সাইরাজ বাহুতুলেকে নিয়ে চার দিকে প্রচুর কথা শুনছি। মুম্বইয়ের ক্রিকেট কর্তারা বলাবলি করছেন যে, ও কী ভাবে মুম্বইয়ের অনূর্ধ্ব ২৩ টিমের দায়িত্ব নিয়ে আবার বাংলার কোচ হয়ে গেল? প্রশ্ন উঠছে, নিজের রাজ্যের দায়িত্ব ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়াটা অনৈতিক কি না?
আমি বলব, সাইরাজ বেশ করেছে! মুম্বই ওকে দিয়ে এত দিন কোচিং করাল, কই একবারও তো চুক্তির কথা শুনলাম না! সরকারি চুক্তিই যেখানে নেই, সেখানে চাকরির নিশ্চয়তা কোথায়? এই তো গত রবিবার এমসিএ প্রেসিডেন্ট শরদ পওয়ারের সঙ্গে মিটিং হল কর্তাদের। কোচদের চুক্তি নিয়ে সেখানে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কেউ তো বললই না বৈঠকে। ও দিকে সাইরাজ সকাল থেকে সন্ধে ছেলেদের নিয়ে পড়ে আছে। যত দূর আমি জানি সোমবার সন্ধে পর্যন্ত ওর কাছে কোনও চুক্তি ছিল না।
নিজের কোচিং ভবিষ্যৎ নিয়ে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার এই সময়টাতেই ও সৌরভের ফোন পেয়েছে। সৌরভ একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সৌরভ-সাইরাজ একসঙ্গে অনেক দিন খেলেছে। দু’জনের সম্পর্ক দুর্দান্ত। সৌরভ তো সর্বক্ষণ টিমের সঙ্গে থাকতে পারবে না। তখন ওর প্ল্যানগুলো কাজে লাগানোর সেরা লোক সাইরাজ। আমার কাছে পরস মামরের পর সাইরাজই কোচ হিসেবে বাংলার সেরা বাছাই। আর যে যা খুশি বলুক, সাইরাজ বাহুতুলের এই বিতর্ককে আমি মনেই রাখতে চাইব না। কারণ ও বিতর্ক বাধানোর ছেলে নয়। আমার রুমমেট ছিল এক সময়, আমি চিনি ওকে। খুব কম কথার মানুষ। দুমদাম কিছু বলাটা ওর স্বভাবে নেই।
নব্বইয়ের একটা ঘটনার কথা বলি। সে বছর জুলাইয়ে চার্চগেট এলাকায় একটা ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনা হল। গাড়ির চালক বিবেক সিংহকে বাঁচানো যায়নি। বিবেক মানে জগজিৎ আর চিত্রা সিংহের ছেলে। ওই গাড়িতে টিনএজার সাইরাজও ছিল। আর ও এতটাই মারাত্মক আঘাত পায় যে সে সময় কোমায় চলে গিয়েছিল। ’৯১ সালে আবার ওর সঙ্গে দেখা। একের পর এক অস্ত্রোপচার আর ফিজিওথেরাপি করে ফিরেছে। ক্রাচ ছাড়া সবে হাঁটছে। এতটাই টাল খাচ্ছে যে দেখলে মনে হবে মদ্যপ কেউ। শরীরে একটুও ব্যালান্স নেই। সে বছর এপ্রিলে বিসিএ-র (বম্বে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন) একটা বোলিং ক্যাম্প হওয়ার কথা। ফ্র্যাঙ্ক টাইসন আসবেন। আমি সাইরাজকে বললাম, ক্যাম্পে এসো।
আসলে ওর বাবা বসন্ত বাহুতুলে মহারাষ্ট্রের হয়ে খেলেছেন। বোন কল্পনা জাতীয় দলে খেলেছে। দাদা সংগ্রাম অনূর্ধ্ব উনিশ খেলেছে। এমনকী ওর মা-ও মুম্বইয়ে মেয়েদের ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমন পরিবারের ছেলে ক্রিকেট ছেড়ে দেবে, ভাবতে পারতাম না। তাই ওর ওই অবস্থা দেখেও ক্যাম্পে জোর করে ডেকে এনেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, ক্রিকেটের আবহাওয়ার মধ্যে থাকুক সাইরাজ।
তা প্রথম দিন টাইসন বোলারদের দৌড় করানো শুরু করলেন। সাইরাজ কোনও রকমে কুড়ি পা দৌড়ে বলতে লাগল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি খেলতে পারব না। টাইসন শুনলেন না। বললেন, রোজ পাঁচটা বল করা দিয়ে শুরু করো। আমি ক্যাম্পের সঙ্গে প্রশাসনিক ভাবে যুক্ত ছিলাম। আর সাইরাজ তখন আমার রুমমেট। রাতে ওকে যন্ত্রণায় কাতরাতে শুনতাম, কিন্তু কোনও দিন অভিযোগ করতে শুনিনি। টাইসন যা যা বলতেন, সব চুপচাপ করে যেত। ক্যাম্প শেষ হওয়ার পর বিসিএ-র হয়ে একটা টুর্নামেন্ট খেলল সাইরাজ। ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টও হল! যে ছেলেটা কুড়ি পা হাঁটতে পারত না, সে তার পর কুড়ি বছর চুটিয়ে ক্রিকেট খেলল। মুম্বইয়ের হয়ে একাধিক বার রঞ্জি জিতল। কোচ হল।
এটাই আসল সাইরাজ বাহুতুলে। আপনাদের নতুন কোচ।
যে মুম্বইয়ের টিপিক্যাল খারুশ ঘরানার ক্রিকেটার। যে আমার মতে দেশের সবচেয়ে আন্ডার-রেটেড অলরাউন্ডার। ওর যা প্রতিভা ছিল, সেই তুলনায় প্রচার পায়নি।
আর যে এই মুহূর্তে আমার মতে, বাংলার কোচিংয়ের কাজে সেরা বিকল্প। কারণ বাংলা টিম নিয়ে প্রত্যাশা বরাবরই বেশি থাকে। টিমটাকে কোচিং করানোও তাই বড় চ্যালে়ঞ্জ। তার উপর গত বার ওরা নকআউটে উঠতে পারেনি বলে এ বছর প্রত্যাশা আরও বেশি থাকবে।
এই অবস্থায় সাইরাজের অভিজ্ঞতা আর ম্যান ম্যানেজমেন্ট দারুণ কাজে দেবে। ওর সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হল কাজের প্রতি মনোভাব। মানে ওয়ার্ক এথিক। যে কোনও কাজে ঢিলেমি ও বরদাস্ত করবে না। আরও একটা জিনিস ও করবে না। যদি দেখে টিমে কোনও গণ্ডগোল বা ঝামেলা হচ্ছে, ও কিন্তু ছাড়বে না।
সিনিয়র হোক বা জুনিয়র, সমস্যা হলে কিন্তু আমার রুমমেট কাউকে রেয়াত করবে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy