প্যারিসে রুপো নীরজ চোপড়ার। ছবি: পিটিআই।
টোকিয়ো অলিম্পিক্সের আগে ক্রিকেট-পাগল দেশ জ্যাভলিনের কথা কতটা শুনেছিল তা নিয়ে সন্দেহ আছে। গোটা দেশকে নীরজ চোপড়া চিনিয়েছিলেন জ্যাভলিন থ্রো। তিন বছর এক দিন (২০২১ সালের ৭ অগস্ট অলিম্পিক্সে সোনা জিতেছিলেন নীরজ) আগে টোকিয়ো অলিম্পিক্সে যে খেলা দেশবাসী চিনেছিল, বৃহস্পতিবার ছিল সেই জ্যাভলিন থ্রোয়ে ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার লড়াই। কিন্তু ৮৯.৪৫ মিটারে থেমে গেলেন নীরজ। রুপো নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল তাঁকে। সোনা পেলেন পাকিস্তানের আরশাদ নাদিম।
টোকিয়ো অলিম্পিক্সের আগে বছরের পর বছর ধরে বহু ভারতীয় ক্রীড়াবিদ ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে অলিম্পিক্সে গিয়েছেন। কিন্তু নর্ম্যান প্রিচার্ড ছাড়া কেউ সাফল্যের মুখ দেখেননি। ভারতের হয়ে খেললেও তিনি ছিলেন ব্রিটিশ। ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিক্সে জোড়া পদক জিতেছিলেন প্রিচার্ড। তিনি ছাড়া ১২৫ বছরের ইতিহাসে কোনও ভারতীয় ক্রীড়াবিদ ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে পদক আনতে পারেননি। সেই চিত্রটাই বদলে দিয়েছিলেন নীরজ। অ্যাথলেটিক্সে তাঁর হাত ধরে প্রথম সোনা এসেছিল দেশে।
কথায় বলে, এক নম্বর হওয়ার থেকেও বেশি কঠিন সেই জায়গাটা ধরে রাখা। টোকিয়োয় নীরজ রাজা হয়েছিলেন। প্যারিসে জ্যাভলিনে সেই রাজত্ব ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। লড়াই কঠিন ছিল। পাকিস্তানের আরশাদ নাদিম, চেকিয়ার ইয়াকুব ভাদলেচ, গ্রানাডার অ্যান্ডরসন পিটার্স, জার্মানির জুলাইন ওয়েবারদের হারিয়ে জেতা একেবারেই সহজ ছিল না। আশা ছিল একটাই, নীরজ জিততে জানেন। যোগ্যতা অর্জন পর্বে ৮৯.৩৪ মিটার দূরে জ্যাভলিন ছুড়ে সরাসরি যোগ্যতা অর্জন করেন তিনি। সেই সময়ই দেখা গিয়েছিল কী সহজে নীরজ নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে গেলেন। কিন্তু ফাইনালে সেই ধারা বজায় রাখতে পারলেন না তিনি।
২০২১ সালের টোকিয়ো অলিম্পিক্সের ৭ অগস্ট সোনা জিতেছিলেন নীরজ। তার পর থেকেই নীরজ এবং জ্যাভলিন নিয়ে উৎসাহ দেখা যায়। এই খেলা সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ রাখতে শুরু করেন অনেকে। তাঁদের হতাশ করেননি নীরজ। একের পর এক প্রতিযোগিতায় সোনা জিতেছেন তিনি। ২০২২ সালে এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছিলেন। সেই বছর ডায়মন্ড লিগেও সোনা জিতেছিলেন। তবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রুপো নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল তাঁকে। গত বছর যদিও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতে নেন নীরজ। সেই বছর ডায়মন্ড লিগে আবার রুপো পান তিনি। গত বছর দেশের মাটিতেও লড়াইয়ে নেমেছিলেন নীরজ। ফেডারেশন কাপে সোনা জিতেছিলেন। বার বার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিলেন নীরজ।
টোকিয়ো অলিম্পিক্সের পরেই প্যারিসের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। সোনা জেতার পর জীবনটা রাতারাতি পাল্টে গিয়েছিল তাঁর। বাণিজ্যিক এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার চাপ সামলাতে সামলাতে নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন। অনুশীলনে ফিরতে সময় লেগেছিল অনেকটাই। সেই ভুল আর করতে চাননি নীরজ। পাখির চোখ করেছিলেন প্যারিস অলিম্পিক্সে সোনা। নিজেকে নিংড়ে দিতে মরিয়া ছিলেন ভারতের জ্যাভলিন থ্রোয়ার। ২০২২ সালে ডায়মন্ড লিগে সোনা জিতে তিনি বলেছিলেন, “গত বছর একটা নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। ভারসাম্য রাখাই মুশকিল হয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে অনেক কিছু শিখেছি। এ বার বাণিজ্যিক কাজের জন্য নির্দিষ্ট কিছু তারিখ দেব। অনুশীলনের সময় এলে পুরোপুরি তাতেই মনোযোগ দেব, যাতে প্রস্তুতি সঠিক ভাবে হয়। খুব বেশি বিশ্রাম নিতে চাইছি না। তাড়াতাড়ি অনুশীলন শুরু করে দিতে চাই। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঠিক করেছি বেশি খাব না।”
একটি সাক্ষাৎকারে নীরজ বলেছিলেন, “অস্বাস্থ্যকর কিছু খেলেই আমি আমার প্রশিক্ষকের কাছে ধরা পড়ে যাই। আমাকে তার জন্য যথেষ্ট খেসারতও দিতে হয়।” কী এমন খান? তাতে কি সমস্যা হয় বেশি? উত্তর দিয়েছেন নীরজ নিজেই। বলেছেন, “অলিম্পিকের পর আমার ওজন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। অবশ্য খাওয়াদাওয়া এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। আসলে এক বার শরীরচর্চা করতে শুরু করলে অস্বাস্থ্যকর কিছু খাবার খাওয়ার ইচ্ছেটাই থাকে না।’’ প্যারিসের কথা মাথায় রেখেই নীরজ এই পরিশ্রম করেছিলেন। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে তাঁকে প্রত্যাশার চাপ সামলাতে হয়নি। প্যারিসে সেই চাপটাও ছিল নীরজের উপর।
নীরজকে তৈরি করার নেপথ্যে ছিলেন পাঁচ কোচ। তাঁদের হাত ধরেই প্রথমে টোকিয়ো এবং তার পর প্যারিসে পদক জয়ের স্বপ্ন সত্যি করলেন তিনি। নীরজের প্রথম গুরু জয়বীর সিংহ। হরিয়ানার খান্দ্রায় জন্ম নীরজের। সেখানেই থাকতেন জয়বীর। তিনিই প্রথম কিশোর নীরজের প্রতিভা বুঝতে পারেন ও তাঁকে জ্যাভলিনের প্রাথমিক পাঠ দেন। জয়বীরের অধীনেই জ্যাভলিনের প্রতি ভালবাসা জন্মায় নীরজের মনে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের ভিত তৈরি করেছিলেন জয়বীর।
১৪ বছর বয়সে হরিয়ানার পঞ্চকুলার তাউ দেবীলাল স্পোর্টস কমপ্লেক্সে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন নীরজ। জোরে জ্যাভলিন ছোড়ার প্রথম অনুশীলন সেখানেই হয় নীরজের। সেই পাঠ দিয়েছিলেন নাসিম আহমেদ।
২০১৬ সালে পোল্যান্ডে বিশ্ব অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতেন নীরজ। ওই বয়সেই ৮৬.৪৮ মিটার জ্যাভলিন ছোড়েন তিনি। সেই সময় অস্ট্রেলিয়ার গ্যারি কালভার্টের কাছে প্রশিক্ষণ নিতেন নীরজ। যদিও বেশি দিন কালভার্টের কাছে শিখতে পারেননি ভারতীয় অ্যাথলিট। কারণ, ২০১৮ সালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় কালভার্টের। সেই সময় চিনের জাতীয় দলের কোচ ছিলেন কারভার্ট।
নীরজকে তৈরি করার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় নাম জার্মান কিংবদন্তি উই হন। ২০১৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হনের কাছে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। জ্যাভলিনের ইতিহাসে হনই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ১০০ মিটারের বেশি ছুড়েছেন। ১৯৮৪ সালে বার্লিন অলিম্পিক্সে ১০৪.৮ মিটার দূরে জ্যাভলিন ছুড়েছিলেন তিনি। হনের অধীনে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছিলেন নীরজ। নিজেও পরে সে কথা বলেছেন ভারতীয় তারকা। ২০১৯ সাল থেকে নীরজের কোচ ক্লাউস বারটোনিয়েজ। তাঁর প্রশিক্ষণেই টোকিয়ো অলিম্পিক্সে সোনা জিতেছিলেন তিনি। বায়োমেকানিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে নীরজকে আরও উন্নত কৌশল শিখিয়েছেন বারটোনিয়েজ। তার ফল দেখা গিয়েছে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে। ১০০ শতাংশ ফিট না হওয়ার পরেও সোনা জিততে সমস্যা হয়নি ভারতীয় জ্যাভলিন থ্রোয়ারের। প্যারিসেও নীরজের কোচ ছিলেন তিনিই।
প্যারিস অলিম্পিক্সের আগে নীরজের চিন্তা ছিল চোট নিয়ে। দেশের মাটিতে প্রতিযোগিতায় নেমে সোনা জিতলেও তখনই পেশিতে সমস্যা টের পেয়েছিলেন। সেই সমস্যা অনুশীলনে আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই অলিম্পিক্সের আগে সতর্কতা হিসাবে অস্ট্রাভা মিট থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন নীরজ। ফেডারেশন কাপে ৮২.২৭ মিটার দূরত্বে জ্যাভলিন ছুড়ে সোনা জিতেছিলেন তিনি। তবে চোট পাওয়ায় ছ’টি থ্রো করেননি। নিজের চতুর্থ থ্রোয়ের পর সাবধানতার জন্য সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তাতেও সোনা জয় আটকায়নি। আর প্যারিসেও পদক সেই নীরজের গলাতেই। তবে সোনা নয়, রুপো নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল তাঁকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy