গত বছর উইম্বলডন থেকে ছিটকে যাওয়ার পরে রজার ফেডেরার। ফাইল ছবি
হুবার্ট হুরকাজকে মনে আছে? ৭ জুলাই, ২০২১ দিনটা মনে আছে?
কোনওটাই মনে থাকার কথা নয়। অথচ, রাফায়েল নাদালকে পাশে নিয়ে লেভার কাপে রজার ফেডেরারের অবসরের ক্ষণে সবার আগে এই লোকটার কথা, এই দিনটার কথাই মনে এল। উল্টো দিকে থাকা এই লোকটার জন্য সেই দিনই অঘোষিত অবসর হয়ে গিয়েছিল রাজা রজারের। ৪৪৪ দিন আগে।
সে দিন উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালে হুরকাজের কাছে স্ট্রেট সেটে হেরে গিয়েছিলেন ফেডেরার। সেই হারের সঙ্গে তুলনা হয়েছিল শেষ ইনিংসে ডন ব্র্যাডম্যানের শূন্য রানে বোল্ড হওয়ার। কোনটা বেশি অবাক করার মতো? তর্ক শুরু হয়েছিল। আরও বড় একটা প্রশ্ন সেই সঙ্গে উঠে এসেছিল, অল ইংল্যান্ড ক্লাবের সেন্টার কোর্টে কি তবে আর টেনিসের এই ঐতিহাসিককে দেখা যাবে না? আর দেখা যায়নি। যে সেন্টার কোর্টে রেকর্ড আট বার তাঁর হাতে ট্রফি উঠেছে, সেখানে এই বছর আর খেলতে পারেননি।
পারবেন যে না, সেটা তখনই বোঝা গিয়েছিল। শেষ সার্ভিস করার জন্য যখন এগোচ্ছিলেন, তখন প্রায় পরিপূর্ণ সেন্টার কোর্টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে চিৎকার উঠেছিল, ‘লেট’স গো রজার, লেট’স গো’, ‘কাম অন রজার’, ‘গো অ্যান্ড কনকার’। না, আট বারের উইম্বলডন চ্যাম্পিয়নের কাছে সেন্টার কোর্টে এ সব নতুন কিছু নয়। উইম্বলডনে ১০৫টি ম্যাচ জেতা ফেডেরার এতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এই অভ্যাসগুলোতেই সে দিন ছিল অনভ্যাসের প্রলেপ। তাই আর ‘কনকার’ করতে পারেননি। শেষ সার্ভিস গেমের সঙ্গে আগের ১০৫টি জেতা ম্যাচের কোনও সাযুজ্য ছিল না। সেটা ছিল ব্যাগেল-এর (টেনিসে ০-৬ গেমে হার) বোঝা এড়ানোর সার্ভিস। কিন্তু পারেননি। একটা ভোঁতা ফোরহ্যান্ড ‘ওয়াইড’ হতেই পোল্যান্ডের অখ্যাত হুরকাজ জিতে গিয়েছিলেন ৬-৩, ৭-৬, ৬-০ গেমে। তখন কে বলবে, ফেডেরার যখন প্রথম উইম্বলডন খেলকতে নেমেছিলেন, তখন হুরকাজের বয়স দু’বছর! ব্যাগেলের বোঝা কাঁধে নিয়েই কোর্ট ছাড়তে হয়েছিল ফেডেরারকে।
মোট ৮টি খেতাব। টানা ৫বার চ্যাম্পিয়ন। ২০১৭ সালে একটিও সেট না খুইয়ে চ্যাম্পিয়ন। সেই বছরই ৩৫ বছর ১১ মাস বয়সে চ্যাম্পিয়ন হয়ে সব থেকে বেশি বয়সে খেতাব জয়ের নজির। মোট ১২টি ফাইনাল, টানা ৭টি ফাইনাল, টানা ৭টি সেমিফাইনাল, টানা ৩৪টি সেট জয় (দু’বার), মোট ১১৯টি ম্যাচ খেলা, ১০৫টি ম্যাচ জয়, ২২ বার প্রতিযোগিতায় নামা, এগুলো উইম্বলডনের রেকর্ড। আর এগুলো সবই এক জন মানুষের দখলে, যিনি এই ২৩.৭৭ মিটার X ৮.২৩ মিটারের যুদ্ধভূমিতে ২২ বছর ধরে লড়াই করে বিশ্ব শাসন করেছেন। উপরের পরিসংখ্যানগুলো তারই ফসল। উইম্বলডন মানেই ফেডেরার। সেখানে ব্যাগেলের বোঝাটা সত্যিই অসহনীয় ছিল।
টেনিসের সর্বশ্রেষ্ঠ এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতে পারাটা যেকোনও খেলোয়াড়ের ছোটবেলার স্বপ্ন। কিন্তু ফেডেরারের হাতেই ট্রফি উঠুক, ২০০৩ সাল থেকে উইম্বলডন এই স্বপ্নটা দেখে এসেছে। একবার উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হলে কোনও খেলোয়াড় নিজেকে ধন্য মনে করে। কিন্তু ফেডেরার যত বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, তত বার উইম্বলডন নিজেকে ধন্য মনে করেছে।
সেই অল ইংল্যান্ড ক্লাবে সেটাই ফেডেরারের সব থেকে বড় হার ছিল। ওই মঞ্চে ব্যাগেলও সেই প্রথম। সব গ্র্যান্ড স্ল্যাম ধরলে মাত্র তৃতীয় ব্যাগেল। শেষ ০-৬ গেমে হার ছিল ২০০৮ সালে রাফায়েল নাদালের কাছে ফরাসি ওপেনে। ২০০২ সালের পর থেকে উইম্বলডনে প্রথম স্ট্রেট সেটে হার (সব মিলিয়ে সংখ্যাটা মাত্র তিন)।
বহু তাৎপর্যে জর্জরিত সেই হার ফেডেরারের নিরিখে সর্বার্থে অস্বাভাবিক ছিল। হয়ত সেই কারণে খেলা শেষ হওয়ার পর আর একটুও অপেক্ষা না করে কোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ব্যাগটা নিয়ে বেরনোর আগে শুধু একবার হাত নেড়েছিলেন। অস্বাভাবিক বলেই হয়ত হারার আবেগকে গায়ে মেখে নেওয়ার জন্য নিজের উপস্থিতি দীর্ঘায়িত করতে চাননি। তাই প্রশ্নটা বারবার উঠেছিল, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো? জবাবও হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে গিয়েছিল সেন্টার কোর্ট। সেই জবাবে শুধু আনুষ্ঠানিক শিলমোহর পড়ল এই শুক্রবার।
গত বারের উইম্বলডনে প্রথম রাউন্ডেই ফেডেরার বিদায়ের একটা আবহ তৈরি হয়েছিল। ২-২ অবস্থায় উল্টো দিকে থাকা আর এক অখ্যাত আদ্রিয়ান মানারিনো পা পিছলে পড়ে না গেলে শুরুতেই ছিটকে যেতে পারতেন ফেডেরার। ম্যাচের পর স্বীকারও করে নিয়েছিলেন, হেরে যেতে পারতেন। এরপর রিচার্ড গ্যাসকোয়েট, ক্যামেরন নরি, লরেঞ্জো সনেগোর বিরুদ্ধে জিতলেও কখনওই উইম্বলডনের মঞ্চে মানানসই ফেডেরারকে দেখা যায়নি। বেমানান ফেডেরার আর কোয়ার্টার ফাইনালের বাধা টপকাতে পারেননি সে দিন। পায়ের নড়াচড়ার অধিকাংশই ছিল ভুল। তাতে গতি ছিল না। ভুল শট বাছাই ছিল। শুধু দ্বিতীয় সেটের টাই ব্রেকারটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, সে দিন কতটা নিষ্প্রভ ছিলেন। তৃতীয় সেটের ফেডেরার নিজের স্পিরিট, জেদ, একাগ্রতা, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে লড়াই করার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে নিজেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন।
তার মধ্যেও সেন্টার কোর্টে এক ফেডেরার-ভক্তকে ‘আরও একটা বছর, অন্তত আরও একটা বছর’ বলে আকুতি করতে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সে দিনের সেন্টার কোর্টের চিৎকারে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ আর ‘গুড বাই’-এর বিদায় সম্ভাষণই বেশি মেশানো ছিল। ৪৪৪ দিন আগেই টেনিস থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন তার একচ্ছত্র অধিপতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy