রঞ্জি ফাইনালে বাংলা। —নিজস্ব চিত্র
এক যুগ পার করে রঞ্জি ফাইনালে বাংলা। নতুন দশকে নতুন অধিনায়কের হাতে বাংলা যেন অশ্বমেধের ঘোড়া। সেমি ফাইনাল-সহ ১০ ম্যাচ খেলে জয় এসেছে পাঁচটিতে। সেই জয়ের কাণ্ডারি খুঁজতে গেলে উঠে আসবে বেশ কয়েকটি নাম। আসলে এ বারের বাংলা দলের শিরায় টিম গেমের ইঞ্জেকশনই বোধ হয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন কোচ অরুণ লাল।
বাংলার হয়ে রঞ্জি জেতা অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতেও টিম গেমের সুর। তিনি বলছেন, “প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জ্বলে ওঠার রসদ রয়েছে এই দলটার মধ্যে। বার বার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েও বেরিয়ে এসেছে। এই মানসিক কাঠিন্যই কিন্তু অন্যদের সঙ্গে চ্যাম্পিয়নের পার্থক্য গড়ে দেয়’’।
মরসুম শুরুর আগে নানা বিতর্ক তৈরি হয় দল ঘিরে। সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফির দল থেকে বাদ পড়ে অশোক ডিন্ডার বিস্ফোরক মন্তব্য, ‘‘বাংলার জার্সিতে আর কখনও আমাকে খেলতে দেখা যাবে না। পরের মরসুমে অন্য রাজ্যের হয়ে খেলব’’। প্রথম রঞ্জি ম্যাচে কেরলের বিরুদ্ধে তাঁকে দলে রাখলেও শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বাদ পড়েন দল থেকে। বাংলার অভিজ্ঞ পেসারকে বসিয়ে অরুণ লাল ভরসা রাখেন ঈশান-মুকেশদের উপর। বলে দেন, ‘‘ঈশান পোড়েল, আকাশ দীপ ও মুকেশ কুমার জাতীয় স্তরের সেরা তিন পেসার’’।
এই মরসুমে বাংলার বোলাররা—
কোচের এমন বিশ্বাসের দাম দিয়েছেন তিন জনেই। বাংলার বিরুদ্ধে কোনও দল ২৫০ রান পার করতে পারেনি। কর্নাটকের বিরুদ্ধে সেমি ফাইনাল শেষে এই তিন পেসারের এই মরসুমে মিলিত উইকেট সংগ্রহ ৮২। শামি-ডিন্ডা ছাড়াও যে বাংলার পেসাররা আগুন ঝরাতে তৈরি তার প্রমাণ পাওয়া গেল এ বারের রঞ্জিতেই।
আরও পড়ুন: বিধ্বংসী মুকেশ, ১৭৪ রানে জিতে ১৩ বছর পর রঞ্জির ফাইনালে বাংলা
বাংলার বোলিং-এ শুধু পেসারদের কথা বললে অর্ধেক বলা হয়। দলের হয়ে এ বারের রঞ্জিতে সর্বাধিক উইকেট শিকারিদের মধ্যে রয়েছেন বাঁ হাতি স্পিনার শাহবাজ আহমেদ (৩০টি উইকেট সেমি ফাইনাল শেষে)। মরসুম শুরুর আগে খুব বেশি রঞ্জি অভিজ্ঞতা না থাকলেও কিংবদন্তি ভিভিএস লক্ষ্মণের সার্টিফিকেট ছিল তাঁর বড় সম্বল। এক সাক্ষাৎকারে আহমেদ বলেন, “রবীন্দ্র জাডেজা যে ভাবে ভারতের হয়ে লোয়ার অর্ডারে ব্যাটে ভরসা দেন, আমাদের ব্যাটিং মেন্টর লক্ষ্মণ আমাকে, বাংলার হয়ে সেই ভূমিকাতেই দেখতে চেয়েছেন”। বেন স্টোকসের ভক্ত আহমেদ শুধু ব্যাট নয়, বলেও ভরসা হয়ে উঠেছেন বাংলার।
এই মরসুমে বাংলার ব্যাটসম্যানরা—
অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে মুক্ত মনোজ তিওয়ারি এই মরসুমে যেন নতুন করে চেনালেন নিজেকে। ১০ ম্যাচে গড় ৫১.১০। ট্রিপল সেঞ্চুরি সহ ৬৭২ রান। ভারতীয় দলে নিয়মিত হতে না পারলেও ৩৪ বছরের মনোজ যেন কেরিয়ারের শেষ লগ্নে আরও এক বার নির্বাচকদের মনে করিয়ে দিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে তিনি আজও ছাই চাপা আগুন। অনুষ্টুপ মজুমদার, শ্রীবৎস গোস্বামী, অভিষেক রামনদের সঙ্গে নিয়ে একের পর এক ম্যাচে বাংলাকে জেতার পথ দেখালেন অভিজ্ঞ বড় দাদার মতো।
আরও পড়ুন: এই দলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মশলা রয়েছে, বলছেন সম্বরণ
আলাদা করে বলতেই হবে অনুষ্টুপ মজুমদারের কথা। কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে অবিকল একই চিত্রনাট্য ছিল ‘রুকু’র সামনে। দুটো ম্যাচেই অনুষ্টুপ প্রবল চাপের মুখ থেকে বাংলা শিবিরকে উদ্ধার করেন। কোয়ার্টার ও সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি।
তবে খেই হারালেন অধিনায়ক অভিমন্যু ঈশ্বরন। রঞ্জি শুরুর আগেই ফর্মের খরা চলছিল। ভারত ‘এ’ দলে রাহুল দ্রাবিড়ের পরামর্শে একটা সময় তাঁর ব্যাট ছিল ভরসার জায়গা। অধিনায়কত্বের বাড়তি ওজন কি বোঝা হয়ে দাঁড়াল তাঁর জন্য?
বলা হয় একজন অধিনায়ক ততটাই ভাল যতটা তাঁর দল। আর এই মরসুমে বাংলা অপ্রতিরোধ্য। নাগপুরে বিদর্ভের কাছে ৯ উইকেটে হার যেন শুধু মাত্র অফিসে একটা খারাপ দিন। গত বছর ডিসেম্বরে শক্তিশালী কেরলকে হারিয়ে রঞ্জি শুরু করেছিল ঈশ্বরনের বঙ্গ ব্রিগেড। ইডেনে লোকেশ রাহুল, করুন নায়ার, মণীশ পাণ্ডে সমৃদ্ধ কর্নাটককে সেমিফাইনালে হারিয়ে ১৪ নম্বর বার ফাইনালে তারা।
১৭৪ রানে কর্নাটককে হারিয়ে আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। তবে সেই দূরত্ব এখনও চায়ের কাপ আর ঠোঁটের। কে না জানে পরাজিতকে কেউ মনে রাখেনা। পর পর দু’বার ফাইনালে তুলেও অধিনায়ক দীপ দাশগুপ্ত আজ বিস্মৃত।
ভিডিয়ো—
অধিনায়ক অভিমন্যু ঈশ্বরন কি পারবেন কাপ আর ঠোঁটের সেই দূরত্ব মুছতে। সম্বরণ বলছেন, ‘‘কোচের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তফাত গড়ে দিয়েছে। বাংলাকে এত আগ্রাসী দেখাচ্ছে অরুণের জন্যই।’’ গোটা টিমকে এক সুতোয় বেঁধেছেন অরুণ লাল। বিজয় হাজারে, সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফি জিতলেও রঞ্জি জেতা হয়নি ত্রিশ বছর। ফাইনালে সৌরাষ্ট্র না গুজরাত এখন সেই নিয়ে বোধ হয় ভাববে না বাংলা দল। খারাপ আবহাওয়া, গ্রিন পিচ, স্পিনিং ট্র্যাক,তারা সব বাধাই পেড়িয়ে এসেছে। এখন শুধুই নিজেদের আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে ফাইনালের চাপ কাটিয়ে জিততে চাইবে রঞ্জি ট্রফি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy