রাজসিক: সেঞ্চুরির সঙ্গে বুধবার এ ভাবেই মহারাজদের গ্যালারিতে উড়িয়ে দিলেন ওপেনার রোহিত। পিটিআই
প্রাণান্তকর চাপের মধ্যে ওপেন করতে নামার অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে, বুধবারেই প্রথম জানলেন না রোহিত গুরুনাথ শর্মা। ক্রিকেটের বাইশ গজে দাঁড়িয়ে এটাই প্রথম এসপার-ওসপার পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া নয়।
বুধবারেরটা ছিল বিশাখাপত্তনমে ক্রিকেটের বাইশ গজে। টেনেটুনে বলা যেতে পারে, টেস্ট জীবন রক্ষার অগ্নিপরীক্ষা। যদি ব্যর্থও হতেন রোহিত, তা হলেও সংশয় তৈরি হত শুধু সাদা জার্সিতে তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে। সাদা বলে কেউ কাড়তে পারত না তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। আর স্কুল ছাত্র হিসেবে যে দিন তাঁকে অফস্পিনার থেকে ব্যাটসম্যানে পরিণত করে ওপেন করতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর কোচ, সেটা ছিল জীবন রক্ষার লড়াই। সে দিন ব্যর্থ হলে ২০১৯-এর গাঁধী জন্মদিনে আকাশের দিকে মুখ তুলে পরম তৃপ্তি আর শান্তিতে চোখ বন্ধ করার মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিতই হত না।
বিশাখাপত্তনম টেস্টের প্রথম দিনে সব চেয়ে জনপ্রিয় দু’টো দৃশ্য। একটি অবশ্যই সেঞ্চুরি করে রোহিতের আকাশের দিকে চোখ বন্ধ করে তাকানো। অন্যটা তার অনেক আগেই দেখা গিয়েছে। টসের দৃশ্য। সচরাচর টসে জয়ী অধিনায়কের উপর ক্যামেরা বেশি করে ফোকাস করে। বিশাখাপত্তনমে বেশি আলোচিত হচ্ছে, টসের পরে দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক ফ্যাফ ডুপ্লেসির মুখের অভিব্যক্তি। টস হারা ডুপ্লেসি এমন বিবর্ণ মুখে ড্রেসিংরুমের দিকে সতীর্থদের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন যে, মনে হচ্ছিল, ‘ক্যাচেস উইন ম্যাচেস’ সেই বিখ্যাত ক্রিকেটীয় প্রবাদ ভারতের মাটিতে অন্তত পাল্টে গিয়ে বিদেশি অধিনায়কদের জন্য ‘টসেস উইন ম্যাচেস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টস হেরে ডুপ্লেসির মুখ যতই পাংশু হয়ে যাক, তিনি— রোহিত শর্মা আরাম করার সময় পেলেন কোথায়? ওপেনার হিসেবে জীবনের প্রথম টেস্টে শুরুতেই নেমে পড়ার ঝক্কি। তা-ও কাদের বিরুদ্ধে? না, টেস্ট ক্রিকেটে যাঁদের বলা হয়, তাঁর ‘যম’। কাগিসো রাবাডা এবং ভার্নন ফিল্যান্ডার। দু’জনেই তাঁকে তিন বার করে আউট করেছেন এবং দু’বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় রোহিতের টেস্ট জীবন এমন বিভীষিকায় ভরিয়ে তুলেছিলেন যে, উত্তপ্ত বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, ওঁকে কেন খেলানো হচ্ছে?
সেই রোহিত যখন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঘুমন্ত দৈত্যের ভঙ্গিতে দুল্কিচালে বাইশ গজের দিকে এগোচ্ছিলেন, নেপথ্যে যেন সেই কষ্টের দিনগুলো ভেসে উঠছিল। বাবা গুরুনাথ শর্মার সংসারে তখন তীব্র দারিদ্রের ছাপ। ডোম্বিবলীতে এসে উঠেছেন, ছেলেকে স্কুলে ভর্তিও করলেন। কিন্তু স্কুলের বেতন দেওয়ার পয়সাটুকুও জোগাড় হচ্ছে না। তার মধ্যেই কোচ দীনেশ লাডের কোচিং ক্যাম্পে পাঠিয়েছেন বাবা। সেখানে রোহিত শুরু করেছেন অফস্পিনার হিসেবে। এক দিন নেটে তাঁর ব্যাটিং দেখে কোচ অভিভূত। সে দিন থেকেই তাঁকে ব্যাটিংয়ে বেশি করে সময় দিতে বললেন। স্কুল পাল্টে দিতে চাইলেন। কোচের কথা শুনে গুরুনাথের মাথায় হাত। নতুন স্কুলে আরও বেশি বেতন। একটি সংস্থায় কেয়ারটেকারের চাকরি করা তিনি সেই বোঝা নেবেন কী করে?
দক্ষ জহুরির মতো সোনা চিনেছিলেন দীনেশ লাড। স্বামী বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে ছাত্রের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন। এর পর জীবনের প্রথম আন্তঃ স্কুল ম্যাচেই দীনেশ লাড তাঁকে নামিয়ে দিলেন ওপেন করতে। সে দিন ১২০ অপরাজিত করে শুধু ক্রিকেট কেরিয়ার নয়, নিজের জীবনকেই ভাসিয়ে তুলেছিলেন রোহিত। ডোম্বিবলীতে অভাবের শর্মা পরিবারের বারান্দাতে কালো মেঘ কেটে সেই সূর্যকিরণ পড়া শুরু। বুধবার বিশাখাপত্তনমে যা সূর্যমুখী হয়ে ফুটল।
১৭৪ বলে ১১৫ অপরাজিতের পরে তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে বীরেন্দ্র সহবাগের সঙ্গে। ইনিংসে ১২টি চার, ৫টি ছক্কা। ৮৭ থেকে ৯৩-তে পৌঁছলেন ছক্কা মেরে। তার পর আরও একটা চার মেরে ৯৭। সব মিলিয়ে সহবাগীয় সেই ভঙ্গিই ঠিকরে বেরচ্ছিল যে, বলকে শাসন করতে এসেছে ব্যাট, উল্টোটা নয়। বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি এসে খেলা বন্ধ করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত মায়াঙ্ক আগরওয়ালকে নিয়ে অপরাজিত ওপেনিং জুটিতে ২০২ তুলে ফেলেছেন রোহিত। রাতের দিকে জানা গেল, বিশাখপত্তনমে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার নির্দিষ্ট সময়েই খেলা শুরু হওয়ার আশা করছেন সকলে। ব্যাটিং সহায়ক পিচে প্রথম উইকেটে পঙ্কজ-বিনুর ৪১৩ রানের কোহিনূর এই দু’জন তাড়া করে বসেন কি না, সেটাই দেখার।
জানা গেল, হেড কোচ রবি শাস্ত্রীর পরামর্শে দু’টো দারুণ টোটকা এ দিন কাজে লাগিয়েছেন। এক) অফস্টাম্প ঘেঁষে গার্ড নিয়েছেন। যাতে অফস্টাম্পটা কোথায়, সেই ধারণাটা পরিষ্কার হয়। নতুন গার্ড নিয়ে রোহিতের রণনীতি ছিল, আমার শরীরের বাইরে যে বলটা যাবে, সেটা খেলব না। অতীতে অফস্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট বাড়িয়েই তিনি বার বার আউট হয়েছেন। দুই) ফিল্যান্ডারকে খেললেন ক্রিজ ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার পেসারদের মধ্যে ফিল্যান্ডারের বলে গতি সব চেয়ে কম কিন্তু হাতে মারাত্মক আউটসুইং আছে। প্রস্তুতি ম্যাচেও আউটসুইংয়েই বোকা বানিয়ে রোহিতকে আউট করেছেন ফিল্যান্ডার। তাই তাঁর সুইং সামলানোর জন্যই এমন পরিকল্পনা। রোহিতকে আটকানোর জন্য এর পর দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটকিপার উপরে চলে এসে উইকেটের কাছে দাঁড়ালেন। রোহিত আর বাইরে বেরতে পারলেন না। কিন্তু তত ক্ষণে টেস্ট ওপেনার হিসেবে অভ্যুদয়ে বড় ইনিংসের রিংটোন সেট হয়ে গিয়েছে।
রোহিতের সেঞ্চুরিতে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় টেস্ট ব্যাটিংয়ের টিআরপি-ও এক লাফে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। এত দিন বিরাট কোহালি আর চেতেশ্বর পুজারার টানেই লোকে টিভির সামনে ভিড় করত। কে এল রাহুলদের শরীরে যত ট্যাটু, তত রান দেখা যায়নি তাঁদের ব্যাটে। রোহিত প্রকল্প সফল হওয়া মানে ব্যাটিং ক্যানভাসে আরও তুলির টান যোগ হওয়া। শুরুতে রোহিত, তিনে চেতেশ্বর পূজারা, চারে বিরাট কোহালি, পাঁচে অজিঙ্ক রাহানে। হঠাৎই ফের শক্তিশালী দেখাতে পারে ভারতীয় ব্যাটিংকে। মনে পড়ে যেতে পারে দু’হাজারের সেই পঞ্চরথীর কথা। সহবাগ, দ্রাবিড়, সচিন, সৌরভ, লক্ষ্মণ। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘বিটলস্’। সেই মায়াবী আবেগ ফেরানো হয়তো কঠিন। কিন্তু কাছাকাছি আসার চেষ্টাই তো করতে পারে বর্তমান পঞ্চক।
বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই বলবেন, আরও অপেক্ষা করে দেখা দরকার। রোহিতের তো বিদেশের মাটিতে ওপেনার হিসেবে পরীক্ষাই শুরু হল না? নতুন বছরের গোড়ায় নিউজ়িল্যান্ডে অন্তত যাক। তার পর না হয় পরীক্ষার ফল বার করা যাবে। বিশুদ্ধবাদীরা নিশ্চয়ই সাবধান করে দেবেন, ইংল্যান্ডের ভেজা আবহাওয়ায় যখন বল নড়াচড়া করবে, তখনই তো দেখতে হবে ওপেনার সাহেব নিজের অফস্টাম্প কোথায় বুঝেছেন কি না!
২ অক্টোবর, ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে তবু বলা যেতে পারে, রোহিত শর্মা কখনওই সুনীল গাওস্কর হবেন না। কিন্তু বিশাখাপত্তনমে ‘সহবাগ-২’ উৎক্ষেপণ হল, বলতে বাধা কোথায়! কোচের সাহায্যে স্কুলে বৃত্তি পাওয়া সেই ছাত্র ওয়ান ডে ক্রিকেটে আগেই মাস্টার ডিগ্রি সেরে ফেলেছেন। বুধবারের পরে টেস্টেও গ্র্যাজুয়েট হওয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy