অভিনব: একতার ছবি। ঈশানের জুতো পালিশ করছেন অনুষ্টুপ। নিজস্ব চিত্র
রাজা নেই। আছে যুদ্ধ জয়ের অদম্য ইচ্ছা। তারকা নেই। আছে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার আস্থা। কোনও শর্টকাট নেই, আছে নিষ্ঠা, পরিশ্রম এবং হার-না-মানা লড়াই। আছেন এক গুরু, ও তাঁর ১৬ জন শিষ্য। যাঁদের ক্রিকেট অভিধানে ‘ভয়’ শব্দটির কোনও অস্তিত্ব নেই। শক্তিশালী বিপক্ষ তাদের দমিয়ে দিতে পারে না। শেষ ১৩ বছর যাঁরা ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে কোনও প্রভাবই ফেলতে পারেননি, মঙ্গলবার ইডেনে কর্নাটককে ১৭৪ রানে হারিয়ে রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে পৌছে গেলেন সেই অদম্য ১৬ যোদ্ধা। এটাই বাংলা। যেখানে ক্রিকেট শুধু বড়লোকের খেলা নয়। সাধনাও বটে।
বহু বছর ধরে সাফল্যের অপেক্ষায় ছিলেন বাংলার সমর্থকেরা। মাঠে আসাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবারের ইডেন প্রমাণ করে দিল, ভরসায় ধাক্কা খেলেও ভালবাসা কেড়ে নেওয়া যায়নি। প্রায় দশ হাজার সমর্থক মাঠে এসেছিলেন বাংলার হয়ে গলা ফাটাতে। ৫৬তম ওভারের তৃতীয় বলে আকাশ দীপের ইনসুইং অভিমন্যু মিঠুনের স্টাম্প ভেঙে দিতেই গর্জে উঠল ইডেন। শেষ উইকেট পাওয়া আকাশ বুঝতে পারছিলেন না, কী ভাবে উৎসব করবেন। সতীর্থেরা তাঁকে দৌড়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তিনি থামছেন না। ঠিক যেমন এক জন কে এল রাহুল, এক জন মণীশ পাণ্ডে অথবা এক জন করুণ নায়ার থামাতে পারেননি বাংলাকে।
ড্রেসিংরুম থেকে একে একে বেরিয়ে এলেন রণদেব বসু, উৎপল চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিভ পান, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়েরা। কিন্তু কোথায় সেই যোদ্ধা? যাঁর কঠোর শাসনে মেজাজ হারাতে বসেছিলেন ক্রিকেটারেরা? প্রায় পাঁচ মিনিট উৎসবের পরে ড্রেসিংরুম থেকে হেঁটে বেরোলেন অরুণ লাল। ডান-হাত দিয়ে চোখের কোণে লেগে থাকা জল মুছে নিলেন। তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন আকাশ দীপ, মুকেশ কুমার ও ঈশান পোড়েল। ধারাভাষ্যকার দীপ দাশগুপ্ত ও রোহন গাওস্কর নিজেদের কাজ শেষ করেই নেমে এলেন মাঠে। তাঁরাও হয়তো ফিরে গিয়েছিলেন ১৩ বছর আগে। যখন এই কর্নাটককে ইডেনেই বধ করে ফাইনালে উঠেছিল বাংলা। সে দলের অধিনায়ক ছিলেন দীপ। ম্যাচ শেষে বলছিলেন, ‘‘এই দলের মধ্যে যে এতটা দক্ষতা আছে, তা আগে কেউ ভাবেনি। আমি গর্বিত এই বাংলা পেরেছে। ফাইনালে আমরা হেরে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস, ওরা জিতে ফিরবে।’’ প্রাক্তন অধিনায়ক রোহন গাওস্করও মুগ্ধ, ‘‘অনুষ্টুপের জবাব নেই। পেস ত্রয়ীকে দেখেও আমি গর্বিত। ওরা যে কী করেছে, নিজেরাও জানে না।’’
শুরুতে ‘অতি সাধারণ’ আখ্যা পাওয়া একটি দল কী ভাবে এই অসাধ্য সাধন করল? এই প্রশ্নের পিছনে লুকিয়ে কঠোর পরিশ্রম, আস্থা ও মানসিক দৃঢ়তা। সেই পরিশ্রমের দিনগুলো বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের অজানা। জুলাইয়ের দুপুরে সবাই যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের কোণে বসে হেডফোনে গান শুনেছেন, তখন ঈশান পোড়েল, আকাশ দীপ, মুকেশ কুমারেরা দুপুরের গনগনে রোদকে পরোয়া না করে ফিটনেস বাড়ানোর জন্য নিজেদের নিংড়ে দিয়েছেন। মরসুম শুরু হওয়ার দু’মাস আগে থেকে শুরু হয় বাংলার ফিটনেস ট্রেনিং। কোচ অরুণ লাল এসেই বলে দিয়েছিলেন, ‘‘আমি কোনও তারকা চাই না। চাই একটি দল। যারা বাংলার জন্য নিজেদের উজাড় করে দিতে তৈরি।’’ সিনিয়র ক্রিকেটারদের অনেকেই তাঁর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার তাঁরাই ইডেনে এসে কোচকে আলিঙ্গন করে বলে গেলেন, ‘‘আপনার দেখানো পথে হেঁটেই লাভবান হয়েছি। আশীর্বাদ করুন, ফাইনালেও যেন এ রকম হাসি মুখ নিয়েই ফিরতে পারি।’’
চতুর্থ ইনিংসে ৩৫২ রানের লক্ষ্যে নামা কর্নাটক ভেঙে পড়ল তাসের দেশের মতো। ৯৮-৩ স্কোর থেকে তাদের ইনিংস শেষ হয় ১৭৭ রানে। মণীশ পাণ্ডে, কে ভি সিদ্ধার্থ, এস শরৎ, রনিত মোরে ও প্রতিরোধ দেখাতে থাকা দেবদূতকে ফিরিয়ে ইতিহাস তৈরি করলেন মুকেশ কুমার। মাঠ ছাড়েন আকাশ দীপের কাঁধে বসে। মুকেশের পরিসংখ্যান ২১-৫-৬১-৬। জীবনের সেরা বোলিং করে বাংলার ফাইনালে ওঠার নেপথ্যে তিনিই অন্যতম কান্ডারি। প্রথম ইনিংসে যে দায়িত্ব পালন করেন ঈশান। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলা পেল নতুন এক যোদ্ধাকে।
১৭ বছর আগে এই মুকেশ বাবার হাত ধরে কলকাতায় এসেছিলেন। ট্যাক্সিচালক বাবা ছেলেকে কী ভাবে মানুষ করবেন, জানতেন না। ছেলে ঠিক করে, সে ক্রিকেটার হবে। বাবার শাসনের পরোয়া না করে মাঠকেই বেছে নেন বাংলার পেসার। অনেক উত্থান-পতনের মাঝেও মাথা ঠান্ডা রেখে লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছেন। গত ডিসেম্বরেই মৃত্যু হয়েছে বাবার। তিনি অসুস্থ থাকার সময় শুধু হাসপাতাল ও মাঠের মধ্যেই জীবন আবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরিশ্রমে কোনও খামতি ছিল না। এ দিন সেমিফাইনালে জীবনের সেরা পারফরম্যান্সের পরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ম্যাচের বল দেখালেন। বললেন, ‘‘এই পারফরম্যান্স বাবাকে উৎসর্গ করতে চাই। আমি নিশ্চিত, তিনি দেখছেন।’’ কিন্তু সব চেয়ে প্রভাব বিস্তার করা ব্যক্তিত্ব ম্যাচ শেষেও নির্বিকার। ৬৭-৬ থেকে একা কুম্ভ হয়ে ১৪৯ রান করে লড়াইয়ের জায়গা তৈরি করা অনুষ্টুপ মজুমদার তখন অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত। তাঁর সই সংগ্রহের জন্য গ্যালারি উপচে পড়ছে। যে দৃশ্য রঞ্জির মাঠে কত কাল যে দেখা যায়নি! একের পর এক সই ও নিজস্বীর আবদার মিটিয়ে চলেছেন বাংলার ‘দেওয়াল’। বলছিলেন, ‘‘কখনও এত অটোগ্রাফ দিইনি। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’’
যে ছবি হারিয়েই গিয়েছিল। ভক্তদের আবদার মেটাচ্ছেন বাংলার নায়ক অনুষ্টুপ মজুমদার।
কিন্তু রোজ ব্যাট হাতে রান করার সঙ্গে তাঁর আরও একটি জীবন আছে। সত্যজিৎ রায়ের ভক্ত। গিটার বাজিয়ে গান গাইতে পছন্দ করেন। কবীর সুমনের কোনও কনসার্ট দেখতে ভোলেন না। এমনকি প্রত্যেকটি ম্যাচের আগে সুমনের গান শুনবেনই। তাই ইতিবাচক অনুষ্টুপ বলে গেলেন, ‘‘এত উৎসবে মেতে ওঠার কিছু নেই। এখনও অনেকটা পথ বাকি। বাংলার ক্রিকেটারদের জন্য আমার একটাই বার্তা, হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy