ম্যাচ থামিয়ে সাইড লাইনের ধারে মনিটরে চোখ রেফারির।
মেক্সিকোয় ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ। কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি আর্জেন্তিনা ও ইংল্যান্ড। হাত দিয়ে গোল করেছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। কিন্তু রেফারি আলি বিন নাসেরের তা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। ম্যাচের পরে মারাদোনার সেই ঐতিহাসিক উক্তি, ‘‘গোলের নেপথ্য রয়েছে ঈশ্বরের হাত।’’ হাত দিয়ে গোল করার জন্য ২২ বছর পরে ইংল্যান্ড সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন ফুটবল রাজপুত্র। কিন্তু ইংল্যান্ড সমর্থকরা আজও ক্ষমা করেননি মারাদোনাকে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১০ সালের বিশ্বকাপ। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে ১-২ পিছিয়ে ইংল্যান্ড। টেলিভিশন রিপ্লেতে পরিষ্কার দেখা গিয়েছিল ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের শট ক্রসবারে লেগে গোল লাইনের ভিতরে ড্রপ পড়ছে। কিন্তু লাইন্সম্যান গোল দেননি। জার্মানির বিরুদ্ধে ১-৪ হেরে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায় বিশ্ব জুড়ে। প্রশ্ন উঠতে থাকে রেফারিদের দক্ষতা নিয়েও। গোল, পেনাল্টি, লাল কার্ড থেকে বিনা দোষে ফুটবলারদের শাস্তি দেওয়া নিয়ে বাড়তে থাকা বিতর্কে নাজেহাল ফিফা কর্তারা। টেনিসের মতো ফুটবলেও গোল লাইন প্রযুক্তি চালু করার জোরাল দাবি ওঠে।
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের দু’বছরের মধ্যেই গোললাইন প্রযুক্তি চালু হল বিশ্ব ফুটবলে। বল গোললাইন পেরোলেই রেফারি ও ল্যাইন্সম্যানদের কব্জিতে বাঁধা ঘড়িতে নির্দেশ পৌঁছে যেত। কিন্তু তাতেও পুরোপুরি সমস্যার সমাধান হয়নি। গোল হয়েছে কি না সেটাই শুধু গোল লাইন প্রযুক্তির মাধ্যমে বোঝা যায়। কোনও ফুটবলার পেনাল্টি আদায়ের জন্য অভিনয় করেছেন কি না, অথবা জটলার মধ্যে কোনও ফুটবলার বিপক্ষের কাউকে আঘাত করেছেন কি না, তা প্রমাণ করা সম্ভব ছিল না। এ বার দাবি উঠতে থাকে ক্রিকেটের থার্ড আম্পায়ারের মতো ফুটবলেও রিভিউ সিস্টেম চালু করার। অর্থাৎ, কোনও বিষয়ে সংশয় থাকলে রিপ্লে দেখে যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন রেফারিরা। অথবা, রেফারির সিদ্ধান্ত ভুল হলে তা সংশোধন করে দেবেন অন্য কেউ। ২০১৬-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেজর লিগ সকারে প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়। নাম দেওয়া হয় ভিএআর (ভিডিও অ্যাসিট্যান্ট রেফারি)। এর কয়েক মাস পরে ইতালি বনাম ফ্রান্স আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলিতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। জাপানে ২০১৬ বিশ্ব ক্লাব কাপেও ছিল ভিএআর। বিশ্ব ফুটবলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনল নতুন এই প্রযুক্তি। যদিও সর্বত্র এই প্রযুক্তির ব্যবহার এখনও শুরু হয়নি। যে কারণে সম্প্রতি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে চেলসির আলভারো মোরাতার গোল বাতিল হওয়া নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। ম্যাচের পরে চেলসি ম্যানেজার আন্তোনিও কন্তে ইপিএলে ভিএআর চালু করার দাবি তুলেছেন। রাশিয়া বিশ্বকাপে ভিএআর প্রযুক্তি ব্যবহার করার সম্ভাবনা প্রবল। মঙ্গলবার সোচিতে ৩২টি দেশের কোচেদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন ফিফা কর্তারা। জানা গিয়েছে, শনিবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে ফিফা।
ভিএআর কী: মাঠের বিভিন্ন জায়গায় ক্যামেরা বসানো থাকে। বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত রেফারিরা ম্যাচ চলাকালীন কন্ট্রোল রুমে বসে টিভিতে চোখ রাখেন। কন্ট্রোল রুম যে স্টেডিয়ামেই থাকতে হবে, তা কিন্তু নয়। জার্মানিতে যেমন কন্ট্রোল রুম রয়েছে কোলন শহরে। সেখানে বসে বুন্দেশলিগার সমস্ত ম্যাচের উপর নজর রাখেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রেফারির সঙ্গে সব সময়ই যোগাযোগ থাকে। এ ছাড়া মাঠের সাইড লাইনের ধারেও একটি মনিটর রাখা থাকে, কোনও ব্যাপারে সংশয় হলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রেফারি নিজেও তাতে রিপ্লে দেখে নিতে পারবেন। ভিএআর চারটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে—
গোল বিতর্ক: গোল হওয়ার আগে কোনও ফাউল হয়েছিল কি না তা খতিয়ে দেখবে ভিএআর। বল গোল লাইন পেরিয়েছে কি না তা অনেক সময় নজর এড়িয়ে যায় রেফারি ও লাইন্সম্যানদের। এই পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে টিভিতে রিপ্লে দেখে।
পেনাল্টির সিদ্ধান্ত: অনেক ফুটবলারের বিরুদ্ধে বিপক্ষের বক্সে ফাউলের অভিনয় (ডাইভ) করে পেনাল্টি আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। যেমন, নেদারল্যান্ডস মিডফিল্ডার আরয়েন রবেন। ফুটবলারদের এই অভিনয় অনেক ক্ষেত্রেই রেফারিদের ধন্দে ফেলে দেয়। ভিএআর-এর মাধ্যমে বোঝা যাবে পেনাল্টি আদৌ ছিল কি না।
লাল কার্ড: অনেক সময় রেফারির ভুল সিদ্ধান্তে লাল কার্ড দেখেন ফুটবলাররা। নতুন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা সত্যতা যাচাই করতে পারবেন।
ভ্রম সংশোধন: জটলার মধ্যে কে ফাউল করছে অনেক সময় নজর এড়িয়ে যায় রেফারির। ফলে বিনা দোষে ফুটবলারদের শাস্তি পাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেই ভুল শুধরে নেওয়া যাবে।
কী ভাবে কাজ করে ভিএআর?
এক) ম্যাচের মধ্যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশয় থাকলে রেফারি ভিএআর-এর সাহায্য নিতে পারেন। আবার কন্ট্রোল রুমে টিভিতে নজর রাখা বিশেষজ্ঞরাও রেফারির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। দুই) কন্ট্রোল রুমে বসে থাকা বিশেষজ্ঞরা রেফারিকে জানান ভিডিও ফুটেজে কী রয়েছে। পরামর্শ দেওয়া হয় রেফারিকে। তিন) ভিএআর-এর পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন রেফারি। না হলে সাইড লাইনের ধারে রাখা মনিটরে তিনি নিজেই রিপ্লে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy