আকর্ষণ: ফরাসি সাঁতারের নতুন নায়ক মাহ্শঁ। ছবি: সংগৃহীত।
২০০৪-এর জানুয়ারি। এক সাঁতার প্রতিযোগিতার ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলে শুরু হচ্ছে। স্টার্টিং ব্লকে এক জন তিরিশ বছরের ফরাসি। অন্য জন আঠেরো বছরের দীর্ঘদেহী আমেরিকান। তিনিই প্রথম হলেন। ফরাসি ষষ্ঠ।
এ বার দৃশ্য দুই। ২০২১-এর এক দুপুর। অফিসে কম্পিউটারের সামনে বসে বব বোম্যান। কিংবদন্তি সুইমিং গুরু। মাইকেল ফেল্পসের কারিগর। হঠাৎ একটা ই-মেল ভেসে উঠল— আপনার কাছে কি আমি কোচিং নিতে পারি? এমন কাতর আবেদন করে রোজই তো কত ই-মেল আসে বিশ্ববিখ্যাত কোচের কাছে। কিন্তু বব বোম্যানের সন্দেহ হল পদবিটা দেখে। প্রেরকের নাম লিয়ঁ মাহ্শঁ। এটা হাভিয়ের মাহ্শঁ-র ছেলে নয় তো? একদম ঠিকই ধরেছিলেন। মিতভাষী হাভিয়েরের ছেলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান তিনি করবেন কী ভাবে? বোম্যান ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন আর তাঁর সাঁতার কারখানায় শুরু হয়ে গেল ফেল্পস-উত্তর যুগের নতুন চ্যাম্পিয়ন তৈরির অভিযান। তখন কে জানত, তোমারে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে। বোম্যান এমন এক রত্ন উপহার দিতে চলেছেন, যে কি না ফেল্পসের রেকর্ড ভেঙে দেবে!
অলিম্পিক্সে সর্বোচ্চ ২৮টি পদক জিতেছেন ফেল্পস। যার মধ্যে ২৩টি সোনা। ধারেকাছেও কেউ নেই। একশো বছর আগে হওয়া প্যারিস অলিম্পিক্সে ঝড় তোলা ফিনল্যান্ডের রানার পাভো নুরমির আছে ৯টি সোনা। সব মিলিয়ে ১২টি পদক জেতেন ‘ফ্লাইং ফিন’। কার্ল লুইস, মার্ক স্পিৎজ়রা জিতেছেন ৯টি করে সোনা। ইউসেইন বোল্টের আছে ৮টি সোনা। প্রত্যেক অলিম্পিক্সে কেউ না কেউ মুখ হয়ে ওঠেন। এবারে প্যারিস অলিম্পিক্সে ফরাসি মুখ লিয়ঁ মাহ্শঁ। চারটি সোনা জিতে সাঁতারের পুলে ঝড়ই শুধু তোলেননি, মাইকেল ফেল্পসের চেয়ে ভাল সময় করে জিতছেন। আমেরিকার কেটি লেডেকিও নিশ্চয়ই সেরাদের মধ্যে থাকবেন। তেমনই টোকিয়োয় বিপর্যয়ের পরে আবার কিংবদন্তি হয়ে ফিরছেন সিমোন বাইলস। মনের অসুখের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফিরে এসে যে ভাবে তিনি অলরাউন্ড ও ভল্টে সোনা জিতেছেন, তা অলিম্পিক্সের সেরা রূপকথা হয়ে থাকবে। কিন্তু মাঁহ্শ-র মতো প্রভাব আর কেউ তৈরি করতে পারেননি।
তার একটা কারণ অবশ্যই তিনি নিজের দেশে ফ্রান্সের সেরা মুখ হয়ে উঠেছিলেন। জনপ্রিয়তায় যিনি এখন জ়িনেদিন জ়িদান বা কিলিয়ান এমবাপেকে টেক্কা দিতে পারেন। এমনকি, তিনি যখনই সাঁতারের পুলে নেমেছেন, কান পাতাই যাচ্ছিল না এমন জনগর্জন হচ্ছিল। আর বাড়তি আবেগ ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাঁর পারিবারিক ইতিহাসের জন্য। মা সেলিন বার্সেলোনা অলিম্পিক্সে ফ্রান্সের হয়ে নেমেছিলেন। বাবা হাভিয়ের ১৯৯৬ আটলান্টা ও ২০০০-এ সিডনিতে নেমেছিলেন। দু’জনেই সাঁতারু ছিলেন। কিন্তু কখনও পদক জিততে পারেননি। বাবা-মায়ের অপূর্ণতা মিটিয়ে দিচ্ছেন ছেলে। আর কে এই হাভিয়ের মাঁহ্শ? ২০০৪-এর সেই দিনে আমেরিকানের কাছে যিনি হার মেনেছিলেন। সেই আমেরিকানের নাম ছিল মাইকেল ফেল্পস। সেদিন হার মানা ফরাসি সাঁতারুর ছেলে এই লিয়ঁ মাহ্শঁ।
বোম্যানের কারখানায় নাম লেখানোর এক বছরের মধ্যে ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলেতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল মাহ্শঁ। তাঁর বাবা যে ইভেন্টে ফেল্পসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন। ২০২৩-এ জাপানের ফুকুয়োকায় ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলেতে ফেল্পসের রেকর্ড ভেঙে দিলেন মাহ্শঁ। প্রায় এক সেকেন্ড কম সময় নিয়ে তিনি নতুন রেকর্ড গড়েন। সেদিন ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন ফেল্পস। কিংবদন্তির মুখ থেকে শুধু বিস্ময়ভরা উচ্ছ্বাস বেরিয়ে এসেছিল। বোম্যান কি ভাবতেও পেরেছিলেন এমন এক রত্নের ই-মেল সেদিন তাঁর ইনবক্সে পৌঁছেছিল? পরে কিংবদন্তি কোচ বলেছিলেন, মনের মধ্যে কোথাও একটা কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই ছেলেটা অন্যরকম।
দ্রোণাচার্যরা বোধ হয় এ ভাবেই অর্জুনদের ঝলক খুঁজে পান। না হলে প্রথমেই মাইকেল ফেল্পসের ট্রেনিংয়ের বিস্তারিত বিবরণ তিনি মাহ্শঁকে পাঠিয়ে দেবেন কেন? ফেল্পসের উচ্চতা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি। মাহ্শঁ ৬ ফুট ২। ফেল্পসের ‘উইংস্প্যান’ বা হাতের বিস্তার ৭৯ ইঞ্চি। সে রকমই চওড়া, শক্তিশালী কাঁধ। কিন্তু মাহ্শঁ দিনরাত পরিশ্রম করে নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করেন যে, কোথাও পিছিয়ে নেই তিনি। জিমে পড়ে থেকে চওড়া কাঁধ বানিয়েছেন। অন্যরা যে ট্রেনিং সূচি সপ্তাহে দু’বার করে, মাহ্শঁ তা করেছেন সপ্তাহে দশ বার। বোম্যান তাঁকে বলেন ‘টর্পেডো’। আর বোম্যান বলা মানে বুঝতে হবে সেই ছাত্র সেরার সেরা। সহজে তাঁর মুখ দিয়ে কারও জন্য প্রশংসা বেরোয় না। অনুশীলনে অনেক সময় ছাত্র জিজ্ঞেস করেছে, এই ইভেন্টে মাইকেল ফেল্পসের রেকর্ড সময় কত? বোম্যান বলার পরে তখনই তা ভাঙার জন্য পুলে ঝাঁপিয়েছেন তিনি। মানে ফেল্পসের রেকর্ড ভাঙাটাও যে কত বার রিহার্সাল দিয়েছেন গুরু-ছাত্র, হিসাব নেই। তার ফল পাওয়া গিয়েছে প্যারিস অলিম্পিক্সে।
শুধু ফেল্পসের যোগ্য উত্তরসূরি আখ্যা পাওয়াই নয়, লিয়ঁ মাহ্শঁকে নিয়ে দাবি উঠেছে, তাঁকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী করা হোক। অলিম্পিক্স শুরুর ঠিক আগেই তিক্ত নির্বাচন হয়েছে ফ্রান্সে। যে নির্বাচনের পরে বামপন্থীদের নেতৃত্বে জোট সরকার তৈরি হয়েছে। ভিতরে ভিতরে যে পুরোপুরি বিভক্ত দেশ, সেই ছবি বারবার বেরিয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁকে আবেদন জানাতে হয়, অলিম্পিক্সের সময়টা অন্তত আসুন আমরা সবাই এককাট্টা থাকি।
সেই আবেদনে মানুষ সত্যিই সাড়া দেবে কি না, সময় বলবে। কিন্তু অলিম্পিক্সে একটা সময় ফরাসিদের এক দেখিয়েছে। যখন ‘টর্পেডো’ লিয়ঁ মাহ্শঁ পুলে ঝাঁপাচ্ছিলেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy