ব্রেকফাস্ট টেবলের উল্টো দিকে বসা ফরাসি প্রৌঢ় ইংরেজি বোধহয় একদম বোঝেন না। মূর্খামি অবশ্যই প্রশ্নকর্তার, উত্তরদাতার নয়। কে না জানে, এ দেশে মেসি মানে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’!
পাশ্চাত্যের এই ভূখণ্ডে বিদেশি পর্যটককে কিছু জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করতে হলে, ইংরেজি বলতে পারেন কি না জেনে নেওয়াটা অতি স্বাভাবিক শিষ্টাচার। সেই ধর্ম মেনেই উপবিষ্ট বৃদ্ধকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আর উত্তরে ‘উই’ শুনলে (ইংরেজিতে ইয়েস) যে কোনও ভিনদেশীর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। কিন্তু কোথায় কী? মেসি বলতে যে লিওনেল মেসির কথা বলা হচ্ছে, ধন্যবাদজ্ঞাপন মোটেও হচ্ছে না, প্রৌঢ়কে বোঝাবে কে! কোনও কারণ ছাড়া ‘মেসি’ শুনে বারবার বিস্মিত হলেন, শেষে মেসি ছেড়ে অতি কষ্টে তাঁকে লিওনেল মেসির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ায় যে অবিশ্বাস, বিভ্রান্তি আর বিপর্যয় মেশানো স্বগতোক্তি ভেসে এল, ইউরোপ কেন, গোটা পৃথিবীর ফুটবল-পাগলদের তা অস্ফুট বিলাপ হতে পারে।
‘‘নো মোর লিও! নো!”
ইউরোপে কাগজের চেয়ে তার অনলাইন সংস্করণ বহু দিন অনেক বেশি জনপ্রিয়। হোটেলে কাগজ আসতে-আসতে বেশ দেরি হয়। প্রিন্ট সংস্করণের অপেক্ষায় থাকতে হলে ভুগতে হবে। তার চেয়ে অনলাইন সংস্করণে জেনে নেওয়া ভাল। দ্রুত ফ্রান্সের তিনটে দৈনিকের ওয়েবসাইট খুলে দেখা গেল, একদম প্রথমে মেসির মাটিতে মুখ গুঁজে দেওয়া ছবির তলায় নানা শিরোনাম জ্বলজ্বল করছে।
লিওনেল মেসি অ্যানাউন্সে কুইল মেট আন তার্মে আ সা কেরিয়ারে ইন্টারন্যাশিওনাল।
সি কুই পোসে মেসি আ আররেতার।
লিওনেল মেসি আ প্রিস সা রিট্রেইট।
লে মঁদ। লেকিপ। লে এক্সপ্রেস। শিরোনামের তর্জমা করা খুব দুঃসাধ্য কিছু নয়। গুগল ট্রান্সলেটরের যুগে ফেললেই বেরিয়ে আসে— লিওনেল মেসি আর্জেন্তিনা জার্সি থেকে অবসর নিয়ে ফেললেন। লে কিপ বিশদে গিয়েছে। খুঁজে বার করতে চেষ্টা করেছে, কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন মেসি। বলা হচ্ছে ২০০৭ থেকে ২০১৬— ন’বছরে বিশ্বকাপ ফাইনাল-সহ চারটে টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছেন মেসি। কিন্তু একটাও জেতাতে পারেননি, তাই। তাই চিলির বিরুদ্ধে পেনাল্টি নষ্টের পর আন্তর্জাতিক বুট তুলে রাখার এমন সিদ্ধান্ত।
সাউদাম্পটন থেকে আসা পল মার্টিন যা শোনামাত্র উড়িয়ে দিলেন। ভদ্রলোক ইংরেজ। সাঁ দে মার্সে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে ইংল্যান্ড সমর্থক বলছিলেন, “ধুর, চারটেয় পারেনি তো কী হয়েছে। উনত্রিশ বছর বয়স, অনায়াসে পারত। আমি তো বলব, ঠিক করেছে।” মানে? ঠিক করেছে মানে? “আরে, ওর টিমের যা দশা, ওর মতো পাঁচটা লিও থাকতে হবে। তার পর ওদের লোকজন। লিওকে খেলতেও হবে, আবার না পারলে গালাগালও খেতে হবে, দু’টো হয় না।” ভদ্রলোক দুপুরে সাঁ দেনির স্তাদ দে ফ্রাঁসে ইতালি-স্পেন ম্যাচটা দেখতে যাবেন। টিকিট আছে। সেটা শেষ করে আবার ফিরবেন আইফেল টাওয়ার ফ্যান জোনে। ইংল্যান্ডের ম্যাচ দেখতে।
ফ্যান জোনগুলোর একটা বড় সুবিধে হল, এখানে একসঙ্গে অনেক দেশের সমর্থক পাওয়া যায়। আজই যেমন সমর্থনের মহাসমুদ্রে স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ইংল্যান্ড হেঁটে যাচ্ছিল। এক আয়তক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে পাওয়া সুবিধে যেমন, ঠিক তেমন অসুবিধে হল এঁরা নিজেদের নিজেদের ভাষা ছাড়া খুব একটা কথা বলতে চান না। লিওনেল মেসি যতটা আর্জেন্তিনার, ততটাই তো বার্সেলোনার। আজকের মতো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের দিনে স্পেনের মানুষ কী ভাবছেন, তার মাহাত্ম্যই তো আলাদা। স্পেনে নাগরিকত্ব পাওয়া খুব অসুবিধে নয়, ব্রাজিল টিমে জায়গা না পেয়ে দিয়েগো কোস্তা তো ওখানেই খেলেন। কে বলতে পারে, বীতশ্রদ্ধ মেসিকেও দেশের নাগরিকত্ব দিয়ে পরে কোনও দিন লাল-হলুদ জার্সিতে নামিয়ে দেবে না স্পেন? কিন্তু স্পেনীয় সমর্থকরা ‘মেসি’ শব্দটা ছাড়া কিছু বুঝলেনই না। এক আইরিশকে জিজ্ঞেস করা গেল। শুনেটুনে, “তাতে আমার কী?” বলে সোজা হাঁটা দিলেন। অগত্যা ইংরেজ!
ম্যাঞ্চেস্টার-নিবাসী এক ইংরেজ পিতা-পুত্র জুটিকে পাওয়া গেল যাঁরা দেশের ম্যাচের অনেক আগে ফুটবলের পুণ্যস্নানে নেমে পড়েছেন। চমকপ্রদ গল্পও একটা শোনা গেল। ষোলো বছরের জোসেফের এটাই প্রথম ফুটবল-সফর নয়। বিশ্বকাপেও গিয়েছেন বাবার সঙ্গে। আর্জেন্তিনীয় বন্ধুবান্ধব হয়েছে। তাঁরাই নাকি এ দিন সকালে জোসেফকে টেক্সট করে জানান যে, লিও মেসি ছেড়ে দিলেন। শুনে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েন জোসেফ যে, পাল্টা টেক্সট করেন: কী জিনিস হারালে তোমরা, এ বার বুঝে দেখো।
এক লাতিনের জন্য এত আবেগ? ইউরোপের তো সুবিধে হওয়ার কথা। বিশ্বকাপে আর কোনও দিন তো লাতিনের সেরা প্রতিভাকে খেলতে হবে না? “সুবিধে সেটা, মানি। কিন্তু এটাও মনে করি, পেলে, মারাদোনার পর লিও-ই সেরা। বেস্ট প্লেয়ার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। আমি নিজে ওর ফ্যান, কত দুঃখ নিয়ে যে গেল, বুঝতে পারছি,” বিষাদে ডুবে যায় জোসেফের গলা। পাশ থেকে পিতা ততক্ষণে বলতে শুরু করেছেন, “সুবিধে বলছেন কেন? ফুটবল যারা ভালবাসে, ও ভাবে কখনও দেখবে না। গ্রেট লস, গ্রেট লস!”
আর ঠিক তখনই এক মায়া-বন্ধনে মুখগুলো মিলে যায়। ব্রেকফাস্ট টেবলের বিমূঢ় বৃদ্ধ, তিন ইংরেজ, ফ্যান জোনের বিস্ফারিত নিরাপত্তারক্ষী। যিনি ভাল ইংরেজি জানা এক ফরাসিকে মুহূর্তে ধরে এনেছিলেন বুঝতে যে, যা শুনলেন, ভারতীয় সাংবাদিক ঠিক সেটাই বলছে কি না।
এবং অবশ্যই এক পর্তুগিজভাষী। স্যেন নদীর ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে ‘লিওনেল মেসি, রিটায়ারমেন্ট’ শব্দ দু’টো শুনে উত্তেজিত ভাবে অনেক কিছু বলে গেলেন, কিন্তু একবর্ণ বোধগম্য হল না। মুখের ভাষা পড়া গেল। আনন্দের নয়। অন্তত হাসি তো দেখা গেল না। বরং হাতের মোবাইলের ব্যাক কভারের সঙ্গে লেগে থাকা পতাকার স্টিকারটা দেখা গেল। চেনা, খুব চেনা।
সবুজ-হলুদ, মধ্যে নীল বৃত্ত। তাতে লেখা, অরদেম ই প্রোগ্রেসো।
ব্রাজিল!
লিওনেল মেসি, আপনিই পারেন। আপনিই পারেন একটা সিদ্ধান্তে গোটা ফুটবল-বিশ্বকে ‘পিতৃহারা’ করে যেতে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy