Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

রূপকথার বিদায় না ঘটে পানসে হল সঙ্গকারার ক্রিকেটীয় সূর্যাস্ত

সাবেকি যুগের ইংরেজ ক্রিকেটলিখিয়েরা শ্রেষ্ঠত্ব মাপার একটা মাপকাঠি বার করেছিলেন। সে-ই বড় যে ব্যাট করতে নেমেছে খবর পেলে লোকে পানশালায় বিয়ার নামিয়ে রেখে ছুটে আসে! পি সারা ওভাল প্যাভিলিয়নের ঠিক পাশে একটা ঐতিহ্যশালী ক্রিকেট বার আছে। নাম ওভাল ট্যাভার্ন।

চতুর্থ দিন সঙ্গকারার অটোগ্রাফ করা পোস্টকার্ড বিলি হল স্টেডিয়ামে।

চতুর্থ দিন সঙ্গকারার অটোগ্রাফ করা পোস্টকার্ড বিলি হল স্টেডিয়ামে।

গৌতম ভট্টাচার্য
কলম্বো শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৫ ০২:৪৬
Share: Save:

সাবেকি যুগের ইংরেজ ক্রিকেটলিখিয়েরা শ্রেষ্ঠত্ব মাপার একটা মাপকাঠি বার করেছিলেন। সে-ই বড় যে ব্যাট করতে নেমেছে খবর পেলে লোকে পানশালায় বিয়ার নামিয়ে রেখে ছুটে আসে!

পি সারা ওভাল প্যাভিলিয়নের ঠিক পাশে একটা ঐতিহ্যশালী ক্রিকেট বার আছে। নাম ওভাল ট্যাভার্ন। তার ভেতর এই মাঠের পুরনো-পুরনো সব ছবি। সেই আটচল্লিশ সালে এই মাঠে ব্র্যাডম্যান ব্যাট করতে যাচ্ছেন। ব্র্যাডম্যান আর সদাশিবম দুই অধিনায়ক টসে। শ্রীলঙ্কার খেলা প্রথম অফিশিয়াল টেস্টের আগে ইয়ান বোথাম করমর্দন করছেন লঙ্কান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে।

আজকের কলম্বোর দাউদাউ গরমের মধ্যে এসি ঘর এমনিতেই যথেষ্ট আরাম। তার ওপর পুরনো-পুরনো এই সব ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবির কালেকশন পনেরো বাই পনেরো ঘরটায় খানদানি ক্রিকেটের আমেজ তৈরি রেখেছে। কোণায় একশো টাকা করে এক মগ বিয়ার বিক্রি হচ্ছে। তা ঠিক চারটে ষোলো মিনিটে কুমার সঙ্গকারা ব্যাট করতে নামার সঙ্গে সঙ্গে এসি রুমের ভেতরটা খালি হয়ে গেল। যে যার ড্রিঙ্ক নামিয়ে পাঁইপাঁই ছুটল বাইরের নন-এসি কাঠের বেঞ্চিগুলোয়।

দ্রুত মনে পড়ে গেল পুরনো সেই মাপকাঠি— বড় সে-ই যে ব্যাট করতে নেমেছে খবর পেলে লোকে ড্রিঙ্ক নামিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে মাঠে দৌড়োয়।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

শ্রীলঙ্কার প্রাচীনতম মাঠে তখন ক্রিকেট ইতিহাসও নবীন আর প্রবীণকে একই বন্ধনে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য ডিজাইনার সব সাজসজ্জা প্রস্তুত। এই ক’দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিড় আজকেই হল। তাদের মাতিয়ে রাখতে সকাল থেকে মাঠে স্টিল ব্যান্ড। ঠিক যেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্যালারি। স্টিভের শেষ বিদায়তে সিডনি মাঠে রীতি ছিল লাল রুমাল নাড়া। কলম্বোর ওভালে বিদায়ী ক্রিকেটীয় শেষকৃত্যে ব্যবহার হচ্ছিল সঙ্গার অটোগ্রাফ করা জলপাই রঙের পোস্টকার্ড। এই ক’দিন দেখিনি আজই বিলি হচ্ছিল। যার ওপর সঙ্গার বয়ানে লেখা, আপনাদের সমর্থন আর অবিরত উৎসাহ জোগানোর জন্য ধন্যবাদ। প্রথম উইকেট পড়ার পর সঙ্গা নামামাত্র মাঠজুড়ে ওই পোস্টকার্ড আর শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকা দোলানো শুরু হল। যে কোনও ক্রিকেটীয় মহানায়কের শেষ দৃশ্যের না লেখা অথচ গ্যারান্টেড বক্স অফিস চিত্রনাট্য।

ড্রেসিংরুমের দোতলার বক্স থেকে নীচে নামামাত্র স্কুল শিক্ষার্থীরা গার্ড অব অনার দিল সঙ্গাকে। এদের তুলে রাখা ব্যাটগুলোর মধ্যে দিয়ে তিনি মাঠে ঢুকে পড়লেন। ঠিক পাশের বক্সটাতেই তখন তাঁর স্ত্রী, পরিবার, বন্ধুবান্ধব সব বসা। ওখানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে দুপুর থেকেই। ওটা যে সঙ্গকারার বক্স! বাড়তির মধ্যে একজন ক্যামেরাম্যান আজ শ্রীলঙ্কা ইনিংসের শুরু থেকেই ওখানে রেখে দিয়েছে সোনি।

ক্রিজে পৌঁছনোর আগে কোহলির ভারত আবার দু’ধারে সারিবদ্ধ সম্মান জানাল তাঁকে। প্রথম ইনিংসে ওই জটলা থেকে কোহলির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সঙ্গা। আজ দেখলেনই না ও দিকে। বোঝা গেল, শেষ ইনিংসকে অবশ্যই স্মরণীয় রাখতে চান। আর এ বারের মরসুমে তো রানও পাচ্ছেন না। পাকিস্তান সিরিজে ৫০, ১৮, ৩৪, ০ করার পর চলতি সিরিজে এই পর্যন্ত ৪০, ৫, ৩২। একেবারেই সঙ্গকারাচিত নয়।

পার্সি অভয়শেখরার নেতৃত্বে প্যাভিলিয়নের সামনের দিককার কাঠের বেঞ্চ ততক্ষণে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে, গো ফর ইওর ডাবল। কে না জানে, আর একটা ডাবল সেঞ্চুরি করলে সবচেয়ে বেশি ডাবল সেঞ্চুরি করার কৃতিত্বে ব্র্যাডম্যানকে ছুঁতেন সঙ্গা। শ্রীলঙ্কার জেতার জন্য ৪১৩ চাই। এই অবস্থায় তাঁর একটা ডাবল তো দৃশ্যকল্পকেই রূপকথার দেশে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। স্টান্স নেওয়া, হাঁটাচলাতেও কোনও নার্ভের ইঙ্গিত নেই। বরং মনে হচ্ছে পুরনো বোম্বাইওলা ব্যাটসম্যানদের মতো ক্রিজে বেডিং নিয়ে এসেছেন। পূর্বাভাসও তো তাই। সকালে প্রেসবক্সে ঢোকামাত্র চোখে পড়েছিল শ্রীলঙ্কান মিডিয়া ম্যানেজারের উদ্বিগ্ন মুখ। কী না, সঙ্গকারা তাঁকে এগিয়ে দেওয়া রাশি রাশি মিনিয়েচার ব্যাট আর অটোগ্রাফের খাতা সই করতে প্রত্যাখ্যান করেছেন। চতুর্থ দিন খেলা শুরু হওয়ার আগে সাফ বলে দিয়েছেন, ‘‘এখানে উৎসব হচ্ছে না। মনে রেখো আমি দেশের হয়ে যুদ্ধে রয়েছি।’’

যুদ্ধকারীর মতোই দেখাচ্ছিল যে ভাবে ইশান্তকে দু’টো বাউন্ডারি মারলেন। উল্টো দিকে অশ্বিনকে বহাল রেখে দিয়েছেন কোহলি। সঙ্গাকে তবু অবিচলিত দেখাচ্ছে। একটা করে রান করছেন আর মাঠ ফেটে পড়ছে। ঠিক সচিনের শেষ ইনিংসে যেমন সঙ্গী পূজারাকে লোকে অপটিক্যাল ইলিউশনে দেখতে পায়নি। তেমনই এখানেও করুণারত্নে অদৃশ্য। দু’দিকের উইকেটেই খেলছেন যেন একা সঙ্গা। আর ঠিক আমেজটা জাঁকিয়ে বসছে এই অবস্থায় অশ্বিনের অফব্রেক সামলাতে না পেরে সঙ্গা আউট হয়ে গেলেন।

তাঁর কাছে লেগব্রেক হয়ে অফস্টাম্পের ঠিক বাইরে চকিত বেরিয়ে যাওয়া এই ডেলিভারি গোটা সিরিজ সাঁইত্রিশ বছরের বাঁ হাতিকে জ্বালিয়েছে। বিদায়বেলাতেও আধ ঘণ্টা কাটাতে না কাটাতে সেই স্লিপে ক্যাচ। এমন সচরাচর ঘটে না যে ফিল্ডার এসে ক্যাচ ধরার পর হ্যান্ডশেক করে গেল। বোলার ছুটে এসে হাত বাড়াল। কিন্তু আজ অবশ্যই ঘটল। ভারতীয়রা অনেকে এগিয়ে এলেন। তাঁদের মধ্যে দিয়ে গোটা মাঠ এবং সম্ভবত নিজেকেও স্তব্ধ করে সঙ্গকারা হাঁটতে শুরু করলেন নিজের ক্রিকেটীয় সূর্যাস্তের দিকে।

পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বাজা শুরু হল, সঙ্গা ভাল থাকুন। আমাদের স্মৃতির জন্য ধন্যবাদ। আমাদের বিনোদনের জন্য কৃতজ্ঞতা। কিন্তু সুর ততক্ষণে এমনই কেটে গিয়েছে যে বিদায়টা স্থায়ী হয়ে মাঠের ওপর রাজ করতে পারল না। প্রচুর দর্শক দ্রুতই মাঠ থেকে বেরিয়ে এলেন। বোঝাই গেল তাঁদের একমাত্র চুম্বক কী ছিল! টিভি ক্যামেরা ততক্ষণে সঙ্গা-পত্নীর বিষাদগ্রস্ত অভিব্যক্তিকে দেখাচ্ছে। আউট হওয়ার আগে ধরলে বোঝা যেত প্রমীলার বামেতর নয়ন নাচিল-র মতো আগাম কোনও বিপদসঙ্কেত ইয়াহিলির বডি ল্যাঙ্গোয়েজে ছিল কি না? আপাতত স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় বিক্ষত তিনি। কপালে হতাশার হাত!

রাতে শ্রীলঙ্কার প্রবীণতম ক্রিকেটলিখিয়ে বলছিলেন, ‘‘সঙ্গা নিষ্কৃতি পেল। ওয়ার্ল্ড কাপে এত ভাল খেলার পর ও বারবার তখনই রিটায়ার করবে বলেছিল। জাস্ট জোর করে সিলেক্টররা চারটে টেস্ট খেলালো। ওর মনই ছিল না তাই এমন পারফরম্যান্স।’’ যিনি বলছিলেন সেই সাদি তৌফিক খুবই ঘনিষ্ঠ সঙ্গার। কিন্তু তাঁর সঙ্গে একমত হওয়া যাচ্ছে না। শেষ টেস্টে রান করার লক্ষ্যে প্রাণপণ করেছেন সঙ্গা। নেটে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন। বিদায়ী টেস্ট আর সংবর্ধনা এগুলোকে মাথায় নেননি। কিন্তু বিদায়ী সিরিজে ভারতীয় পেসারদের মহড়া নিয়ে নিলেও অশ্বিনকে তিনি সামলাতে পারেননি। তাই কালিস, স্টিভ ওয় বা তেন্ডুলকরের মতো শেষ ইনিংসটা বর্ণাঢ্য হল না তাঁর। বিদায়টাও রূপকথার হল না কারণ শ্রীলঙ্কা তাঁর বৃহত্তম সুপারস্টারের কাছে অন্তত একটা বড় স্কোর চেয়েছিল!

বলা যেতে পারে ক্রিকেটজীবনের শুরুটা যেমন অনাড়ম্বর ভাবে হয়েছিল, বিদায়ী শেষ আটটা ইনিংসও তেমন নিম্নমধ্যবিত্ততায় ঢেকে থাকল। কিন্তু বন্ধনীর শুরু আর জোড় দিয়ে কী আসে যায়— মধ্যবর্তী সময়ে যা গড় রেখেছেন সঙ্গকারা তা রূপকথার বিদায় না দিয়েও রূপকথার ক্রিকেটজীবন আখ্যা থেকে আটকায়নি। পরিসংখ্যানেই তাঁর অমরত্ব।

গড় আর মোট টেস্ট রান দু’টোতেই সর্বকালীন তালিকায় যে শেষ করলেন পাঁচ নম্বরে। ১৩৪ টেস্টে মোট ১২,৪০০ রান। মোট রানসংখ্যায় আগে একমাত্র সচিন, পন্টিং, দ্রাবিড় ও কালিস। সঙ্গার আসল কীর্তি অবশ্য টেস্ট অ্যাভারেজের অবস্থান। গত আট ইনিংসের ব্যর্থতাতেও তাঁর গড় থেকে গেল ৫৭.৪১। আধুনিক সময়ের যে কোনও ব্যাটসম্যানের চেয়ে উঁচুতে। সচিনের গড় ৫৩.৭৮। রাহুলের ৫২.৩১। লারার ৫২.৮৮। পন্টিং ৫১.৮৫।

অন্তত কুড়িটা টেস্ট ম্যাচ খেলা যদি ব্যাটসম্যানের মাপকাঠি ধরা হয় সঙ্গকারার চেয়ে বেশি গড় মাত্র চার জনের। তার মধ্যে ডন ৯৯.৯৪ নিয়ে ধরাছোঁয়ার উর্ধ্বে। কিন্তু বাকিরা খুব কাছাকাছি। কেন ব্যারিংটন (৫৮.৬৭), ওয়ালি হ্যামন্ড (৫৮.৪৬), গ্যারি সোবার্স (৫৭.৭৮) আর তিনি সঙ্গা (৫৭.৪১)।

কুমার সঙ্গকারার এটাই আসল রেকর্ড— এমনকী উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হয়েও এই মাপের ব্যাটিং কৃতিত্ব অবিশ্বাস্য!

ক্রিকেটবিশ্ব তাই জানে শ্রীলঙ্কায় গত বারো দিন ধরে যুগ্ম দু’টো সিরিজ চলছিল। একটা ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা। যে সিরিজের একটা টেস্ট ম্যাচ আর একদিনের খেলা বাকি থেকে গেল। অন্য সিরিজটা কিন্তু আজই শেষ হয়ে গেল— সঙ্গা সিরিজ।

ক্রিকেটজনতা এই সিরিজটার শেষ দিনের ১৮ রানটাই মনে রাখবে। ব্র্যাকেটের জোড়টা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ওটাই যে ছিল ইতিহাসের শেষ পাতা!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE