Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

পুনর্জন্মের প্রজ্ঞানে মুগ্ধ বাংলা

তিনি তারকা বটে, কিন্তু তারকা নন। আধুনিক ক্রিকেট-ধর্ম মেনে ট্যাটু ক্লাবে নাম লেখাননি। সেকেন্দ্রাবাদে নতুন বাড়ি তৈরিতে ‘বাস্তুশাস্ত্র’ মানার পারিবারিক আব্দার তাঁর কাছে প্রবল গুরুত্ব পায়।

প্রজ্ঞানকে ঘিরে বাংলার ক্রিকেটারদের উচ্ছ্বাস। মঙ্গলবার সল্টলেক মাঠে।  ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

প্রজ্ঞানকে ঘিরে বাংলার ক্রিকেটারদের উচ্ছ্বাস। মঙ্গলবার সল্টলেক মাঠে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

তিনি তারকা বটে, কিন্তু তারকা নন।

আধুনিক ক্রিকেট-ধর্ম মেনে ট্যাটু ক্লাবে নাম লেখাননি। সেকেন্দ্রাবাদে নতুন বাড়ি তৈরিতে ‘বাস্তুশাস্ত্র’ মানার পারিবারিক আব্দার তাঁর কাছে প্রবল গুরুত্ব পায়। নিয়মিত হায়দরাবাদ-কলকাতা করেন বলে শহরে তাঁর ঠিকানা এখনও এক অভিজাত হোটেল, যেখানে থাকেন বিনা অনুযোগে। সিএবি ফ্ল্যাট দেখছে। আর নতুন ঠিকানায় আপাতত একটা জিনিসেরই দরবার করছেন— একজন রান্নার লোক!

মানুষ প্রজ্ঞান ওঝাকে চেনা গেল?

তাঁর সঙ্গে যা হয়েছিল, এত দিনে ক্রিকেটজীবনের ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। সুনীল নারিন তো আজও পারলেন না। বঙ্গ স্পিনের বাঁ হাতিকে সেখানে ব্যতিক্রম ধরতে হবে। অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন গত ডিসেম্বরে। বোর্ডের সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে যুদ্ধটা সহজ ছিল না। এখনও অভিশপ্ত ওই সময়ের প্রসঙ্গ উঠলে শিউরে বলে ওঠেন, ‘‘জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়।’’ টিম ইন্ডিয়ার টেস্ট সংসার থেকে ‘বিতাড়িত’ হয়েছিলেন। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স রাখেনি। হায়দরাবাদের স্থানীয় ক্রিকেট খেলতে হয়েছে প্রত্যাবর্তনের যুদ্ধে। আর শুধুমাত্র ‘প্রচেষ্টায়’ সেটা আটকে থাকেনি।

বাংলা টিম ম্যানেজমেন্টের একজন বলছিলেন, এত বড় স্পিনার হয়েও নেটে ‘পার্সেন্টেজ ক্রিকেটের’ ব্যাপার থাকে না। এক থেকে এগারো সবাইকে টানা বল করতে উন্মুখ হয়ে থাকেন। যাতে ম্যাচে পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ ওভার করতে অসুবিধে না হয়। আর একটা জিনিস দেখেও এঁরা আশ্চর্য হয়েছেন। বঙ্গ স্পিনার ম্যাচে অনেক সময়ই পয়েন্টে ফিল্ডার না রেখে ওভারের পর ওভার করে যান। ব্যাটসম্যান তাঁকে কাট মারতে পারবে না— এতটাই নাকি আত্মবিশ্বাসী। বিদর্ভের বিরুদ্ধে তাঁর বোলিং-তেজ দেখে ক্রিকেটমহলে বলাবলি চলছে পদ্মাকর শিভালকর, দিলীপ দোশীদের এ সব করতে দেখা যেত।

তবে ক্রিকেটমহলের সবচেয়ে আশ্চর্যের ঠেকছে তাঁর প্রত্যাবর্তন-পরবর্তী জীবন। যেখানে একটাই শব্দ— সাফল্য। শোনা গেল, বাংলা-বিদর্ভ ম্যাচে আসা জাতীয় নির্বাচক সাবা করিম নাকি ঘনিষ্ঠমহলে স্বীকার করে গিয়েছেন, অ্যাকশন শুধরে এত ঝকঝকে প্রত্যাবর্তন কাউকে করতে দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না। অথচ বোলার স্বয়ং? জাতীয় দল, আবার ইন্ডিয়া সংসার নিয়ে ভাবেনই না। দীপাবলির সন্ধেয় সল্টলেক মাঠে বলেও দিলেন, ‘‘মানুষের মনে প্রত্যাশা থাকলে সে হাঁসফাঁস করতে থাকে। আমি ও সবের মধ্যে নেই। জাতীয় দল নিয়ে ভাবিই না। পারফরম্যান্স নিয়ে ভাবি। যে কারণে আমাকে আনা হয়েছে।’’

ক্রিকেটার প্রজ্ঞান ওঝাকে বোঝা গেল?

এক বঙ্গ নির্বাচক মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলা টিম তখন শ্রীলঙ্কা সফরে। বাংলার উদীয়মান বাঁ হাতি স্পিনার প্রদীপ্ত প্রামাণিকের কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছিল। ভারতীয় টিমের প্রাক্তনকে বলামাত্র তিনি প্রদীপ্তকে নিয়ে পড়ে যান। এটা ভুলে যে, যাঁকে শুধরোতে ব্যস্ত, তিনিও এক বাঁ হাতি স্পিনার। কোনও এক দিন প্রতিদ্বন্দ্বীও হতে পারেন। বলা হচ্ছে, এটাই বড় ক্রিকেটারের গুণ। যে নিজের জায়গা নিয়ে টেনশনে না থেকে পরের প্রজন্মকে তৈরি করে। ঘটনা। বর্তমান বাংলার এক নম্বর স্পিনার হয়েও তো নিজেকে এক নম্বর ভাবেন না তিনি। উল্টে জবাব আসে, ‘‘নিজেকে এক নম্বর ভেবে কী হবে? আমি কেমন পারফর্ম করলাম, সেটাই আসল। আমার কাছে টিম আগে, আমি পরে। আজকের জয়টা আমার কাছে নিশ্চয়ই স্পেশ্যাল। কিন্তু আমার কাছে নিজের সেই পারফরম্যান্সটাই গুরুত্বপূর্ণ যেখানে টিম জেতে।’’

টিমম্যান প্রজ্ঞান ওঝাকে চেনা গেল?

অথচ এই ওঝাকেই বঙ্গে পদার্পণের সময় ময়দানের একাংশের সমালোচনা হজম করতে হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তিনি তো ‘বহিরাগত’। কী লাভ এনে? আসলে সিএবি তখন একজন ভাল স্ট্রাইক বোলার খুঁজছিল। ওঝা খুঁজছিলেন রঞ্জি এলিট টিমের প্ল্যাটফর্ম, যা তাঁকে জাতীয় দলের দরজা খুলে দেবে। প্লেটের হায়দরাবাদ দিয়ে যা হত না।

মণিকাঞ্চন যোগটা হয়েও যায়। তৎকালীন সিএবি যুগ্ম সচিব সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং ভিশন ২০২০ ব্যাটিং কোচ ভিভিএস লক্ষ্মণ নিয়ে আসেন ওঝাকে। মানে, বোলিংয়ের পরশপাথরকে। পাঁচ ম্যাচে এখনই ২১ উইকেট, বিদর্ভের বিরুদ্ধেই এগারোটা। মনে হয় আজ ময়দানি সমালোচনার জবাব দিলেন? লাজুক হেসে নায়ক উত্তর দেন, ‘‘এটা নিয়ে আমি কী বলব?’’ একটু থেমে যোগ করেন, ‘‘এ সব যে ছিল জানি। কিন্তু আমি মন দিয়েছিলাম পারফরম্যান্সে। নিজেকে বলতাম, তুমি এখানে ভাল কিছু করতে এসেছ। দাদা (সৌরভ) সমাদরে নিয়ে এসেছে। পারফর্ম করা তো আমার দায়িত্ব ছিল।’’

যা শুনে ময়দান বলছে, এটাই বাংলার নতুন প্রজন্মের তাঁর থেকে শেখার। উচ্চবিত্ত হয়েও নিজেকে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বৃত্তে আটকে রাখাটাই তো শিক্ষণীয়। শিক্ষণীয়, ঘা খেয়েও অদম্য মনোভাব অটুট রাখার কলজেটা।

পুনর্জন্মের প্রজ্ঞান ওঝাকে বোঝা গেল?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE