ম্লান গম্ভীর-বাহিনী।
শাহরুখ খানের রবিবার সেই চেন্নাই থেকে এত দূর ছুটে আসাটা পুরো জলে গেল। নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের শহরে বলিউড বাদশা গিয়েছিলেন স্পনসরশিপের দায়ভার মেটাতে। দ্রুত সব শেষ করে কলকাতার ফ্লাইট ধরেছিলেন প্রিয় টিমের জয় দেখবেন বলে। প্লে অফ সরণিতে টিমের প্রবল ভাবে ঢুকে পড়া দেখবেন বলে। কিন্তু কোথায় কী। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি গেলেন কোথায়?
ইডেনে এলে ক্লাবহাউসের ঠিক ডান দিকের ব্লকের কর্পোরেট বক্স বারান্দায় তাঁকে সাধারণত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু রাত সওয়া এগারোটা নাগাদ সে দিকে প্রবল অনুসন্ধান চালিয়ে তো কোথাও সাদা টি শার্টকে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ তিনি এসেছেন। এত রাতেও তাঁর সিনেমার সব সুপারহিট গান বাজছে। ইডেন দর্শককে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়ার’ অমর টিউন শোনাচ্ছে ডিজে। পরের পর উইকেট যাচ্ছে। এই যেমন এখন অ্যারন ফিঞ্চ গেলেন। গুজরাতের পাঁচ নম্বর উইকেট। তিনি, শাহরুখ খান এখন দেখা দেবেন না তো আর কখন দেবেন?
একটু পর অবশ্য তাঁকে দেখা গেল। দেখা গেল, ইডেন ড্রেসিংরুমের লাগোয়া রাস্তা ধরে শাহরুখ খান হাঁটছেন। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন মাঠের ধারে। সান্ত্বনার হাত রাখছেন প্রিয় নাইট যোদ্ধাদের পিঠে। কী আর করতে পারতেন বাদশা? ফিঞ্চরা আউট হওয়ার সময় দেখা দিতেনও বা কী ভাবে? গুজরাতের ম্যাচ জিততে তো তখন দরকার ছিল এক, মাত্র এক রান!
সোজা কথা সহজে লিখে ফেলা ভাল। আইপিএলে এটা কেকেআরের প্রথম হার এমন নয়। রবিবার যুদ্ধের আগেও হেরেছে। পরেও হারতে পারে। কিন্তু প্রথম হল, হারের ধরন। চলতি আইপিএলে এমন একপেশে উড়ে কখনও তো যায়নি কেকেআর। এত নির্দয় ভাবে কোনও টিম তো হারাতে পারেনি নাইটদের। অথচ টুর্নামেন্টের অতীব গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে গুজরাতের সিংহরা কি না ঠিক সেটাই করে গেল? মানসিক বর্ম টুকরো করে দেওয়া হার কি না ঘরের টিমকে উপহার দিয়ে গেল তারই ঘরের মাঠে, ইডেন নামক এক জনসমুদ্রের সামনে!
জনসমুদ্র। ঠিকই পড়লেন। আইপিএলে রবিবারই প্রথম নিজের চিরন্তন ক্রিকেট ধর্ম মেনে আবির্ভূত হয়েছিল ইডেন। চেয়ার ফাঁকা প্রায় নেই বললেই চলে, অফিশিয়াল হিসেবটা শোনা গেল পঞ্চাশ হাজারের উপরে। কে জানত, গভীর রাতে সেই কেকেআরের জয়-পিপাসু জনতাকে এমন শোকার্ত ভাবে ফিরতে হবে। কে জানত, নাইট-পার্টি দেখতে এসে প্রাপ্তি হবে যন্ত্রণার ছায়াছবি। মাত্র ছ’ওভারে যে একটা গোটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেল আজ, রবিবারের ইডেনে। যে ম্যাচ হতে পারত টিমের প্লে অফ ফ্লাইটের মসৃণ রানওয়ে, রাত সাড়ে এগারোটার পর সেটাই টেনশনের মর্মান্তিক স্টেশন। ম্যাচ পড়ে আর চার। জিততে হবে কিন্তু অন্তত দুই।
কোনও সন্দেহ নেই, টুর্নামেন্টের সবচেয়ে মারাত্মক টিমটার বিরুদ্ধে এ দিন খেলতে নেমেছিল কেকেআর। জার্সির রংটাই শুধু কমলা, কিন্তু ভেতরে কোথাও সেই সেই চির-ঔদ্ধত্যের হলুদ জার্সি! এক কথায়, সিএসকে-টু। স্মিথ-ম্যাকালাম। রায়না-ব্র্যাভো। রবীন্দ্র জাডেজা। শুধু একটা মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আর রবিচন্দ্রন অশ্বিন নেই। তা এরা সিংহবিক্রমে প্রতিপক্ষ-বধে ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো আর কোন টিম পড়বে? কিন্তু রায়নাদের রবিবাসরীয় প্রতিপক্ষ— তারাও তো কিছু কম নয়। আইপিএল ইতিহাসে তাদের কীর্তিও সিএসকের মতোই সমান স্বর্ণ ঔজ্জ্বল্যের দাবি রাখে। তারাও দু’বারের টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন। তারা কেন এ ভাবে কেঁপে যাবে? রোজ আলেকজান্ডার হওয়া অসম্ভব। কিন্তু পুরুর লড়াইটা দেওয়াও কি খুব কঠিন?
কেকেআর আর যা-ই করুক, উইকেটকে কাঠগড়ায় তুলতে পারবে না। উইকেটে ঘাস এ দিন যথেষ্ট কাটা হয়েছিল। আর সেটা মোটেও ২৪-৪ হয়ে যাওয়ার মতো পিচ ছিল না। পিচে গতি, বাউন্স দু’টোই ছিল। বল পড়ে ভাল এসেছে ব্যাটে। কিন্তু মুশকিল হল, কেকেআর মালিক থেকে গড়িয়াহাটের ফল বিক্রেতাও এখন জানেন যে নাইটদের রান পেতে হলে গম্ভীর-উথাপ্পা জুটিকে খেলতে হবে। তাঁরা প্রথমে সত্তর-আশি তুলে টিমকে বিশ্বাসের একটা বাস্তব জমি দেবেন। যার উপর দাঁড়িয়ে কেকেআর পরে ইউসুফ নামাবে। আন্দ্রে রাসেল ছেড়ে দেবে। বিপক্ষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবিষ্কার করবে, জোড়া বম্বারের কার্পেট বম্বিংয়ে তারা ম্যাচ থেকে আহত ও অবসৃত।
আজ কি না ছ’ওভারে কেকেআরই ম্যাচ থেকে আহত ও অবসৃত হয়ে গেল! প্রবীণ কুমার বহু দিন ভারতীয় ক্রিকেটের আকাশ থেকে বিলুপ্ত তারা হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আজ তাঁর সুইংয়ের সামনে নাইট ব্যাটসম্যানদের দেখে মনে হল যেন ওয়াসিম আক্রম খেলছেন! লেগস্টাম্প লাইনে ফেলে গম্ভীরকে বোল্ড করে দিলেন গুজরাতের ‘পিকে’। দু’বল পর মণীশ পাণ্ডে। পা নড়ল না। পরের ওভারে ধবল কুলকার্নি এলেন। আর উথাপ্পাকে নিয়ে চলে গেলেন। কেকেআর প্রথমে ২১-৩। দ্রুত ২৪-৪।
পরিসংখ্যান দেখাচ্ছিল যে, আইপিএল নাইনে কেকেআরের আজ পর্যন্ত কোনও ম্যাচে পাওয়ার প্লে-র মধ্যে দু’উইকেট যায়নি। এ দিন চারটে চলে গেল। ইউসুফ পাঠান প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন। পদ্মাপারের সাকিব নিজের অফ ফর্মের ঘুম ভেঙে এ দিন জেগে উঠলেন। কিন্তু দু’জনের ১৩৪ রানের পার্টনারশিপ বাইশ গজে টিমের ব্যাটিং-লাঞ্ছনা শুধু আটকাতে পারল শেষ পর্যন্ত। জেতাতে পারল না। আসলে ১৫৮ দিয়ে যে কোনও টিমের বিরুদ্ধেই টি-টোয়েন্টিতে জেতা মুশকিল। আর এটা তো সিএসকে-টু। যারা পাওয়ার প্লে-তে কেকেআরের ২৪-৪-এর উত্তরে তুলে দিল ৪৬-১।
রায়নাদের হুঙ্কার, বিমর্ষ শাহরুখ। রবিবার ইডেনে।
কেকেআর বোলিংয়ের মতো অধিনায়কও কিছু ভুল করলেন। সুরেশ রায়না এলে যে টিমের সেরা পেস অস্ত্রকে লেলিয়ে দিতে হয়, তা এখন বিশ্বে সর্বজনবিদিত। গম্ভীর রায়নাকে দেখামাত্র মর্কেল ডাকলেন, কিন্তু সেই ওভারে একটা বলও রায়নাকে খেলতে হল না। মর্কেলকে কোনও এক অজানা কারণে তার পর সরিয়ে নিলেন গম্ভীর। পাঠালেন ব্র্যাড হগকে। যে ওভার থেকে মাত্র ১৪ রান নিয়ে গেলেন দীনেশ কার্তিক। কেকেআর রায়নাকে ঠিকঠাক শর্ট করল রাসেলকে এনে। আর সেটাতেই আউট। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
এত রায়না-রায়না করার কারণ কার্তিকের সঙ্গে তাঁর অমূল্য ৪৯ পার্টনারশিপ। একে তো এ সব চাপের ম্যাচে বিশেষ বিলাসিতার জায়গা থাকে না। একটা-দু’টো পার্টনারশিপেই ম্যাচ বেরিয়ে যায়। সেখানে তিনটে চল্লিশের উপর পার্টনারশিপ করে গেল গুজরাত। যার মধ্যে রায়না-কার্তিকেরটা কোহিনুর, কারণ ওটা ছিল জয়-হারের মোহনায় দাঁড়িয়ে। গুজরাত অধিনায়ককে ওখানে আরও একটু আগ্রাসন দেখিয়ে তুলে নিতে পারলে কে বলতে পারে, অঘটন ঘটত না।
অঘটনই বটে। সিএবি-তে কেউ কেউ বলছিলেন যে, মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আসলে ভারতীয় ক্রিকেটের পুরনোদের রবিবারই ছিল। কেকেআর জিতত কী ভাবে? বিশাখাপত্তনমে আশিস নেহরা মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে একা হাতে ধ্বংস করে দিলেন। ইডেনে প্রবীণ কুমার। কে জানে, হয়তো বা। ইডেনে যে এ দিন প্রবীণ কুমার ম্যান অব দ্য ম্যাচ নিয়ে যাবেন তাতে কোনও আশ্চর্য নেই। আশ্চর্যের হল, কত দিন পর আবার পেলেন, সেটা।
২০০৮ সালের পর আজ আবার! আইপিএল জন্মের বছরের পর আবার! সত্যি, আজ বোধহয় ক্রিকেটে বর্তমানদের দিন ছিল না। বিশাখাপত্তনম থেকে কলকাতা— আজ প্রবীণের দিন, প্রবীণেরই রাত।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: কলকাতা নাইট রাইডার্স ২০ ওভারে ১৫৮-৪ (সাকিব ৬৬ ন.আ, ইউসুফ ৬৩ ন.আ), গুজরাত লায়ন্স ১৮ ওভারে ১৬৪-৫ (কার্তিক ৫১, ফিঞ্চ ২৯)।
ছবি: উৎপল সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy