সোনার সোহাগ। জেতার পরে ছেলেকে জড়িয়ে আদর নেইমারের। ছবি: এএফপি
পেনাল্টি শ্যুট আউটের শেষ কিকটা মেরে একটা আঙুল আকাশে তুলে দৌড়তে শুরু করলেন নেইমার। তার পর একটু গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন মাটিতে।
গ্যালারিতে ঝরনার জলের শব্দের মতো আছড়ে পড়ছে গান। ‘উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ন’, ‘উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ন।’
দু’বছর আগের বিশ্বকাপের সেই সাত গোলের ম্যাচটা এখনও দগদগে ফুটবল-পাগল ব্রাজিলীয় রক্তের শাখা-প্রশাখায়। ম্যাচের আগে স্রোতের মতো খেলা দেখতে আশা হাজার হাজার মানুষের একজনকেও ‘প্রতিশোধ’ শব্দটা বলতে শুনিনি। বরং প্রশ্ন করলে উত্তর এসেছে, ‘‘আজ আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে চাই।’’ বারুদ? অবশ্যই ছিল মনে। কিন্তু তার প্রকাশ ঘটেছে অন্য ভাবে।
স্বভাব-শান্ত ব্রাজিলিয়ানরা কী ভাবে জার্মানিকে হারানোর ম্যাচটা দেখছেন ভেবে লাভ নেই। কিন্তু বিশ্বের চোখে কোথাও যেন ‘নেইমার অ্যান্ড কোম্পানি’র হাত ধরে মারাকানায় শাপমুক্তি হয়ে গেল ব্রাজিলের। এটা ঘটনা যে, শনিবারের মারাকানায় জার্মান টিমে একটা টমাস মুলার ছিলেন না। বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগার বা টনি ক্রুজকেও জার্মান জার্সি গায়ে অলিম্পিক্স ফাইনালে নামতে দেখা যায়নি। ব্রাজিলেও একটা অস্কার বা কোনও এক দাভিদ লুইজ ছিলেন না। ছিলেন শুধু নেইমার। যিনি মহা-অপমানের সেই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ছিলেন না। কিন্তু তবু ব্রাজিল তো! জার্মানি তো! ম্যাচটা ব্রাজিল বনাম জার্মানি তো! ব্রাজিল বিশ্বকাপ পরবর্তী অধ্যায়ে এ ম্যাচটা হবে, আর ইতিহাস ঘুরে-ফিরে আসবে না, কখনও হয়?
নেইমারকে দেখে সে দিনের যন্ত্রণাটা যেন আরও বোঝা যাচ্ছিল। ফ্রিকিকে অসাধারণ গোলটা করার পর দেখা গেল, উসেইন বোল্টের পোজে দাঁড়িয়ে! ম্যাচ জেতার পর আবার দেখা গেল, সোনার পদকটা দাঁতে চেপে অদ্ভুত পোজ দিতে ব্যস্ত। আশি হাজারের গ্যালারি নামক হলুদ সর্ষে খেত-কে দেখলাম, যুদ্ধ শেষের পরে ঠায় অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। এক-দু’মিনিট নয়, ঝাড়া পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে। সোনার ছেলের গলায় স্বর্ণপদক ব্রাজিল আজ দেখতে চায়। ব্রাজিল চায়, নেইমারের হাসিতে বেলো হরাইজন্তের কান্না মুছতে। ব্রাজিল ফুটবল ইতিহাসে যা এখন পরিচিত ‘মিনেইরেজো’ নামে।
ব্রাজিলের অলিম্পিক্স কোচ রোজারিও মিকায়েল সাংবাদিকদের সামনে এসে পরে বলছিলেন, ‘‘এটাকে আমি প্রতিশোধের ম্যাচ হিসাবে দেখছি না। ওই ম্যাচে নেইমার-সহ কোনও ফুটবলারই ছিল না। বরং বলতে পারি, ব্রাজিল যে এখনও ফুটবল বিশ্ব শাসন করতে পারে সেটা আমরা দেখিয়ে দিলাম।’’ প্রোফেসর-প্রোফেসর মার্কা মুখ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন চ্যাম্পিয়ন টিমের কোচ। খেলা শেষে যিনি অন্তত মিনিট পাঁচেক টানা বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন নেইমারকে। ‘ওয়ান্ডার কিডের’ জনপ্রিয়তাও বেশ মুগ্ধ করার মতো। বিশেষ করে মহিলা মহলে। আট থেকে আশি— সর্বত্র কী আবেগ! অন্তত আশি শতাংশ সমর্থকের পিঠে অধিনায়কের নম্বর লেখা জার্সি। নেইমার তার যথাযথ মর্যাদাও দিলেন। কথায়, আবেগ-প্রদর্শনে। অলিম্পিক্স সোনা পাওয়ার পর সাংবাদিক সম্মেলন করেননি নেইমার। প্রবল ধাক্কাধাক্কির মধ্যে মিক্সড জোনে তিন পরিচিত মহিলা সাংবাদিকের সঙ্গে অল্প কথাবার্তা বলে যান। যার ইংরেজি তর্জমা এ রকম— জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত। এমন রাত আমার জীবনে কখনও আসেনি। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকলাম।
ইতিহাসের উৎসবপালনও দেখার মতো। রাতে নেইমারকে দেখলাম, গোটা টিম নিয়ে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে উঠে কোমর দোলাচ্ছেন, নাচছেন। দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজার সময় কেঁদে ফেলছেন। দেখতে দেখতে কোথাও যেন এত দিনের জমা দুঃখের বাষ্পটার ছিটকে বেরিয়ে পড়া দেখা যায়, অনুভব করা যায়। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে নেইমারের জীবনযাপন নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। জিকোর মতো প্রবাদপ্রতিম তাঁর নৈশজীবন নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। নেইমার এ দিন শোনা গেল কোনও এক টিভি চ্যানেলে নাকি বলেও দিয়েছেন, আর নয়। আর চান না তিনি দেশের অধিনায়কত্ব করতে। ব্রাজিল কোচ তিতে-কে বলে দেবেন অন্য অধিনায়ক দেখে নিতে।
সুখের আবহে এমন কথাবার্তা মোটেও কাঙ্খিত নয়। ম্যাচে একটা সময় যা ঘটছিল, তাকেও আবহের পাশে মোটেও কাঙ্খিত দেখাচ্ছিল না। এত দিনের ‘অপয়া’ মারাকানা শনিবার রাতে ‘বন্ধু’ না হলে ম্যাচটা টাইব্রেকারে যেত তো? কে জানে? জার্মানির জুলিয়েনের দু’টো শট আর সোয়েন বেন্ডারের হেড যদি ক্রসবারে লেগে না ফিরত, তা হলে মিকায়েলের কপালে দুঃখ থাকতে পারত। কিন্তু ভাগ্য বরাবর সাহসীর সঙ্গী হয়। আর শনিবারের মারাকানায় সাহসী টিমটার নাম ব্রাজিল ছিল। জার্মানি নয়।
এক কথায়, ব্রাজিলের সাহসী ফুটবল, মাটিতে বল রেখে অবিশ্রান্ত ভাবে আক্রমণে ওঠার চেষ্টা, প্রতিটা বলের জন্য আপ্রাণ লড়ে যাওয়া— জার্মানির সতর্ক ফুটবলকে ধাক্কা দিয়ে গেল। যে কারণে বল পজেশনে নেইমাররা সব সময়ই টেক্কা দিয়ে গেলেন। ব্রাজিলের নতুন কোচ ১৯৫৮-র সাবেক স্টাইলকে ধরে টিম সাজিয়েছিলেন আগের ম্যাচগুলোয়। এ দিন তিনি খেললেন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। দুই গ্যাব্রিয়েল আর নেইমারকে সামনে রেখে পাস-পাস-পাসের বিষ-জালে বিপক্ষকে বন্দি করে ফেলা। আর এটা করতে করতেই ব্রাজিলের এগিয়ে যাওয়া।
কী অসাধারণ নেইমারের সেই ফ্রিকিকটা। আহা! প্রায় আঠাশ গজ দূর থেকে সোয়ার্ভ করিয়ে জার্মানির ক্রসপিসের কোণ দিয়ে বল রেখে দিলেন নেইমার। একেবারে যেন কাঁটা-কম্পাস মেপে পাঠানো বল। বলটা এমন ভাবে ঢুকল যে, জার্মান কিপার শরীর ছুড়েও নাগাল পেলেন না। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি ব্রাজিল ১-০ এগিয়ে যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল নেইমাররা আরও টুঁটি টিপে ধরবেন জার্মানদের। কিন্তু বিরতির পর আচমকাই ব্রাজিলের শক্তপোক্ত রক্ষণে আঘাত হানলেন মেয়ার। ১-১ হয়ে গেল। ম্যাচ চলে গেল টাইব্রেকারে।
সেখানেও নাটক, সেখানেও ক্যাপ্টেন্সি কাকে বলে দেখিয়ে দিলেন নেইমার। ৪-৪ অবস্থায় জার্মানির নিলস পিটারসনের শট বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আটকালেন ব্রাজিলের কিপার ওয়েভার্টন। এমন রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় নেইমার জয়ের শটটা মারতে এলেন। গোটা স্টেডিয়াম স্তব্ধ। নেইমার পেনাল্টিটা মারার আগে সামান্য ‘জগ’ করলেন, দাঁড়ালেন, তার পর প্লেসিং এবং গোল! আর তার পর যে শব্দব্রহ্ম সৃষ্টি হল, তা তুলনাহীন। কোনও বিশেষণে তাকে ধরা সম্ভব নয়।
সব দেখলে, শুনলে ঘোর লাগবে। মনে হবে, এর চেয়ে মহানাটকীয় স্ক্রিপ্ট কী পেতে পারতেন নেইমার? এর চেয়ে বেশি কিছু কি চাইতে পারতেন ফুটবল-দেবতার কাছে? জার্মানির কাছে কাপ-যজ্ঞে ধ্বংস হওয়ার একটা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, দেশকে দিলেন অলিম্পিক্স সোনা যা আগে কেউ কখনও দিতে পারেননি। আর সবই হল কি না সেই ‘কুখ্যাত’ মারাকানায়! যে মাঠ ছেষট্টি বছর আগে দেখেছিল দেশের কাপ-স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যাওয়া।
ব্রাজিল আজ থেকে বলতে পারবে, মারাকানা মানে শুধু আর ‘মারাকানাজো’ নয়। মারাকানা মানে প্রথম অলিম্পিক্স সোনা তুলে নেওয়ার মঞ্চও। ব্রাজিল আজ থেকে বলতে পারবে, মারাকানা তার ‘মিনেইরেজো’র শোধ তোলার প্রথম ধাপ।
রোগাপাতলা, ফুটফুটে ছেলেটা স্রেফ দু’টো শটে ব্রাজিলকে অনেক, অনেক কিছু দিয়ে গেল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy