জায়গাটার নাম শোনামাত্র একটু কেঁপে যান হোটেল রিসেপশনিস্ট। ভ্রূ কুঁচকে প্রবল সন্ধিগ্ধ ভাবে পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, “কেন, ওখানে কী দরকার আপনার? কী করতে যাবেন?”
সাংবাদিক শুনে ভ্রূ সোজা হয়। সন্দেহের ভিড় সরিয়ে এ বার উপস্থিত হয় উপদেশ। কেউ নাকি যায় না ওখানে। গেলে, কেউ সর্বস্ব হারিয়ে ফেরে। কাউকে আবার অকারণ ঘুরঘুর করতে দেখলে সোজা ভ্যানে তুলে নেয় পুলিশ। ভদ্র ফরাসি-সমাজের বসবাস নেই। অফিস নেই। অভিজাত শপিং মল নেই। খাবারের ভাল দোকান নেই। লোকে যাবে কী করতে? মাদকাসক্তদের শুধু ওখানে দেখা যায়। গাঁজা-কোকেন-হেরোইনের অত বড় ‘সুপারমার্কেট’ গোটা মার্সেইয়ে যে আর কোথাও নেই!
“দেখুন, একান্ত যেতে চাইলে ট্যাক্সি ডেকে দেব। কিন্তু ফেরা নিয়ে কোনও গ্যারান্টি দেব না,” একটার পর একটা চরম সতর্কবার্তা ছুঁড়তে থাকেন হোটেল কর্তা। কেন, এত আতঙ্ক কেন? “আরে, পুলিশ পর্যন্ত পারে না ওদের সঙ্গে। রোজ ঝামেলা। রোজ কাউকে না কাউকে ধরে কোর্টে চালান করছে। মার্সেইয়ের কলঙ্ক জায়গাটা!”
কলঙ্ক, লা কাস্তেলান তা হলে এখন মার্সেইয়ের কলঙ্ক! জিনেদিন জিদানের জন্মস্থানকে এখন তা হলে পূতিগন্ধময় মনে হয় মার্সেইবাসীর!
গুগল সার্চ দিলে দেখা যায়, ফরাসি কিংবদন্তির আদিবাড়িটা আর এখন নেই। বহু দিন ধরে ভাঙার তোড়জোড় চলছিল, ভেঙেও দিয়েছে শেষ পর্যন্ত। সবুজ রঙা ‘জি’ বিল্ডিং, লোকজন যাকে জানত ‘জিদান বিল্ডিং’ নামে তাকে আর রাখতে ভরসা পায়নি ফরাসি সরকার। কারণ, গর্বের জিদান বিল্ডিং আদতে দিন-দিন হয়ে উঠছিল অন্ধকারের পৃথিবীর অবাধ বিচরণভূমি। মাদকদ্রব্যের মুক্তাঞ্চল। ইউরো ফেললে যেখান থেকে হেরোইন নিয়ে ফেরা কোনও ব্যাপার না। বহু খুঁজে জিদান-প্রতিবেশীদের নিয়ে এক ফরাসি সাংবাদিকের অভিজ্ঞতার কথা পাওয়া গেল। ভদ্রলোক গিয়েছিলেন, জিদানের ছোটবেলা নিয়ে আর্টিকেল লিখতে। প্রতিবেশীদের থেকে ছোট ‘জিজু’-র জিনেদিন জিদান হয়ে ওঠা নিয়ে শুনতে। ফিরেছেন স্থানীয়দের হুমকি আর প্রবল দাঁত খিচুনি নিয়ে!
এর পর ভিনদেশি সাংবাদিক লা কাস্তেলান যাওয়ার মতো সাহস খুঁজে পাবে না হয়তো। কিন্তু মনে হবে, এত বড় ফুটবল-সাধকের বাড়িটা ভেঙে ফেলা কি খুব দরকার ছিল? পুলিশ পেট্রোল দিন-রাত পড়ে থাকে ওখানে। নিরাপত্তা বাড়িয়ে বাড়িটা রাখা কি যেত না? এত দিন তো ছিল। মার্সেই— সে কিছু বলে না?
ছবির মতো ফুটফুটে সুন্দর শহরটা এমনিতে তো জিদান নিয়ে কত কথা বলে। এ শহরের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের একটা হল, অচেনা-অজানার জন্যও চরম ঝাঁপিয়ে পড়া। রাস্তা চিনতে পারছেন না? কুড়ি বছরের যুবক সাইকেলে বসিয়ে পৌঁছে দেবে। আবার জিদান জানতে চান, হটডগের দোকান খোলা বন্ধ রেখে মধ্যবয়স্ক বলতে শুরু করবেন জিদানকে আগে লোকে ডাকত ইয়াজিদ! পাঁচ ভাই ছিলেন জিদানরা। মার্সেই জনতা জানে, জিদানের দাদার এক বন্ধু ছিল যাকেও দেখতে অনেকটা জিদানের মতো! ভদ্রলোককে এখনও লা কাস্তেলানে পাওয়া যায়। মার্সেই সব জানে, মার্সেই সব খবর রাখে।
আসলে সৌরভ নিয়ে যেমন অপত্যস্নেহে বিভোর হয়ে থাকে কলকাতা, সচিন শুনলে যেমন পেশাদারিত্বের বর্ম নামিয়ে বেরিয়ে পড়ে তুলোয় মোড়া মুম্বই, ইউরোপের এই শহরও জিদান নিয়ে তাই। আবেগের লেখচিত্রে কোনও পার্থক্য পাওয়া যায় না। এত আদরের ‘জিজু’ এখন আর অত মার্সেই আসেন না, তবু। মাদ্রিদ এখন তাঁর নতুন কর্মস্থল, জীবনের নতুন বিচরণভূমি। খারাপ লাগে না? যে কাউকে জিজ্ঞেস করুন, শুনবেন যে, অসুবিধে কী আছে? জীবন জীবনের জায়গায়, ভালবাসা ভালবাসার জায়গায়। মাদ্রিদে আছেন মানে জিদান যে মার্সেই ভুলে গিয়েছেন, এমন নয়। তাঁর স্ত্রী স্পেন-জাত, দুই ছেলে ভর্তি হয়েছে স্পেনের অ্যাকাডেমিতে, তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবে কোচিং করাচ্ছেন। জিদান ফ্রান্সে পড়ে থেকে করতেন কী? বরং মার্সেই মনে করে, তাদের চিরকালীন গর্বের মিনার দু’টো। প্রথম, অলিম্পিক দে মার্সেই। ফুটবল ক্লাব। দ্বিতীয় জিদান। মার্সেইয়ের ফুটবল-অমরত্বের প্রতিনিধি।
তা হলে? একই মার্সেই জিদান-বিল্ডিং নির্বিচারে বুলডোজারের তলায় চলে যেতে দিল?
দিল, কারণ একই মার্সেই মনে করে, জিদানের বাড়িটা ভেঙে ফেলে ঠিকই করেছে সরকার। ‘জি’ বিল্ডিংয়ের বর্তমান বাসিন্দাদের সরিয়ে ঐতিহ্য রক্ষার কোনও প্রয়োজন ছিল না!
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ যে এখানে কী ভীষণ ‘জনপ্রিয়’ তা এ দেশে না এলে বোঝা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ফ্যান জোনে ফ্রান্সের ম্যাচে ওঁলাদকে দেখামাত্র ঠোঁটের কাছে দু’হাত নিয়ে গিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ বার করে ফরাসিরা----‘বুউউউ’! বিদ্রূপ, পরিশুদ্ধ বিদ্রূপ। আসলে ধর্মঘট থেকে উদ্বাস্তু নানা সমস্যায় এত জর্জরিত ওঁলাদ রাজত্ব যে খোঁজ না নিয়েই লিখে দেওয়া যায়, আঁতোয়া গ্রিজম্যান এই মুহূর্তে ওঁলাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ালে হাসতে-হাসতে জিতে যাবেন। সে দেশের এই শহর মনে করে, ওঁলাদ রাজত্বে এই একটা কাজের কাজ হয়েছে। জিদানের বাড়িটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কারণ বাস্তব আগে, জিদান-আবেগ পরে।
প্রাডো বিচ ধরে হাঁটতে-হাঁটতে জর্জ প্যাট্রিক নামের এক ভদ্রলোককে পাওয়া যায়, ইংরেজিটা যিনি মোটামুটি বলতে পারেন। বলছিলেন, “রেখে কী হত? আফ্রিকান, আলজিরিয়ানে ওই অঞ্চলের অবস্থা যা হয়েছে, বলার নয়। বাড়িটা রাখলে ওখানে ড্রাগের আসর বসত না, কে বলতে পারে?” হেনরিক্স নামের আর এক যুবককে পাওয়া যায়, যিনি বহু দিন অতীত হয়ে গেলেও আজও জিদান-ভক্ত। ইংরেজিতে অসুবিধে, গুগল ট্রান্সলেটরে তাঁর উত্তর টাইপ হয়ে বেরিয়ে আসে— আমি জিদানকে ভালবাসি। কিন্তু আমার কাছে আমার শহর আগে। মার্সেই এক, জিজু দুই!
শোনা গেল, শুধু মাদকদ্রব্য নয়। চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি ওখানে পয়সা দিয়ে কোক কিনে নেওয়ার মতো স্বাভাবিক ঘটনা, রোজনামচা। লোকে খেতে পায় না ওখানে, সাত হাজার বাসিন্দাদের অধিকাংশ বসবাস করে দারিদ্রসীমার নীচে। জিদান-ঐতিহ্যে যাদের পেট চলে না, হিংস্র ক্ষুধার তাড়না ভুলিয়ে দেয় বিখ্যাত বাঁ পা, ভুলিয়ে দেয় তার রোম্যান্স।
মার্সেই এ ভাবে জিদান বাঁচিয়ে রাখতে চায়নি। মার্সেই তাই তাঁর জন্মস্থান আর রাখেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy