২৭ অগস্ট ২০১৪— তারিখটা আজ মনে পড়ল রোহিত শর্মার?
কার্ডিফের যে ওয়ান ডে-তে আঙুলের চোট গোটা সিরিজ থেকে ছিটকে দিয়েছিল রোহিতকে। তার পর থেকে কখনও কাঁধের চোট, কখনও গোটা শরীরের বিদ্রোহ।
রোহিত শর্মার খুব ভাল মনে আছে। কী করে ভুলতে পারেন ফিটনেসের সঙ্গে গত আড়াই মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। “আজ ব্যাট করতে নেমে প্রথম দিকটায় কেমন যেন মনে হচ্ছিল অন্য গ্রহে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দশ-পনেরো ওভার বুঝতে বুঝতেই চলে গেল। সহজ ছিল না আমার লড়াইটা।”
সহজ ছিল না নয়, বলা উচিত প্রচণ্ড কঠিন ছিল। মুম্বইয়ের বান্দ্রা-কুর্লা কমপ্লেক্সে রোজ পড়ে থাকতেন। ফিটনেস তাঁকে এতটাই ভোগাত যে, প্রবল ইচ্ছে করলেও ব্যাটটা তুলতে পারতেন না। বলতে গেলে গত মাস আড়াই ঠিকঠাক নেট সেশনটাই পাননি রোহিত শর্মা। মুম্বই টিমের সঙ্গে থেকেছেন সব সময়, টিমের সঙ্গে ঘুরেছেন, কিন্তু নেটে ঢোকার গ্রিন সিগন্যালটা তাঁকে দেওয়া হয়নি। দেননি তাঁর ডাক্তার, তাঁর ফিজিও। মাঠে যেতেন, জুনিয়রদের সঙ্গে আড্ডা মারতেন, পরামর্শ চাইলে দিতেন, আর বাড়ি ফিরতেন অসীম হতাশা নিয়ে।
ব্যাট নিয়ে নামলেন যখন, রোহিত দেখলেন রাস্তাটা আরও কঠিন। ঘড়ির কাঁটা ধরে ব্যাট করতে হচ্ছে, ডাক্তার-ফিজিওর দ্বৈত ‘বস্’ যেটুকু সময় বেঁধে দিয়েছেন, তার চেয়ে এক সেকেন্ড বেশি ভারী ব্যাট হাতে রাখা যাচ্ছে না। “কী অসহনীয় জীবন ওটা, আমি দেখেছি,” আমদাবাদ থেকে ফোনে বলছিলেন রোহিতের কোচ প্রবীণ আমরে। “সময় মেপে দেওয়া হত ওকে। বুঝতে পারতাম, বেশিক্ষণ ধরে ব্যাট করতে চাইছে। কিন্তু উপায় নেই। এক বার এ দিক-ও দিক হলে আবার কোথায় চোট পাবে।”
আড়াই মাস পর রোহিত শর্মার ফিটনেস ঘড়ির কাঁটা ভুলে গেল। থাকল প্রথম থেকে পঞ্চাশ ওভার পর্যন্ত, সাড়ে তিন ঘণ্টার থ্রিলারে এক বারও ডাক পড়ল না ফিজিওর।
ম্যাচের পরে বোর্ডের ফিজিও বৈভব ধাগাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে গেলেন রোহিত। বলে গেলেন, “উনি আজ নিশ্চয়ই খুব খুশি। ফিটনেসে ফেরা যেমন আমার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল, তেমনই ওঁর জন্যও ছিল।” রোহিত আরও এক জনকে ধন্যবাদ দিতে পারেন। মুম্বই টিমের সতীর্থ অভিষেক নায়ার। ফিটনেস ফেরানোর যুদ্ধে যিনি ছিলেন রোহিতের প্রায় রোজকার ‘অভিভাবক’। আমরে বলছিলেন, “রোহিতের ট্যালেন্ট নিয়ে তো কোনও দিন প্রশ্ন ছিল না। ফিটনেসটাই ভোগাত। নির্বাচকদের কাছে এই ইনিংস দিয়ে নিজেকে শুধু ও নতুন করে প্রমাণ করল না। বাকি বিশ্বকেও দেখাল, রোহিত শর্মার পঞ্চাশ ওভার খেলার ফিটনেসটা আছে।”
শুধু কি তাই? কত দিন বাদে সমর্থকদের একটু ছুঁয়ে দেখার আর্তিতে ভিজলেন। কত দিন পর বিপক্ষ অধিনায়ককে বলতে শোনা গেল, রোহিতকে জীবন দেওয়াটাই আমাদের মেরে দিল। কত দিন পর অটোগ্রাফ বুকে সই দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে গেল। ভারত অধিনায়ক পরিচিত মহলে বলে ফেললেন, মনে হচ্ছে গেইলকে দেখলাম। আইপিএলে ওর ১৭৫ মনে করিয়ে দিল রোহিত। কত দিন পর একটা মাঠে এসে সাংবাদিককুলকে বলতে শুনলেন— মাঠ, শহর, সবই তো এখন আপনার। এখানে ফ্ল্যাট কিনবেন?
রোহিত বলে গেলেন, ইডেন তাঁর প্রিয়তম মাঠের একটা। ভবিষ্যতে ভারতীয় দলের হয়ে আরও কীর্তি এখানে রেখে যেতে চান। ছোটবেলায় যখন ক্রিকেট শুরু করেছিলেন, যখন ইন্ডিয়া খেলার স্বপ্ন দেখতেন, ভাবতেও পারেননি এক দিন এমন আসবে যখন তাঁর নামের পাশে লেখা থাকবে ওয়ান ডে ক্রিকেটে দু’দুটো ডাবল সেঞ্চুরি, যা বিশ্বে আর কারও কাছে থাকবে না। “প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা যখন করি, তখন কেউ এক জন বলেছিল আর দশটা রান করলে তুই বিশ্বরেকর্ড করতিস। আজ দুশো পেরোনোর পর একটা সময় দেখলাম ড্রেসিংরুমে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। বুঝলাম, সে দিনের না করা দশটা রান আজ করে ফেলেছি।” একটু থেমে আবার, “আমি ঠিকই করেছিলাম যত বল লাগে লাগুক। ক্রিজ ছেড়ে আজ যাব না। চোট সারিয়ে ফেরার পর চাইনি তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যেতে। ব্যর্থ হওয়া খুব সহজ। সেটা হতে চাইনি। আর রাহানে প্রথম দিকে তুমুল মারায় আমার কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল।” শুনলে কে বলবে, রাহানের সঙ্গে তাঁর বিশ্বকাপের ওপেনিং স্লট নিয়ে অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে?
কিন্তু ব্যাট যদি আবার বিশ্বাসঘাতকতা করে? প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির পর তো দক্ষিণ আফ্রিকায় চরম বিপর্যস্ত হতে হয়েছিল। সামনেই অস্ট্রেলিয়া, যদি আবার...
“এ রকম তো ক্রিকেটারের জীবনে হতেই পারে। সাফল্য আসে, ব্যর্থতাও। কিন্তু একটা কথা বলব, দু’একটা ব্যর্থতায় রোহিত শর্মার থেকে কেউ ক্রিকেটটা কেড়ে নিতে পারবে না!”
ভাবলেশহীন মুখে কথাটা বলে পিছন ফিরে চলে যান রোহিত। এত ওঠা-পড়ার পর এখন বোধহয় এই বিশ্বাসটা তাঁর মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে যে, ক্রিকেট যদি আজকের পর আবার কেউ কেড়েও নেয়, কখনও না কখনও ঠিক সেটা ছিনিয়ে নেবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy