Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Simone Biles

কুর্নিশ বাইলসকে, কিন্তু প্রোদুনোভা আরও বিপজ্জনক

কোচকে বুঝতে হবে তার জিমন্যাস্টের ক্ষমতা। থাকতে হবে দু’জনের মধ্যে দারুণ একটা রসায়ন।

মারণ-ভল্টে চমক সিমোনের।

মারণ-ভল্টে চমক সিমোনের।

বিশ্বেশ্বর নন্দী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২১ ০৭:১৮
Share: Save:

রবিবার আগরতলায় বসে সিমোনে বাইলসের ঐতিহাসিক কীর্তির খবরটা পাওয়ার পরে আমার সেই ২০১৬ সালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। রিয়ো অলিম্পিক্সে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম বাইলসকে। দেখেছিলাম ওর অধ্যবসায়, ওর প্রতিভা। জিমন্যাস্টিক্সের প্রতি ওর ভালবাসা। এগুলো না থাকলে সাফল্যের শিখরে ওঠা যায় না। ওকে কুর্নিশ জানাতেই হবে।

আমেরিকার জিমন্যাস্ট বাইলস অনেক দিন আগেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। তাও রবিবারের পরে এই ২৪ বছরের মেয়েটিকে নিয়ে কেন এত হইচই? কারণ একটাই। ইন্ডিয়ানাপোলিসে ইউএস ক্ল্যাসিক্স জিমন্যাস্টিক্সে বাইলস যে ভল্টটি দিয়ে সাড়া ফেলেছে, তার নাম ‘ইউরচেঙ্কো ডাবল পাইক’। ভল্টটা এতটাই কঠিন আর ঝুঁকির যে, কোনও মেয়ে এর আগে দিতে সাহস করেনি। মাটিতে নামার সময় একটু গণ্ডগোল হলেই ঘাড়ে, মাথায় চোট লেগে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিক্সের ভিতরের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন, বছর দুয়েক হল এই ভল্টটা নিখুঁত করার জন্য লড়ছে বাইলস। তাই ওর এই কীর্তিতে অভিভূত হলেও বিস্মিত হইনি।

এ রকম কঠিন একটা ভল্ট দিতে গেলে এক জন জিমন্যাস্টের যে রকম প্রতিভা দরকার, সে রকমই প্রয়োজন সাহস আর আত্মবিশ্বাসের। কোচের নির্দেশের উপরে ভরসা রাখতে হবে ছাত্র-ছাত্রীকে। আর কোচকে বুঝতে হবে তার জিমন্যাস্টের ক্ষমতা। থাকতে হবে দু’জনের মধ্যে দারুণ একটা রসায়ন।

বিপজ্জনক ভল্ট শেখানোর ব্যাপারে আমার একটু অভিজ্ঞতা আছে! দীপা কর্মকার আর প্রোদুনোভা ভল্টের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে! যা সাড়া ফেলে দিয়েছিল রিয়ো অলিম্পিক্সে।

ইউরচেঙ্কো ডাবল পাইক আর প্রোদুনোভার মধ্যে কোনটা বেশি বিপজ্জনক? আমি বলব, প্রোদুনোভা। নিজের ছাত্রী ভল্টটা দিয়েছিল বলে নয়, সামনের দিকে মুখ করে মাটিতে নামাটা সব সময় কঠিন। প্রোদুনোভায় ডাবল সমারসল্টের পাশাপাশি সব মিলিয়ে তিনটে ‘ফ্রন্ট ফ্লিপ’ করতে হয় তিন সেকেন্ডের মতো সময়ে। ডাবল পাইকে নামতে হয় মুখটা পিছনের দিকে রেখে। দু’বার শরীরকে ঘোরাতে (ফ্লিপ) হয় কোমর ভেঙে এবং হাঁটু-পা সোজা রেখে। দুটোর ক্ষেত্রেই মাটিতে নামার সময় চোট লেগে যাওয়ার বড় আশঙ্কা থাকে। সাধে কি ‘মারণ-ভল্ট’ বলা হয়!

বাইলসের একটা কথা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। সে বার অলিম্পিক্সে সোনাজয়ীর ওই মন্তব্যটা নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বাইলসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি প্রোদুনোভা ভল্ট দেন না কেন? জবাবে সর্বকালের অন্যতম সেরা জিমন্যাস্ট বলেছিল, ‘‘আমি মরতে চাই না।’’ এর পরে নিশ্চয়ই বোঝাতে হবে না প্রোদুনোভা কতটা কঠিন আর ঝুঁকির ভল্ট।

কোন পরিস্থিতিতে এসে এক জন কোচ আর তাঁর ছাত্রী মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এ রকম কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়? প্রথমেই বলি, ১০-১২ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনও জিমন্যাস্টের পক্ষে এই ধরনের ভল্ট দেওয়ার কথা ভাবাও উচিত নয়। সে জায়গায় পৌঁছনোর পরে কেউ হয়তো ইতিহাসে ছাপ রেখে যাওয়ার জন্য ব্যতিক্রমী কিছু করতে চায়। কেউ বা বঞ্চনার জবাব দিতে চায়।

আমার আর দীপার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাই হয়েছিল। ২০১৪ সালের কথা। ভারতীয় পুরুষ দলের প্রধান কোচ তখন ছিলেন জিম হল্ট। উনি এক বার বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের মেয়ে জিমন্যাস্টরা তো স্রেফ বেড়াতে আর খেতে আসে।’’ কথাটা এত খারাপ লেগেছিল যে, চোখে জল এসে গিয়েছিল। পরের দিনই দীপাদের ডেকে পাঠাই। বলি, এর জবাব দিতে চাও? আর না চাইলে আমি কালকেই শিবির ছেড়ে চলে যাব। দীপা-অরুণা (রেড্ডি), ওরা সবাই আমার পাশে ছিল। তার পরে ইউটিউব দেখে প্রোদুনোভা ভল্টটা পছন্দ করি। কঠিন এবং বিপজ্জনক হলেও ঠিক মতো দিতে পারলে ভাল পয়েন্ট পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। দীপার নমনীয়তা আর ক্ষিপ্রতা দেখে মনে হয়েছিল, ও ঠিক পারবে। জিম হল্ট তো একবার এসে বলেন, ‘তুমি কি মেয়েটাকে মেরে ফেলতে চাও?’ কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। ২০১৪ গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে ব্রোঞ্জ পেয়ে দীপা প্রমাণ করে দিয়েছিল, আমরা ভুল পথে হাঁটছি না।

বাইলসরা একটা ব্যাপারে সব সময় আমাদের থেকে এগিয়ে থাকবে। ওদের পরিকাঠামো এবং আর্থিক সঙ্গতি আমাদের চেয়ে অনেক ভাল। ভারতে প্রতিভাবান জিমন্যাস্ট এবং কোচের অভাব নেই। এই তো প্রণতি নায়েক অলিম্পিক্সে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে গেল। প্রণতি এবং ওর কোচ মিনারা বেগমকে আমার অভিনন্দন। আমাদের দরকার ভাল পরিকাঠামোর। আবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আন্তরিক অভিনন্দন। পাশাপাশি অনুরোধ, একটা আন্তর্জাতিক মানের জিমন্যাস্টিক্স হল বাংলায় বানিয়ে দেওয়ার। তা হলে দেশের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের প্রতিশ্রুতিমান জিমন্যাস্টরা অনেক উপকৃত হবে।

শেষে একটা কথা বলব। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে বাইলস যদি ইউরচেঙ্কো ডাবল পাইক ভল্টটা ঠিকঠাক দিতে পারে তা হলে সবাইকে অনেক পিছনে ফেলে সোনা জিতবেই।

(লেখক রিয়ো অলিম্পিক্সে চতুর্থ হওয়া জিমন্যাস্ট দীপা কর্মকারের দ্রোণাচার্য পুরস্কার জয়ী কোচ)

অন্য বিষয়গুলি:

Simone Biles Produnova Vault
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy