Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
ওয়ার্ন দ্বৈরথে জিতিয়েছিল প্রস্তুতিই

এক্সক্লুসিভ সচিন তেন্ডুলকর: ব্যাট বলকে আঘাত করার সুন্দর শব্দটাই তো ছিল সেরা বার্তা

প্র্যাক্টিস ম্যাচটায় খেলে আমি ডাবল সেঞ্চুরি করলাম। দিনের শেষে বন্ধুরা এসে আমাকে অভিনন্দন জানাতে থাকল। সকলে খুব উচ্ছ্বসিত। আমি ওদের বললাম, তোমরা কেউ একটা জিনিস খেয়ালই করোনি। ওয়ার্ন একটা বলও রাউন্ড দ্য উইকেট করেনি। ওটাই ওর ব্রহ্মাস্ত্র।

উপলব্ধি: ব্যক্তিগত রেকর্ড নয়, ক্রিকেটের প্রতি তীব্র ভালবাসা থেকেই বাইশ গজের প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপভোগ করেছেন সচিন তেন্ডুলকর। ফাইল চিত্র

উপলব্ধি: ব্যক্তিগত রেকর্ড নয়, ক্রিকেটের প্রতি তীব্র ভালবাসা থেকেই বাইশ গজের প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপভোগ করেছেন সচিন তেন্ডুলকর। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ
মুম্বই শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৯ ০৪:০৪
Share: Save:

তাঁর কাছে আগ্রাসনের অর্থ কী? কেন নিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া শত সেঞ্চুরির পরেও? কেপ টাউন টেস্টে ৫৭ মিনিট সিঙ্গলস না-নিয়ে জুটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যশপ্রীত বুমরাকে প্রথম দেখে কী মনে হয়েছিল? শেন ওয়ার্নের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি করেও কেন নিশ্চিত হতে পারেননি। কিংবদন্তির পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অজানা, চাঞ্চল্যকর সেই সব কাহিনি। অবসরের পরে এই প্রথম এত অন্তরঙ্গ, খোলামেলা ভঙ্গিতে সচিন তেন্ডুলকর। বান্দ্রায় নিজের বাড়িতে বসে আনন্দবাজারকে দেওয়া দেড় ঘণ্টার দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকারে মুখ খুললেন নানা বিষয় নিয়ে। যেন এক অনাবিষ্কৃত সচিন। সাক্ষাৎকারের আজ দ্বিতীয় পর্ব...

প্রশ্ন: যশপ্রীত বুমরার উত্থান দেখেছেন কাছ থেকে। কী বলবেন? প্রথম দেখে কী মনে হয়েছিল?

সচিন তেন্ডুলকর: প্রথম দেখে আমার মনে হয়েছিল, এই ছেলেটার বোলিং অ্যাকশনটা অদ্ভুত রকমের। সহজে যেটা ধরা যায় না। এবং, সেটাই ওর বড় শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমার মনে হয়েছিল, ওই রকম অ্যাকশনের জন্য ব্যাটসম্যানেরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে কয়েক সেকেন্ড দেরি করে। ব্যাটিংয়ে ওই কয়েকটি সেকেন্ডই অনেক দেরি হয়ে দাঁড়াতে পারে। বুমরার অ্যাকশন তাই ওকে সুবিধে করে দেবে। এমনিতেই ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে ব্যাটসম্যানের প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়টা খুব কম। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হয়। তার পরে যদি অন্য রকম অ্যাকশনের জন্য সেই সময়টুকুও কমে যায়, ব্যাটসম্যানদের সর্বনাশ। আরও চাপে পড়ে যেতে বাধ্য ব্যাটসম্যানেরা।

প্রশ্ন: বুমরার অগ্রগতি দেখে কী বলবেন?

সচিন: অসাধারণ! সব দিক দিয়েই উন্নতি করেছে। গতি বাড়িয়েছে। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছে। অভিজ্ঞতা আসায় চতুর হয়েছে। বুমরার একটা জিনিস দেখে আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম। দ্রুত শিখে নিতে পারে। আর একটা দিক হচ্ছে, খুব ঠান্ডা মস্তিষ্ক। অথচ বুমরা কিন্তু ভিতরে-ভিতরে খুবই আক্রমণাত্মক। ওকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, খুবই আক্রমণাত্মক মানসিকতার বোলার। সেটা কখনও দেখাতে চায় না। হাতে থাকা বলকেই কথা বলতে দেয় ও। ব্যাটসম্যানদের দিকে তেড়ে যায় না বুমরা। মুখে কোনও কথাও বলে না। কিন্তু চরিত্রগত দিক থেকে ভীষণ ভাবেই নাছোড় এক প্রতিদ্বন্দ্বী। খেলোয়াড় তো এ-রকমই হবে!

প্রশ্ন: আর কিছু মনে পড়ছে বুমরার শুরুর দিন থেকে?

সচিন: আমার মনে আছে, একেবারে শুরুতে আমাকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, বুমরাকে নিয়ে আপনার কী মনে হচ্ছে? আমি তখনই বলেছিলাম, এক দিন বিশ্বের সেরা বোলার হবে। আজ কিন্তু বিশ্বের সেরা বোলারই হয়েছে বুমরা। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তো বটেই, টেস্টেও অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছে। চোখের সামনে এক জন তরুণ প্রতিভা থেকে বিশ্বের সেরা বোলারে রূপান্তরিত হতে দেখলাম ওকে। এবং, আমি বলব, পুরো যাত্রাটা দারুণ ভাবে সামলেছে ও। কী অসাধারণ একটা কাহিনি! কত কিছু শেখার আছে বুমরার জয়যাত্রা থেকে!

প্রশ্ন: শান্ত হয়ে বুমরার আক্রমণাত্মক চরিত্রের কথা বললেন। আপনার মতে খেলার মাঠে ‘আগ্রাসনের’ ব্যাখ্যাটা আসলে কী? এমন এক জনকে এই প্রশ্নটা করছি, যিনি একশোটা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করেছেন। কিন্তু যাঁর মধ্যে বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি।

সচিন: আমার কাছে আগ্রাসনের প্রথম শর্ত হচ্ছে, সেটা এমন একটা জিনিস, যা নিজের খেলাকে আরও তীব্র করে তুলবে। আমার আগ্রাসন যেন আমার প্রতিপক্ষের অস্ত্র না হয়ে দাঁড়ায়। কখনও আগ্রাসন দেখাতে হয়, কখনও চেপে রাখতে হয়। আমি নিজে সব সময় বিশ্বাস করেছি, নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন সেরাটা বার করে আনতে সাহায্য করে। আমার কখনও মনে হয়নি, মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে মুখে কাউকে কিছু বলা দরকার । হাতে ধরা ব্যাটই তো আমার হয়ে কথা বলবে। আমার কাছে সেরা শব্দ ছিল ব্যাট যখন বলকে আঘাত করত। আমার মনে হত, প্রতিপক্ষকে নিয়ে আমার কী ধারণা, সেটা মুখে বলার দরকার নেই। ওই যে ব্যাটটা গিয়ে ওদের করা বলটায় আঘাত করল আর শব্দটা হল, সেটাই আমার গলার আওয়াজ। সেটাই প্রতিপক্ষের প্রতি আমার বার্তা। শত কথা বলেও সেই শব্দের প্রভাবকে ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মুখে কিছু বলার দরকারই তো নেই। আমি এ ভাবেই ক্রিকেট খেলতাম। এটাই ছিল আমার ভাবনা। এক নিঃশ্বাসে এটাও বলতে চাই যে, প্রত্যেক ব্যক্তির মনের ভাব প্রকাশ করার ভঙ্গি আলাদা। কখনওই বলব না, আমার রাস্তাটাই একমাত্র রাস্তা। কখনওই কাউকে পরামর্শ দেব না, তোমার স্বভাবসিদ্ধ আগ্রাসন ছেঁটে ফেলো। যদি তোমাকে তা ভাল খেলতে উদ্বুদ্ধ করে, চলুক না! শুধু দেখতে হবে, যেন সীমানা অতিক্রম করে না-ফেলি।

বুমরাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন সচিন

প্রশ্ন: বিস্ময়-বালক থেকে দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ। ব্যাটিংয়ের সব রেকর্ডই কার্যত আপনার দখলে। ফিরে তাকিয়ে দেখলে কী অনুভূতি হয়?

সচিন: একটা কথা বলে দিই। আমি ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলাম রেকর্ড তৈরি করব বলে নয়। শুরু করেছিলাম খুব প্রাথমিক একটা অনুভূতির কারণে। কী জানেন, ক্রিকেট মাঠে দাঁড়িয়ে জীবনের সেরা আনন্দটা পেতাম। আমার মনে হত, পৃথিবীটা ক্রিকেট মাঠেই সব চেয়ে সুন্দর আর আমার জন্য এটাই সর্বোত্তম জায়গা। চলার পথে আমি রেকর্ড তৈরি করেছি। তা সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে কখনও নামিনি। এখনকার দিনে অনেক বেশি তথ্য-সচেতনতা এসে গিয়েছে। ডিজিটাল দুনিয়ায় সব কিছু হাতের মুঠোয়। মোবাইলে টাইপ করুন আর তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে সমস্ত পরিসংখ্যান ভেসে উঠবে। তাই রোজই দেখা যাচ্ছে, কোনও না কোনও নতুন রেকর্ড গড়া হচ্ছে। আমাদের সময়ে এ-রকম ডিজিটাল বিপ্লব ঘটেনি। তাই খেলতে খেলতে অত জানাও সম্ভব হত না, কোন রেকর্ড অপেক্ষা করে রয়েছে। এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে যে, পৃথিবীটা অন্য রকম ছিল। আমরা অনেক বেশি খেলা উপভোগ করতে পেরেছি বোধ হয়। আবার বলব, ক্রিকেটকে পাগলের মতো ভালবেসেছিলাম বলেই খেলতে ছুটতাম। কি কিশোর হিসেবে, কি ভারতের হয়ে খেলার সময়! ক্রিকেটের পিছনেই ছুটেছি, রেকর্ডের পিছনে নয়।

প্রশ্ন: এখনকার ক্রিকেটে চার মহারথীকে নিয়ে খুব আলোচনা হয়। বিরাট কোহালি, স্টিভ স্মিথ, কেন উইলিয়ামসন এবং জো রুট। যাঁদের বলা হয় ‘ফ্যাব ফোর’। আপনার কাকে বেশি ভাল লাগে? কার ব্যাটিং আপনাকে বেশি আনন্দ দেয়?

সচিন: আমার মনে হয়, চার জনের প্রত্যেকে আলাদা। যদি কারও আগ্রাসন বেশি পছন্দ হয়, যদি মনে হয়, আমি এমন এক জনকে সঙ্গে চাই, যাকে নিয়ে আগ্রাসী হতে পারব, তা হলে উত্তর হবে বিরাট। যে সব চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক এবং অসাধারণ ধারাবাহিকতাও দেখাচ্ছে। যদি তুমি প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে চাও, তা হলে পছন্দের নাম হতে পারে স্টিভ স্মিথ। যাকে দেখে প্রতিপক্ষ বোলারেরা ভুলে যায়, কোথায় বল করবে। এতটাই অন্য রকম স্মিথের ব্যাটিং। টেস্টে দারুণ ধারাবাহিকতা ওরও। যদি এমন কাউকে খুঁজছ, যে খুব শান্ত প্রকৃতির হবে, খুব নিয়ন্ত্রিত আর পরিণত হবে, টেকনিকের দিক থেকে পোক্ত হবে, তা হলে এগিয়ে থাকবে কেন উইলিয়ামসন। আর যদি এমন কাউকে দরকার পড়ে, যে খুব ‘স্ট্রিটস্মার্ট’, দুর্দান্ত ভাবে স্ট্রাইক ঘুরিয়ে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল আর বিরক্ত করে তুলবে, তা হলে পছন্দের নাম জো রুট। চার জনের গুণ আলাদা এবং প্রত্যেকে ধারাবাহিক ভাবে রান করে যেতে পারে। আমি এমনিতে রেটিংয়ে খুব একটা বিশ্বাসী নই। তবে এদের চার জনকে ‘ফ্যাব ফোর’ বলা যেতেই পারে।

প্রশ্ন: এই চার জনের মধ্যে কে রেকর্ড বইয়ে সবার উপরে থেকে শেষ করতে পারে বলে মনে হয়?

সচিন: চার জনের দখলে ইতিমধ্যেই দারুণ সব রেকর্ড রয়েছে। প্রত্যেকেই অসাধারণ সব পরিসংখ্যান নিয়ে শেষ করতে পারে। তবে আবার বলব, রেকর্ড হয়তো একটা দিক। আসল হচ্ছে, এখনকার ক্রিকেট ব্যাটিংয়ে গুণগত মান নিয়ে যখন আলোচনা হবে, এই চার জনের নাম উঠবে ‘স্পেশ্যাল প্লেয়ার’ হিসেবে। সেটাই ওদের সেরা প্রাপ্তি।

প্রশ্ন: অ্যাশেজে স্টিভ স্মিথ আর জোফ্রা আর্চারের দ্বৈরথ কেমন উপভোগ করেছেন?

সচিন: ভালই লেগেছে আমার। লর্ডসে স্টিভ স্মিথকে প্রথম বাউন্সারে বিব্রত করার চেষ্টা করতে শুরু করে আর্চার। কয়েক বার দেখে মনে হচ্ছিল, বল যেন স্মিথকে অনুসরণ করছে। অর্থাৎ বাউন্সারের লাইন থেকে শরীরকে সরিয়ে নিতে পারছিল না ও। চোটও লাগল। তার ফলে পরের টেস্টে খেলতে পারল না। এর পর স্বমহিমায় ফিরে ডাবল সেঞ্চুরি করল। কিন্তু ওই ডাবল সেঞ্চুরির ম্যাচটায় ওদের দ্বৈরথে লর্ডসের মতো তীব্রতা দেখিনি। এই কারণেই আমি বারবার বলছি, টেস্ট ক্রিকেটে পিচের চরিত্র একটা বড় ব্যাপার। ইংরেজ ধারাভাষ্যকারেরাও তখন বলেছিল, পিচটা মন্থর। যথেষ্ট গতি বা বাউন্স নেই। ওভালে আবারও দারুণ একটা স্পেল করল আর্চার। এই ধরনের রুদ্ধশ্বাস দ্বৈরথগুলোই কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটকে আকর্ষক করে তোলে। এই উত্তেজনার আঁচটা পেতেই লোকে মাঠে খেলা দেখতে আসে। সেটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আমার কথা হচ্ছে, এই দ্বৈরথগুলো তখনই সম্ভব, যখন স্পোর্টিং পিচ তৈরি করা হবে। যেখানে ব্যাটসম্যানকে পরীক্ষায় ফেলতে পারবে বোলারেরা। অ্যাশেজের কথাই ধরুন না। লর্ডস আর ওভালের টেস্ট ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের চেয়ে বেশি উত্তেজনাপূর্ণ হয়েছিল। এমনকি, হেডিংলেতেও জীবন্ত উইকেটের জন্য খেলা জমে উঠেছিল। জানি না, এই নিয়ে কত বার আপনাকে এই কথাটা আমি বলছি। টেস্ট ক্রিকেটের হৃদয় হচ্ছে পিচ। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট উপহার দিতে গেলে বোলারদের কথা মাথায় রেখে উইকেট তৈরি করতে হবে। তা না-হলে গ্যালারি ভরানো কঠিনই হবে।

প্রশ্ন: দ্বৈরথের কথা শুনে মনে পড়ছে আপনার ক্রিকেটজীবনের সেই সব বিখ্যাত দ্বৈরথের কথা। আপনার কোনগুলো মনে রয়েছে এখনও?

সচিন: অনেক বার, অনেক রকম চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়তে হয়েছে। মনে আছে মুম্বইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট খেলছিলাম। সারা বিশ্বে তখন অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়া। যেখানে যাচ্ছে, জিতছে। সকালের সেশনে বল করছিল গিলেসপি আর ম্যাকগ্রা। আমি আর রাহুল (দ্রাবিড়) ব্যাট করছিলাম। জীবন কঠিন করে তুলেছিল দুই অস্ট্রেলীয় বোলার। আর এক বার নটিংহ্যামের একটা সকালে স্টিভ হার্মিসন, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ আর রায়ান সাইডবটম দারুণ বল করছিল। কয়েকটা বল লাফাল, কয়েকটা নিচু হয়ে গেল। ভীষণই কঠিন একটা অধ্যায় ছিল। মনে আছে, পরিস্থিতি হাল্কা করার জন্য আমরা ব্যাট করতে করতেই রসিকতা করা শুরু করলাম। অফস্টাম্পের বাইরে হয়তো পরিষ্কার পরাস্ত হলাম। হাসতে হাসতে বললাম, ‘ওয়েল লেফ্‌ট’ (বলটা দারুণ ছাড়লে তো)। দেখে ওরাও অবাক হয়ে যাচ্ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, যদি খুব সিরিয়াস হয়ে এই সেশনটা খেলার চেষ্টা করি, তা হলে আর দেখতে হবে না। মাথার উপরে আরও চাপ তৈরি হবে। তখন ইংল্যান্ডের পেসারেরা আরও বেশি করে ঘাড়ে চেপে বসবে। তখন চ্যালেঞ্জটা ছিল, যে-ভাবেই হোক, সেই পর্বটা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখো। তার পরে কেপ টাউনে এক বার আমি আর গৌতম গম্ভীর ৫৭ মিনিট ধরে একটাও সিঙ্গলস নিইনি। আমি ডেল স্টেনকে খেলে যাচ্ছিলাম, ও মর্নি মর্কেলকে। এ-রকম অভাবনীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমি ক্রিকেটজীবনে কখনও যাইনি, যেখানে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে স্ট্রাইক ঘোরাতে পারিনি। বাউন্ডারি মারতে পারলেই একমাত্র রান হচ্ছে। দু’জনে কথা বলার সময় নিজেদের আশ্বস্ত করছিলাম এই বলে যে, ঠিক আছে, এটাও খেলার অঙ্গ। এই টেস্ট ম্যাচটা এ ভাবেই খেলতে হবে আর আমরা এ ভাবেই খেলে যাব। স্টেন আর মর্কেলের দুর্ধর্ষ স্পেলটা আমরা কোনও খুচরো রান না-নিয়েই খেলে দিয়েছিলাম আর আমাদের ইনিংসটাও ভাল জায়গায় চলে গিয়েছিল।

প্রশ্ন: এই ধরনের চ্যালেঞ্জগুলোই কি টেস্ট ক্রিকেটের সেরা আকর্ষণ নয়?

সচিন: একদমই তা-ই। দু’জন বিশ্বসেরা ফাস্ট বোলার একটা কঠিন পিচে আমাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সেটাকে আমাদের অতিক্রম করতে হবে। দু’পক্ষের সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৈরি হবে উত্তেজনার স্ফুলিঙ্গ। আর সেখান থেকে সৃষ্টি হবে দর্শকদের আগ্রহ। টেস্ট ক্রিকেটের আকর্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এই ধরনের উত্তেজনা তৈরি করতে হবে। যেখানে পরের বলে কী হতে পারে, তা দেখার অপেক্ষায় উদ্গ্রীব থাকবে গ্যালারি। তবেই না দর্শকেরা টেস্ট ম্যাচের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকবেন!

ওয়ার্নের সঙ্গে দ্বৈরথ নিয়েও বললেন সচিন

প্রশ্ন: এবং, শেন ওয়ার্নের সঙ্গে সেই অমর দ্বৈরথ। এটা কি আপনার স্ট্র্যাটেজিই ছিল যে, প্র্যাক্টিস ম্যাচে খেলব, ওয়ার্নকে ধ্বংস করব আর তার পরে টেস্ট সিরিজে ওকে পাওয়া যাবে অনেক দুর্বল অবস্থায়?

সচিন: আমি ওয়ার্নের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নিজেকে তৈরি করেছিলাম। তবে, স্ট্র্যাটেজি ছিল বলব না। সিসিআই-এ (মুম্বইয়ের ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়া) প্র্যাক্টিস ম্যাচটায় খেলে আমি ডাবল সেঞ্চুরি করলাম। দিনের শেষে বন্ধুরা এসে আমাকে অভিনন্দন জানাতে থাকল। সকলে খুব উচ্ছ্বসিত। আমি ওদের বললাম, তোমরা কেউ একটা জিনিস খেয়ালই করোনি। ওয়ার্ন একটা বলও রাউন্ড দ্য উইকেট করেনি। ওটাই ওর ব্রহ্মাস্ত্র। আমি তখন আসন্ন সিরিজের জন্য প্রস্তুত হতে গিয়ে দেখে রেখেছি, রাউন্ড দ্য উইকেট বোলিংয়ে ওয়ার্ন কতটা ভয়ঙ্কর। তাই ডাবল সেঞ্চুরি করেও সে-দিন বন্ধুদের বলেছিলাম, অপেক্ষা করো ভাই সব। দ্বৈরথ শুরুই হয়নি। ওয়ার্ন অনেক চতুর স্পিনার। ঠিক ধরতে পেরেছে যে, আমি ওর বোলিংটা বুঝে নিতেই প্র্যাক্টিস ম্যাচটা খেলতে এসেছি। তাই রাউন্ড দ্য উইকেট গেলই না। আস্তিনের তাস বারই করেনি ও। টেস্ট সিরিজে ঠিক ওটাই চেষ্টা করবে আর তখনই আমার আসল পরীক্ষা।

প্রশ্ন: তার পরে আপনার প্রস্তুতিতে কী পরিবর্তন করতে হল?

সচিন: আমি বুঝলাম, আমাকে ওই রাউন্ড দ্য উইকেট বিষাক্ত ডেলিভারিগুলোর জন্য তৈরি থাকতে হবে। পিচে যে-‘রাফ’ তৈরি হবে, সেখানে বল ফেলে ব্যাটসম্যানকে ছোবল মারবে ওয়ার্ন। আর ওর সব চেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, রাউন্ড দ্য উইকেট এসেও আউট করার চেষ্টা করবে। অন্য বোলারদের মতো রান আটকানোর জন্য বোলিং করবে না ও। আমি এমনিতে আগে থেকেই তৈরি করছিলাম নিজেকে (চেন্নাইয়ের উইকেট খুঁড়ে লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণনকে দিয়ে পিচের ক্ষতে বল করিয়ে ওয়ার্ন-দ্বৈরথের জন্য তৈরি হয়েছিলেন সচিন। সেই কাহিনি ভারতীয় ক্রিকেটের রূপকথায় স্থান করে নিয়েছে)। আমি ভাবতে শুরু করলাম, সামনে কী কী রাস্তা খোলা থাকতে পারে। হয় ওয়ার্নকে দেখে দেখে খেলে দিতে হবে। নয়তো পাল্টা আক্রমণে যেতে হবে। টেস্ট সিরিজে খেলতে গিয়ে বুঝলাম, রক্ষণাত্মক হলে ওয়ার্ন শেষ করে দেবে। কাউন্টার অ্যাটাক ছাড়া উপায় নেই। তাই সেটাই করার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, ওয়ার্নের বিরুদ্ধে মানসিক অবস্থানটা ঠিক করা খুব কাজে দিয়েছিল যে, আমি ওকে মাথায় চড়তে দেব না। বিভ্রান্ত হয়ে যদি ওকে খেলতে যেতাম, ডুবতে হত। ওয়ার্ন এমন এক জন বোলার, যে খুব বেশি সুযোগ দেবে না। সারা ক্ষণ আক্রমণ করে যাবে। আমি মনে করি, প্রস্তুতিটা সে-বার আমাকে জিতিয়ে দিয়েছিল। ওয়ার্নকে খেলতে নামার আগে আমার মস্তিষ্কের মধ্যে সম্ভাব্য পরিস্থিতিগুলো সাজানো ছিল। কী ভাবে ও আমাকে আক্রমণ করতে পারে আর আমি কী ভাবে পাল্টা জবাব দিতে পারি। তার পরে মাঠে নেমে আমি নিজের সহজাত প্রবণতার উপরে ভরসা রেখেছি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy