভেইট। প্রথম সেটে তীব্র লড়াই। সেরিনা জিতলেন ৭-৬ ব্যবধানে। কিন্তু দ্বিতীয় সেটেই উড়ে গেলেন। হারলেন ২-৬। স্টেডিয়াম জুড়ে স্তব্ধতা। সকলেই যে এসেছেন সেরিনার খেলা দেখতে। যদি না আর এই সুযোগ পাওয়া যায়। কোচিং স্টাফরা বাদে কোন্টাভেইটের সমর্থক কোথায়? নেই। পেশাদারিত্বের আড়াল থেকে তাঁর কোচিং স্টাফদেরও নজর সেই সেরিনার দিকেই। তৃতীয় সেটের পরই কি শেষ হয়ে যাবে সর্বকালের অন্যতম সেরা মহিলা টেনিস খেলোয়াড়ের পথ? সেরিনার হাতে র্যাকেট। প্রথম রাউন্ডের ম্যাচেই পেয়ে গিয়েছিলেন হারানো আত্মবিশ্বাস। অতএব তৃতীয় সেট সেরিনার। ফল ৬-২।
পেশাদার টেনিসজীবনে সেরিনার শেষ জয়। খাতায় কলমে তো অঘটনই! ম্যাচের পর কোর্টেই সেরিনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এই ফলাফলে তুমি কি নিজেই অবাক হওনি? প্রশ্ন শুনে চুপ সেরিনা। শব্দহীন আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়াম। প্রশ্নের মোচড়ে কী লুকিয়ে? বিস্ময়, অবিশ্বাস, না উপহাস? কিছু ক্ষণ পর ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালকিনের সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, ‘‘আই অ্যাম জাস্ট সেরিনা ইউ নো।’’
অহঙ্কার না ঔদ্ধত্য? যাই হোক, অবসরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সেরিনার মুখে বোধ হয় কোনওটাই বেমানান নয়। এই সেরিনাই তো মিলান ফ্যাশন শোয়ের মঞ্চে উঠেছিলেন নিজের সংস্থার তৈরি কালো গরমের পোশাক পরে। ইংরাজি হরফে যাতে লেখা ছিল, ‘জি ও এ টি’। অর্থাৎ, ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’। সেরিনাই কি সর্বকালের সেরা?
এই প্রশ্নে স্ট্রেট সেটে জয়ের সুযোগ নেই। মার্গারেট কোর্ট, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, ক্রিস এভার্ট, স্টেফি গ্রাফদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তাঁকে। অনেকেই বলেন এক প্রজন্মের সঙ্গে অন্য প্রজন্মের তুলনা করা যায় না। খেলার ধরন, নিয়ম বদলে যায়। সেরিনা নিজেও এটাই বিশ্বাস করেন। এক বার বলেছিলেন, ‘‘এক প্রজন্মের সঙ্গে অন্য প্রজন্মের তুলনা করা কঠিন। অনেক কিছুই বদলে যায়। শক্তি, টেকনিক, প্রযুক্তি কিছুই এক থাকে না।’’
গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের বিচারে কোর্টের ২৪টির রেকর্ড ছোঁয়া হল না সেরিনার। তা নিয়ে আক্ষেপ নেই তাঁর। দ্বিতীয় স্থানেই সন্তুষ্ট তিনি। বরং বলেছেন, ‘‘কোর্টের সাফল্য ওপেন যুগে নয়।’’ সেরিনা এমন দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ অনেক কিছুতেই! মহিলাদের টেনিসকে বদলে দিয়েও পরিসংখ্যানের প্রতিযোগিতায় খানিক পিছিয়ে রয়েছেন। নাভ্রাতিলোভা এক বার বলেছিলেন, ‘‘এখন গ্র্যান্ড স্ল্যাম অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতটা গুরুত্বপূর্ণ কখনই ছিল না।’’ রড লেভার টেনিস কিংবদন্তি হিসাবেই সমাদৃত। খেলোয়াড়জীবনে ১১টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা অস্ট্রেলিয় বলেছিলেন, ‘‘সংখ্যায় কী যায় আসে! কতগুলো গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছি, মনে রাখি না। গুনে দেখিনি কখনও।’’ সংখ্যা নিয়ে ক্রীড়াবিদরা মাথা ঘামান না। তবু পরিসংখ্যানে সংখ্যা অপরিহার্য। যে সংখ্যায় বিচার হয় ভবিষ্যতের। যে ভবিষ্যতে থাকে না বর্তমানের বাক্রুদ্ধতা, মুগ্ধতা। টেনিস খেলোয়াড়রা চোট বা অন্য সমস্যা ছাড়া নিজেদের গ্র্যান্ড স্ল্যামের বাইরে রাখতে চান না। নাভ্রাতিলোভা, এভার্ট কোনও কারণ ছাড়াই একাধিক গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলেননি। তাতে তাঁরা খোলোয়াড় হিসাবে এক চুলও পিছিয়ে পড়েননি।
বিশ্বের এক নম্বর হিসাবে সেরিনা ছিলেন মোট ৩১৯ সপ্তাহ। গ্রাফ ছিলেন সর্বোচ্চ ৩৭৭ সপ্তাহ। নাভ্রাতিলোভা ছিলেন ৩৩২ সপ্তাহ। সেরিনা তৃতীয়। সব মিলিয়ে সেরিনার সিঙ্গলস খেতাবের সংখ্যা ৭৩। ডাবলস খেতাব ২৩টি। নাভ্রাতিলোভা সিঙ্গলস খেতাব জিতেছিলেন ১৬৭টি। ডাবলস আরও ১৭৭টি। ১৮টি সিঙ্গলস গ্র্যান্ড স্ল্যাম-সহ তাঁর মোট গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাবের সংখ্যা ৫৯। ১৮টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম-সহ এভার্টের সিঙ্গলস খেতাব ১৫৭টি। ৩০ বছরে অবসর নেওয়া গ্রাফের সিঙ্গলস খেতাব ১০৭। তাঁর গ্র্যান্ড স্ল্যাম ২২টি। প্রতিটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম চার বার করে জেতার কৃতিত্ব রয়েছে। মোট জয়ের নিরিখে এঁদের থেকে অনেক পিছনে সেরিনা। গ্রাফ ৮৯ শতাংশ সিঙ্গলস ম্যাচে জয় পেয়েছেন। সেরিনা জিতেছেন ৮৫ শতাংশ সিঙ্গলস ম্যাচ। ১৯৮৪ সালে গ্রাফ চারটি গ্ল্যান্ড স্ল্যামের সঙ্গে অলিম্পিক্স সোনাও জিতেছিলেন। টেনিস বিশ্বে তিনিই এক মাত্র, যাঁর ক্যালেন্ডার গোল্ডেন স্ল্যাম রয়েছে। নাভ্রাতিলোভা ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত টানা ছ’টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন। সেরিনা ২০০২ থেকে ২০০৩ এবং ২০১৪ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দু’বার টানা চারটি করে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন।
আমেরিকার টেনিস ঐতিহাসিক স্টিভ ফ্লিঙ্ক বলেছেন, ‘‘সেরা সময়ের কোর্ট, নাভ্রাতিলোভা, গ্রাফদের সামলাতে হয়েছে প্রায় সম শক্তির একাধিক প্রতিপক্ষকে। সেরা সময়ের সেরিনার সামনে তেমন কেউই ছিল না।’’ এক মাত্র মারিয়া শারাপোভা উঠে এসেছিলেন সেরিনার সেরা সময়ের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে। তাঁর বিরুদ্ধেও সেরিনার জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যান ২০-২! প্রথম দিকে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন দিদি ভিনাস উইলিয়ামস। নিজের সেরা সময়ে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও বোনের সমকক্ষ হতে পারেননি। আবার সেরিনার মতো প্রতিপক্ষের বুকে ভয় ধরাতে পারেননি কেউই। এমন দাপট ছিল না কারও। সময়ের থেকে এগিয়ে থেকে টেনিস খেলতে পারেননি কেউ। মহিলাদের টেনিসের সংজ্ঞা বদলে দিতে পারেননি কেউ।
প্রতি পদে নিজেকে প্রমাণ করতে করতে এগোতে হয়েছে সেরিনাকে। একাধিক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের পরেও টেনিস বিশ্বের একটা অংশ তাঁর দক্ষতা এবং যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলত। হয়তো তাঁর গায়ের রং সাদা নয় বলেই। হয়তো তাঁর পাওয়ার টেনিসকে ভয় পেয়ে বা হিংসা করে। সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরেও প্রতিটি গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে উঠেছেন সেরিনা। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি।
তাঁর বাবা রিচার্ড উইলিয়ামসকে গায়ের রং নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছিল এক বার। রাগে এবং প্রতিবাদে টানা ১৪ বছর ইন্ডিয়ান ওয়েলস ওপেন খেলেননি। গায়ের রং কালো হওয়ায় খুন হয়েছিলেন সেরিনার সৎবোন ইয়েতুন্ডে প্রাইস। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ। ২০১১ সালে ফুসফুসে রক্ত জমাট বেধে যাওয়ার গুরুতর অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই— সব কিছুই সামলাতে হয়েছে তাঁকে। কোর্টের ভিতর সেরিনা যত মসৃণ, ততটা মসৃণ নয় ব্যক্তি সেরিনার জীবন। এই সব নিয়েই এগিয়েছেন। জেদ বেড়েছে। লড়াই করেছেন। প্রতিটি অপমানের জবাব দিয়েছে তাঁর র্যাকেট।
সেরিনা এক বার বলেছিলেন, ‘‘আমি যে ম্যাচগুলো জিতেছি, সেগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় আমি ক্ষুব্ধ ছিলাম। নয়তো আমাকে হিসাবের মধ্যে ধরাই হয়নি।’’
শুধু টেনিস খেলোয়াড়রাই নয়, মহম্মদ আলি, টাইগার উডস, পেলে এমন অনেক নামই উঠে আসবে সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদদের তালিকায়। এঁদের কারও কৃতিত্ব কম নয়। তাঁদের সঙ্গেই রয়েছেন সেরিনা। তিনিই সর্বকালের সেরা কি না, তা নিয়ে চায়ের টেবিলে তুফান উঠতে পারে। তুলনা পছন্দ নয় সেরিনার। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের পরিচয়েই বাঁচতে চান। বাঁচবেন না-ই বা কেন? তাঁর পরিচয়েই তো অসংখ্য মানুষ বাঁচার রসদ খুঁজে পান। তাঁরা সকলেই কালো নন। আমেরিকার নাগরিক। টেনিসবিশ্বের বাসিন্দা।
ইউএস ওপেন খেলার সময় সেরিনা নিজেই বলেছেন, ‘‘গ্যালারিতে উডসের উপস্থিতি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।’’ টেনিসজীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সেরিনাও অনুপ্রেরণা খোঁজেন। আরও ভাল খেলার জন্য নিজেকে উদ্বুদ্ধ করেন। নিজেকে শেষ বারের মতো প্রমাণ করতে চান। কে কী বলল, তা নিয়ে সময় নষ্ট করতে রাজি নন। তাই অবলীলায় বলতে পারেন, ‘‘আই অ্যাম জাস্ট সেরিনা ইউ নো।’’ যিনি একাধিক প্রজন্মকে নিজের প্রতিপক্ষ করে নিয়েছেন! বাকিটা আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন মিলানের মঞ্চে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy