ছোটখাটো চেহারার মেয়েটা এগিয়ে চলেছে হকি স্টিক নিয়ে। পাড়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা স্কুটার, মোটরবাইকগুলি যেন বিপক্ষের এক একজন ডিফেন্ডার। তাদের কাটিয়ে সে এগিয়ে চলেছে লক্ষ্যে। কিন্তু মেয়ে হয়ে রাস্তায় নেমে এই ধিঙ্গিপনা! পাড়ায় ছেলেদের সঙ্গে এক সঙ্গে এ ভাবে ‘বেহায়ার মতো’ রাস্তায় স্টিক হাতে দৌড়! সমাজের মূর্তিমান প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত হন মেয়েটির বাবা। এ সব বন্ধ করো! কোন ঘরে নেবে এমন মেয়েকে? বাবার রোষের সামনে মা যেন কিছুটা নরম। আহা শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়ে হেঁসেলই তো ঠেলতে হবে! তা এখন একটু লাফঝাঁপ দিচ্ছে দিক না মেয়েটা! যাবতীয় নরম এবং গরম, সামাজিক কিংবা পারিবারিক, এই সব বাধাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এক দিন সেই মেয়ের গোলেই বিশ্বকাপ জিতল ভারত।
রিল লাইফের যোদ্ধা, চক দে’র কোমল।
‘চক দে ইন্ডিয়া’র দৌলতে হরিয়ানার সেই ফরোয়ার্ড কোমল চৌতালাকে আমরা প্রায় সবাই চিনি। হরিয়ানার মতো একটি রাজ্য, কন্যা ভ্রুণ হত্যা থেকে শুরু করে অনার কিলিংয়ের জন্য বারেবারে যার নাম উঠে আসে, সেখানে কোমল চৌতালার রিল লাইফের লড়াই এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। অলিম্পিকে ভারতের প্রথম মহিলা কুস্তিগীর হিসাবে পোডিয়ামে ওঠার পর কোথায় যেন সেই রিল লাইফের কোমলকে ছুঁয়ে গেলেন বাস্তবের সাক্ষী মালিক। ছুঁয়ে নয় শুধু, বোধহয় ছাপিয়ে গেলেন। কেন না কোমলের থেকে সাক্ষীর লড়াইটা ছিল আরও কঠিন।
দেখুন ‘চক দে ইন্ডিয়া’র সেই দৃশ্য...
মেয়েদের কুস্তি নিয়ে সামাজিক প্রচুর বাধা বিপত্তি থাকলেও হরিয়ানার সাবেক ইতিহাস কিন্তু আলাদা কথা বলছে। এক কালে এই এলাকার মেয়েদের মধ্যে কুস্তির আখড়ায় যাওয়া ছিল স্বাভাবিক বিষয়। পরবর্তী কালে মেয়েদের কুস্তি করা থেকে খেলাধুলো, চলাফেরা প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই ভুরু কুঁচকেছে খাপ পঞ্চায়েত। এই বিপরীত মানসিকতার বিরুদ্ধে একেবারে শুরু থেকেই লড়তে হয়েছে সাক্ষীকে। তাঁকে কোচিং করানোর জন্য ঘেরাও পর্যন্ত হতে হয়েছে কোচ ঈশ্বর দাহিয়াকে। কিন্তু সাক্ষীকে লক্ষ্য থেকে টলানো যায়নি। তাঁর প্র্যাকটিসে যাওয়া আটকাতে একটা সময়ে এক দল ছেলেকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের কাজই ছিল প্র্যাকটিসে যাওয়ার রাস্তায় তাঁকে বিরক্ত করা। একরোখা মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে থাপ্পড় মেরেছিল দলের একটি ছেলেকে। পরিকাঠামোর অভাবে দিনের পর দিন ছেলেদের সঙ্গেই প্র্যাকটিস করতে হয়েছে সাক্ষীকে। এর জন্যও শুনতে হয়েছে নানা বিরূপ মন্তব্য। কিন্তু কোনও বাধাকেই পাত্তা দেননি সাক্ষী। তবে প্রথম থেকেই পেয়েছিলেন পরিবারের সহযোগিতা।
রিয়েল লাইফের যোদ্ধা, রোহতকের সাক্ষী।
রোহতকের বর্ধিষ্ণু গ্রাম মোখরায় শুরু হয় সাক্ষীর প্রথম প্রশিক্ষণ। মাত্র ১২ বছর বয়সে স্থানীয় আখড়ায় ছেলেদের সঙ্গে লড়াই করতে হত তাঁকে। কোচ ঈশ্বরের হাত ধরে জাতীয় স্তরে কুস্তির বিভিন্ন ইভেন্টে নামতে শুরু করেন তিনি। সাফল্য আসতে থাকে প্রথম থেকেই। ১৮ বছর বয়সে ৫৯ কেজি বিভাগে জুনিয়র বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতেন সাক্ষী। এর পর দাভে স্কুলজ ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম হয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে নজর কাড়েন। পরের বছরই দোহায় সাউথ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জেতেন।
আরও পড়ুন...
জিতেই ফিরব, বলে গিয়েছিল সাক্ষী
কিন্তু অলিম্পিক ব্রোঞ্জ জেতার চূড়ান্ত লড়াইটায় ০-৫এ পিছিয়ে গিয়েছিলেন সাক্ষী। সেখান থেকে দুরন্ত প্রত্যাবর্তনে ৮-৫এ জয়। শেষ আট সেকেন্ডে যখন দাঁতে দাঁত চেপে ম্যাচের মোড় উল্টে দিচ্ছিলেন, তখন কি গ্রামের সেই লোকগুলোকেই দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি? আছড়ে ফেলতে চাইছিলেন সেই সমাজটাকে, যে প্রতি পদে পদে বেড়ি পড়াতে চেয়েছিল তাঁর পায়ে? সাক্ষী এ সব কিছু আছড়ে ফেলতে পেরেছেন। আর পেরেছেন বলেই, যে হরিয়ানার মাটিতে তাঁর উড়ানে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করেছে, অলিম্পিক পদক জিতে আজ সেখানেই নারীশক্তির বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে চলেছেন সাক্ষী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy