Advertisement
E-Paper

শূন্য থেকে শুরু! ফেলে আসা জায়গা ছিনিয়ে নিতে প্যারিসে ফিরেছেন বাইলস, লড়াই নিজের সঙ্গেই

টোকিয়োর পরে শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। মনে ভয় থাকলেও লড়াই ছাড়েননি। আবার উড়েছেন সিমোন বাইলস। প্যারিসে ডানা মেলতে শুরু করেছেন তিনি। আরও একটি অলিম্পিক্স নিজের নামে করতে চান তিনি।

sports

সিমোন বাইলস। তাঁর এই হাসি প্যারিসেও দেখতে চাইছেন অনুরাগীরা। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৪ ১২:০৯
Share
Save

‘ব্যাক এগেন টু টেক মাই প্লেস। হিয়ার টু স্টে। ডোন্ট কাউন্ট মি আউট। জাস্ট বিলিভ দিস ইজ় মাই ডেস্টিনি।’ বাংলায় এই চারটি লাইনের অর্থ, ‘আবার নিজের জায়গা নেওয়ার জন্য ফিরে এসেছি। আমাকে হিসাবের বাইরে রেখো না। শুধু জেনে রাখো এটাই আমার নিয়তি।’ সত্যিই তো নিয়তি। নইলে যিনি ভেবেছিলেন তাঁর কেরিয়ার শেষ, সেই তিনিই আবার এ ভাবে ফিরতে পারেন! যে অলিম্পিক্সের মঞ্চে জুটেছিল অপমান, সেই অলিম্পিক্সের মঞ্চই আবার তাঁকে এ ভাবে স্বাগত জানাতে পারে! তবে শুধুই কি নিয়তি? না। সঙ্গে রয়েছে অদম্য জেদ, পরিশ্রম। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। আর সে সব পেরেছেন বলেই তিনি সিমোন বাইলস। বিশ্বের সর্বকালের সেরা জিমন্যাস্ট বলছেন অনেকে। সর্বকালের সেরা না হোন, এই মুহূর্তে সেরা জিমন্যাস্টের নাম সিমোন বাইলস। অলিম্পিক্সে যাঁর সাতটি পদক রয়েছে। তার মধ্যে চারটি সোনা। যিনি পাঁচ বার বিশ্ব জিমন্যাস্টিক্স প্রতিযোগিতায় নেমে ছ’বারই অলরাউন্ড সোনা জিতেছেন। জিমন্যাস্টিক্সে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের মুখ হয়ে উঠেছেন। সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন খেলার মাধ্যমে। পদকের মাধ্যমে। এ বারের প্যারিস অলিম্পিক্সেও মধ্যমণি তিনি। তাঁর দিকেই তাকিয়ে গোটা বিশ্ব। আট বছর পরে আবার অলিম্পিক্সে পাকাপাকি ভাবে নিজের নামটা লিখতে এসেছেন তিনি।

২০১৬ সাল। ব্রাজিলের রিয়ো ডি জেনেইরো। অলিম্পিক্সে প্রথম বার দেখা যায় বাইলসকে। আমেরিকার মহিলা জিমন্যাস্টিক্সের দলে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য তিনি। সেই বাইলস খেলতে নেমে উড়লেন। এমন সব রুটিন করলেন, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন না ধারাভাষ্যকারেরা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯ বছর। সেই সময়ই সেরার সেরা হওয়ার ঝলক দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯২ অলিম্পিক্সে বোঞ্জজয়ী জিমন্যাস্ট বেটি ওকিনো বলেন, “বাইলস এই প্রজন্মের সেরা অ্যাথলিট। ওর কাছাকাছিও আমি কাউকে দেখছি না।” বাইলসের সতীর্থ জোসেলিন রবারসনের কথায়, “আমি কোনও খেলায় বাইলসের মতো দাপট দেখাতে কাউকে দেখিনি। ওকে দেখে মনে হয় এনএফএল (ন্যাশনাল ফুটবল লিগ, আমেরিকার ফুটবল বলা হয় এই খেলাকে)-এর এমন একটা দল, যারা কোনও দিন সুপারবোল হারেনি।” রিয়ো অলিম্পিক্সে চারটি সোনা ও একটি ব্রোঞ্জ জেতেন বাইলস।

sports

সোনার হাসি। রিয়ো অলিম্পিক্সে জেতার পরে পদক হাতে বাইলস। ছবি: সংগৃহীত।

রিয়ো অলিম্পিক্সের শেষে জিমন্যাস্টিক্সের দুনিয়ায় সবচেয়ে চর্চিত নাম হয়ে উঠলেন বাইলস। একের পর এক পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর ছবি। ব্যস্ত তিনি। বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাঁকে বিপণন দূত করতে চায়। গোটা দুনিয়ার নজর তাঁর দিকে। সকলে ভাবছেন, ১৯-এর বাইলস রিয়োয় যা করেছেন, ২৪-এর বাইলস টোকিয়োয় (কোভিডের কারণে ২০২০ সালের অলিম্পিক্স ২০২১ সালে হয়) তাকেও ছাপিয়ে যাবেন। তিনি পদক জিতবেন কি না, সেই প্রশ্ন ছিল না। প্রশ্ন ছিল, তিনি কতগুলি পদক জিতবেন। বাইলস নিজেও সেই সময় কেরিয়ারের সেরা সময়ে ছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, টোকিয়ো অলিম্পিক্স নিজের নামে করবেন বাইলস।

কিন্তু সত্যিই কি সব কিছু ঠিক ছিল? এত চাপ, এত প্রত্যাশা কি বাইলসের মনে ভয় ঢোকাচ্ছিল? তত দিনে এনএফএল তারকা জোনাথন ওয়েনসের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়েছে তাঁর। অনলাইনে আলাপ। তার পরে প্রেম। জোনাথন বলেন, “তখন সিমোনকে সর্বকালের সেরা বলা হচ্ছিল। আমি যে দিকে তাকাচ্ছিলাম, ওর ব্যানার দেখছিলাম। যে চ্যানেল ঘোরাচ্ছিলাম, সেখানে ওকে দেখছিলাম। গোটা সংবাদমাধ্যমের নজর ওর উপর ছিল। আমি ভাবছিলাম, এত চাপের মধ্যে ও কী ভাবে খেলবে।”

sports

অলিম্পিক্সের মঞ্চে বিম রুটিন করছেন বাইলস। ছবি: রয়টার্স।

প্রত্যাশার চাপের পাশাপাশি বাইলসকে ধাক্কা দেয় কোভিড। প্রথম বার কোনও অলিম্পিক্স হচ্ছিল দর্শক ছাড়া। প্রতিযোগীদের পরিবারেরও যাওয়ার অনুমতি ছিল না। সামাজিক দূরত্ব মেনে উদ্বোধনী প্যারেড হয়। সারা ক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে হচ্ছিল। কোনও চিৎকার নেই, উৎসাহ নেই। যেন শ্মশানের স্তব্ধতা। সেই পরিবেশ প্রভাব ফেলেছিল সারা ক্ষণ মজা করা বাইলসের উপর। তাঁর কোচ লরেন্ট ল্যান্ডি বলছেন, “সারা দিন শুধু জিমন্যাস্টিক্সই হত। ঘর থেকে বেরিয়ে অনুশীলন। তার পরে আবার ঘরে ঢুকে পড়া। সমাজমাধ্যম নিয়ে থাকা। আর কোনও জীবন নেই।” বাইলসের কথায়, “সারা ক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে হত। রোজ কোভিড পরীক্ষা হত। কারও সঙ্গে দেখা করতে পারতাম না।” তার প্রভাব যে বাইলসের খেলায় পড়ছে তা বুঝতে পেরেছিলেন কোচ। অনুশীলনে কোনও রুটিন ঠিক মতো করতে পারছিলেন না বাইলস। তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি ল্যান্ডিংয়ের সময় শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখা। সেটাই হচ্ছিল না। বার বার পড়ে যাচ্ছিলেন। বাইলসের মুখের হাসি উধাও হয়ে গিয়েছিল। কোচ বুঝতে পারছিলেন কোথাও সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু বাইলস তাঁকে আশ্বস্ত করেন।

কোচ যে ঠিক ভেবেছিলেন তা বোঝা যায় দলগত ফাইনালে। টানা তৃতীয় বার সোনা জিততে নেমেছিল আমেরিকা। ভল্টে বাইলসের ল্যান্ডিং ঠিক হয়নি। শূন্যে আড়াই পাক ঘোরার বদলে দেড় পাক ঘোরেন তিনি। ভল্ট শেষে যেন নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলেন না বাইলস। তাঁর চোখে ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা। কিছু ক্ষণের জন্য এরিনা থেকে বেরিয়ে যান তিনি। তার পরেই জানা যায়, বাকি ফাইনালে আর খেলবেন না বাইলস। মাঝপথে বেরিয়ে যান। তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানান কোচ ও সতীর্থেরা। পরে নিজের ব্যক্তিগত ইভেন্ট থেকেও সরে দাঁড়ান বাইলস। তবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এক জনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি। নেলি বাইলস। সিমোনের ঠাকুমা। তাঁর মা-ও তিনিই। আসলে রন বাইলস ও নেলির মেয়ের সন্তান সিমোন। তাঁরা চার ভাই-বোন। বাইলসের বাবা-মায়ের মধ্যে গার্হস্থ্য হিংসার কারণে আমেরিকার আইন অনুযায়ী চার ভাই-বোনকে ফস্টার হোমে (শিশুদের থাকার জায়গা) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সিমোন ও আদ্রিয়াকে দত্তক নেন রন ও নেলি। বাকি দুই ভাই-বোন অ্যাশলি ও টেভিনকে দত্তক নেন সিমোনের পিসি। তখন থেকে রন ও নেলিই সিমোনের বাবা-মা।

sports

(বাঁ দিকে) মা নেলি ও বাবা রনের (ডান দিকে) সঙ্গে বাইলস। ছবি: সংগৃহীত।

যখনই সিমোন খেলতে যেতেন, সঙ্গে থাকতেন রন ও নেলি। একমাত্র টোকিয়োয় যেতে পারেননি। বাড়িতে টেলিভিশনেই মেয়ের খেলা দেখেন তাঁরা। সিমোন যখন ভল্টে ল্যান্ডিংয়ে ভুল করেন, তখন অবাক হয়েছিলেন নেলি। তার পরেই ফোন আসে সিমোনের। তিনি মাকে জানান, টোকিয়োয় বাকি সব ইভেন্ট থেকে নাম তুলে নেবেন। মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নেলি। পরে তিনি বলেন, “ওই এক বারই আমরা ওর সঙ্গে ছিলাম না। প্রতি বার সিমোন যখন খেলতে যেত তখন ওর চুল বেঁধে দিতাম। এমন নয় যে সিমোন নিজে চুল বাঁধতে পারে না। কিন্তু ও চাইত আমি বেঁধে দিই। টোকিয়োতেই একমাত্র ওর চুল বাঁধতে পারিনি।” তবে কি বাবা-মা না থাকায় একা হয়ে পড়েছিলেন বাইলস? কোনও এক অজানা ভয় ঢুকে গিয়েছিল তাঁর মধ্যে? নইলে যাঁকে ২০ বছরে এক বারও ল্যান্ডিংয়ে পড়তে দেখেননি কোচ, সেই বাইলস বার বার পড়ে যাচ্ছিলেন। বাইলস বলেন, “আমার মনে হচ্ছিল, জেলে বন্দি হয়ে রয়েছি। এত লজ্জা লাগছিল। খালি কান্না পাচ্ছিল।”

বাইলস যে সমস্যায় পড়েছিলেন, তাকে জিমন্যাস্টিক্সের পরিভাষায় বলা হয় ‘টুইস্টিস’। এই সমস্যা হলে হাওয়ায় থাকাকালীন জিমন্যাস্টেরা নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারেন না। এক কথায় বলা যায়, মাথার সঙ্গে শরীরের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো মাথা বলছে, আড়াই পাক ঘুরবেন। কিন্তু শরীর দেড় পাক ঘুরছে। ল্যান্ডিংয়ের সময় পা কোথায় পড়ছে তার হদিস থাকে না। এই সমস্যা হলে খেলা বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দেন কোচেরা। কারণ, জোর করে করতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বেকায়দায় পড়ে গেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বাইলস সেই ঝুঁকি নিতে চাননি। তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল দল।

sports

বাইলসের কান্না। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে নাম তুলে নেওয়ার পরে। ছবি: সংগৃহীত।

দল মেনে নিলেও সমালোচকেরা মানেননি বাইলসের যুক্তি। টোকিয়োয় নাম তুলে নেওয়ার পরে তাঁকে শুনতে হয়েছিল, পালিয়ে গিয়েছেন। খালি নিজের কথা ভেবেছেন। খারাপ পারফরম্যান্সের অজুহাত দিয়েছেন। সমাজমাধ্যমে রাম, শ্যাম, যদু, মধুরা তাঁকে নিয়ে মজা করেছেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা জিমন্যাস্টকে লাগাতার সমালোচনা শুনতে হয়েছে। সে সব মাথায় বাসা বেঁধেছিল বাইলসের। হাজার হোক, তিনি তো মানুষ। বাইলস বলেন, “যেখানে গিয়েছি, মনে হয়েছে সকলে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। হয়তো তারা করছে না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে।” টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ব্যবহার করা পোশাক তিনি বাড়িতে এক জায়গায় রেখে দিয়েছেন। পারতপক্ষে সে সব দেখেন না। মনে করতে চান না তাঁর কেরিয়ারের সবচেয়ে খারাপ সময়কে।

বাইলস তো শুধু এক জন জিমন্যাস্ট নন, তিনি আমেরিকার জিমন্যাস্টিক্সের পালাবদলের অন্যতম কান্ডারি। ৮০-৯০ এর দশকে জিমন্যাস্টিক্সে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও কথা হত না। তখন জিমন্যাস্টিক্সে নামা মানে পদক জিততে হবে। তার জন্য যদি বড় চোট লাগে তা-ও পিছপা হতেন না কোচেরা। তাঁদের কথা শুনতে হত জিমন্যাস্টদের। ১৯৯৬-এর অলিম্পিক্সে কেরি স্ট্রাগ চোট নিয়েই লড়েছিলেন। তাতে হয়তো তিনি বাহবা পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারত। ১৯৯৬ অলিম্পিক্সের পদকজয়ী ডোমিনিক ডসনের কথায়, “কোচেরা যা বলত তা-ই শুনতে হত। আমাদের শরীর নিয়ে ছেলেখেলা হত। সিমোন তার প্রতিবাদ করেছিল। প্রথম মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেছিল।” ধীরে ধীরে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বাইলস টোকিয়ো থেকে নাম তুলে নেওয়ার পরে একটি ভিডিয়োবার্তা ও পরে সাংবাদিক বৈঠক করে নিজের কথা বলেছিলেন। মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলেছিলেন। কোন পরিস্থিতিতে তিনি নাম তুলে নিয়েছিলেন তা জানাতে ভয় পাননি বাইলস। তার পর থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এক জন খেলোয়াড়কে সফল হতে গেলে শারীরিক ভাবে ১০০ শতাংশ ফিট থাকার পাশাপাশি মানসিক ভাবেও যে ১০০ শতাংশ ফিট থাকতে হবে তা বুঝেছেন সকলে। তার শুরুটা হয়েছে বাইলসের হাত ধরেই।

বাইলস লড়াই করেছেন আমেরিকার জিমন্যাস্টিক্সে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধেও। ৮০-৯০-এর দশকে জিমন্যাস্টের দক্ষতার থেকে তাঁর চেহারা ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরী, সোনালি চুলের মেয়েদের আধিক্য ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের দেখাই যেত না। বিচারকেরাও নাকি গায়ের রং দেখে নম্বরের হেরফের করতেন। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম দুই কৃষ্ণাঙ্গ জিমন্যাস্ট হিসাবে অলিম্পিক্সে অংশ নিয়েছিলেন বেটি ও ডোমিনিক। তাঁরা পদক জিতলেও বাকিদের ছায়ায় থেকে গিয়েছেন। আমেরিকাকে প্রথম ধাক্কা দেন গ্যাবি ডগলাস। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক্সে অলরাউন্ড সোনা জেতেন তিনি। ১৬ বছরের গ্যাবির সাফল্য উৎসাহ দিয়েছিল বাইলসকেও। সোনা জেতার পরেও অবশ্য গ্যাবির চুল নিয়েই আলোচনা হয়েছে বেশি। সেই মানসিকতা বদলে দিয়েছেন বাইলস। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ম্যাটে নামার পরে খেলাটাই আসল। সেখানে গায়ের রং বা চুলের ধরনের কোনও জায়গা নেই। তার প্রভাব পড়েছে। এখন আমেরিকায় মহিলাদের জিমন্যাস্টিক্সে অনেক বেশি কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে উঠে আসছেন। বাইলসকে দেখে স্বপ্ন দেখছেন তাঁরাও।

ঠিক সময় আমেরিকার জিমন্যাস্টিক্সে এক বিস্ফোরণ হয়। ১৯ বছর ধরে আমেরিকার মহিলা জিমন্যাস্ট দলের চিকিৎসকের দায়িত্বে থাকা ল্যারি নাসেরের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ করেন দুই জিমন্যাস্ট। তাঁদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন আরও অনেকে। নাসেরের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেন ২৬৫ জন অ্যাথলিট। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাইলসও। তিনি বলেন, “আমরা বুঝতেই পারিনি আমাদের সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে। ১৩-১৪ বছরের মেয়েরা কী বুঝবে? আমরা ভাবতাম একেই বোধহয় শারীরিক পরীক্ষা বলে। এটা দেখার দায়িত্ব ফেডারেশনের। আমাদের সুরক্ষার দায়িত্ব ফেডারেশনের। তারা ঠিক মতো তা করেনি।” সেই ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল বাইলসকে। প্রভাব পড়েছিল তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যে। নেলি জানিয়েছেন, বাড়ি ফিরে কথা বলতে পারছিলেন না বাইলস। চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো ধাক্কা সহজে নিতে পারেননি। তবে এই বার পদক্ষেপ করে আমেরিকার আইন। নাসেরকে ৪০ থেকে ১৭৫ বছরের জেলের সাজা শোনানো হয়। আমেরিকার জিমন্যাস্টে এই বদলের নেপথ্যে ভূমিকা রয়েছে বাইলসের। তিনি শুধু বর্তমানকে গর্বিত করেননি, ভবিষ্যতের কথাও ভেবেছেন।

তবে বাইলসের লড়াইটা সহজ ছিল না। টোকিয়োর ব্যর্থতার পরে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, অবসর নিয়ে নেবেন। এত সমালোচনা নিতে পারছিলেন না তিনি। সকলে বাইরে থেকে তাঁকে দেখছিলেন। বাইরে থেকে সুস্থ-সবল এক মেয়ে। কিন্তু তিনি যে ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে গিয়েছিলেন, তা কেউ দেখতে পাননি। তাঁর ভিতরের যন্ত্রণা কেউ বোঝেননি। হয়তো তিনি অবসর নিয়েও ফেলতেন। কিন্তু জোনাথন সেই সময় তাঁর পাশে দাঁড়ান। ২০২৩ সালে জোনাথনের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। হিউস্টনে নিজের বাড়ি বানান বাইলস। সেখানে দু’জনে থাকা শুরু করেন। কিছু দিন পরে বাইলস ঠিক করেন, আর এক বার চেষ্টা করবেন। একেবারে শূন্যে ফিরে যান তিনি। শূন্য থেকে শুরু করেন। জিমে গিয়ে একেবারে নতুন জিমন্যাস্টদের মতো লাফালাফি শুরু করেন। বাইলসকে দেখে অবাক হয়ে যান সকলে। প্রথম প্রথম প্রতি তিন মাসে এক বার করে জিমে যেতেন তিনি। ধীরে ধীরে অনুশীলনের গতি বাড়ান।

sports

অলিম্পিক্সে আনইভেন বার রুটিনে বাইলস। ছবি: রয়টার্স।

বাইলসের গলার কাছে একটি ট্যাটু রয়েছে। সেখানে লেখা, “অ্যান্ড আই স্টিল রাইজ়।” টোকিয়োর পরে সেই ট্যাটু করিয়েছেন তিনি। নিজেকে বুঝিয়েছেন, ফুরিয়ে যাননি। বাইলস বলেন, “অন্তত ৫ লক্ষ বার ভেবেছি, সব ছেড়ে দেব। কিন্তু প্রত্যেক বার সেই ভাবনা বাদ দিয়েছি।” সেই সময় তাঁকে সাহায্য করেছেন তাঁর মনোবিদ। মানসিক ভাবে ঠিক জায়গায় থাকার জন্য নিয়মিত মনোবিদের কাছে যেতেন বাইলস। তাতে কাজ হয়েছিল। বাইলস ঠিক করে ফেলেন, ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক্সে শেষ চেষ্টা করে দেখবেন। আমেরিকার ৭২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সি জিমন্যাস্ট হিসাবে এ বার নেমেছেন ২৭-এর বাইলস।

গত বছর বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্পে বিশ্ব জিমন্যাস্টিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন বাইলস। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালে এই অ্যান্টওয়ার্পেই প্রথম বার নজর কেড়েছিলেন তিনি। বাইলস ঠিক করে ফেলেছিলেন, বাইরের নেতিবাচক কথা কানে নেবেন না। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। সমাজমাধ্যম থেকে সরে যান। নিয়মিত মনোবিদের সঙ্গে কথা বলতেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করেন। নিজেকে মানসিক ভাবে ফুরফুরে রাখার কাজ শুরু করেন তিনি। অ্যান্টওয়ার্পে ভল্ট ইভেন্টে ‘ইয়ুরচেঙ্কো ডাবল পাইক’ রুটিন করার সিদ্ধান্ত নেন বাইলস। অন্যতম কঠিন রুটিন এটি। একটু এ দিক-ও দিক হলে বড় চোট পেতে পারতেন তিনি। প্রত্যেক বার অনুশীলনে ভয় পেতেন। বাইলস বলেন, “আমি যত বার লাফাতাম, প্রতি বার মনে হত পড়ে যাব। মাথার মধ্যে অনেক আওয়াজ শুনতে পেতাম। ভয় হত। কিন্তু ঠিক করে নিয়েছিলাম, নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। তাই লড়াই ছাড়িনি।”

বাইলসের আর এক কোচ কেসিল ল্যান্ডি বলেন, “অ্যান্টওয়ার্পে সিমোনকে দেখে ভাল লাগছিল। ও আগের মতো মজা করছিল। আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল। আমি জানতাম ও ভাল করবে।” অ্যান্টওয়ার্প খালি হাতে ফেরায়নি বাইলসকে। পঞ্চম অলরাউন্ড সোনা জেতেন তিনি। তবে তখনও অলিম্পিক্সের জন্য তৈরি ছিলেন না বাইলস। তাঁর কোচ লরেন্ট বলেন, “২০২৪-এর শুরুতেও ৭০ শতাংশ তৈরি ছিল বাইলস। আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছিলাম।” জিমন্যাস্টিক্সে প্রতি বছর গড়ে ১১টি শিবির হয় আমেরিকায়। ২০১৬ সালের পর থেকে কোনও শিবিরে যাননি বাইলস। শিবির কঠিন প্রশিক্ষণ ভাল লাগত না তাঁর। তবে এই বছর তিনি শিবিরে যান। নিজেকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলতে চেয়েছিলেন। চলতি বছর ইউএস ক্লাসিকেও সোনা জেতেন বাইলস। নিজের জায়গা করে নেন অলিম্পিক্সের দলে। তবে তিনি চাননি ১০০ শতাংশ দিতে। অলিম্পিক্সে নিজের সেরা ফর্মে উঠতে চেয়েছিলেন।

sports

অলিম্পিক্সের মঞ্চে এ ভাবেই ডানা মেলছেন বাইলস। ছবি: রয়টার্স।

সেটা করতে পেরেছেন বাইলস। তার ঝলক দেখা গিয়েছে দলগত ফাইনালে সোনা জিতে। ভল্ট ও ফ্লোর রুটিনে সকলের থেকে বেশি স্কোর করেছেন বাইলস। তাঁর দাপটে দলও সকলের শীর্ষে শেষ করেছে। সবে শুরু। প্যারিসে ডানা মেলছেন বাইলস। সেই একই আত্মবিশ্বাস। সেই একই দৌড়। সেই একই ভল্ট। সেই একই ঝাঁপ। প্রতিটি ক্ষেত্রে আরও সংযোজন করেছেন বাইলস। আগে পাঁচটি রুটিন ছিল তাঁর নামে। এ বার আরও একটি রুটিন নিজের নামে করতে চাইছেন বাইলস। নিজের খেলা আরও উন্নত করেছেন। আসলে সেরা ও সর্বকালের সেরার মধ্যে হয়তো এটাই তফাত। সর্বকালের সেরারা এক জায়গায় আটকে থাকেন না। তাঁরা নিয়মিত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যান। বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যান। বাইলসও যাচ্ছেন। আরও একটি অলিম্পিক্স নিজের নামে করতে নেমেছেন তিনি। সেটা না করা পর্যন্ত থামবেন না। তিনি ফিরে এসেছেন নিজের জায়গা নিতে। ফিরে এসেছেন শীর্ষে থাকতে। নিজের সঙ্গেই লড়াই করছেন বাইলস। নিজেকেই হারাতে চাইছেন। এটাই হয়তো তাঁর নিয়তি।

Simone Biles Paris Olympics 2024 gymnastics

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।