মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে শেষবার নীল জার্সিতে দেখা গিয়েছিল গত বছরের জুলাইয়ে। —ফাইল চিত্র।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বোল্ড কোভিড১৯!
না, কোনও স্কোরবোর্ডে এটা পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক এটাই। ভারতের সফলতম অধিনায়কের ক্রিকেট কেরিয়ারে দাঁড়ি টানল করোনাভাইরাস। এর বিশ্বব্যাপী প্রভাবের জেরেই পড়ল রাঁচির ক্রিকেটারের উইকেট। নিছক উইকেট নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেই আলবিদা জানাতে বাধ্য হলেন দুনিয়ার সেরা ফিনিশার।
২০১৯ সালের ১০ জুলাই। রান-আউট হয়ে ফিরতে থাকা ধোনির যন্ত্রণা ছুঁয়ে গিয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের। তারপর থেকে ক্রিকেটার ধোনি চলে গিয়েছিলেন অজ্ঞাতবাসে। কে জানত, আর ফেরা হবে না টিম ইন্ডিয়ার জার্সিতে। ভাবাই যায়নি, করোনাভাইরাসের আবির্ভাবে ক্রীড়াসূচি এতটাই ঘেঁটে যাবে যে বছর দেড়েকের মধ্যে আর ম্যাচই পাবেন না এমএসডি!
আরও পড়ুন: ‘তোমার অবদান অসীম’, টুইটারে জয়-ধোনি সচিন থেকে গম্ভীরের
মনে করা হয়েছিল, চলতি বছরের শেষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ তাঁর পাখির চোখ। মার্চে আইপিএলের মরিয়া প্রস্তুতিতে তেমন ইঙ্গিতই মিলছিল। কিন্তু সেই সময়ই আবির্ভাব ঘটল কোভিডের। তালাচাবি পড়ল মাঠে। অনিশ্চয়তার সরণিতে পৌঁছে গেল ক্রিকেটের সূচি। কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় হতে চলা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পিছিয়ে গেল। যা হতে চলেছে ২০২১ সালের অক্টোবরে। সেই সময় হচ্ছে আইপিএল। কিন্তু সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতকে কবে দেখা যাবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। বছরের শেষে অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ খেলতে যাওয়ার কথা বিরাট কোহালিদের। ফলে, নতুন বছরের আগে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি, নীল জার্সিতে কোনও ম্যাচ পাচ্ছেন না ধোনি। গত বছরের জুলাই থেকে ধরলে সময়টা কমপক্ষে দেড় বছর। আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যদি বিদায়বেলার মঞ্চ হিসেবে পছন্দ হয়ে থাকে, তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে দুই বছরেরও বেশি। হাতে এত সময় ছিল না। বয়স বাড়ছে, ব্যাট-প্যাড-গ্লাভস থেকে দূরে থাকার মেয়াদও তো বাড়ছে। অনন্ত প্রতীক্ষার অবসর কোথায় তাঁর!
করোনার এই ঘাতক ডেলিভারিই কার্যত ভাঙল ধোনির স্টাম্প। করল বোল্ড। স্বাধীনতার দিনের উৎসবের মেজাজ আচমকা বদলে গেল মাহি-ভক্তদের বিষাদে। শুধু তো ভক্তরাই নন, প্রাক্তনদেরও দেখাচ্ছে আবেগবিহ্বল। টুইটারে আসছে একের পর এক তোলপাড় করা মন্তব্য। কিন্তু, তার মধ্যেও অন্তর্লীন সুরে বাজছে করোনার প্রভাব।
আনন্দবাজার ডিজিটালকে কারসন ঘাউড়ি যেমন সাফ বললেন, “আগামী দিনে কী হবে, কবে খেলা শুরু হবে ভারতের, তা এখনও কেউ জানে না। পুরোটাই অনিশ্চিত। হয়তো সেই কারণেই অবসরের কথা জানিয়ে দিল ধোনি।” প্রাক্তন উইকেটকিপার সদানন্দ বিশ্বনাথ বললেন, “ধোনি একদম ঠিক সময়েই অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ও জানে যে এখন করোনা চলছে। খেলা নেই ভারতের। সবাই উদ্বিগ্ন জীবন নিয়ে। প্রত্যেকেই ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কিত। তাই ধোনির সিদ্ধান্ত যথাযথ।”
বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও একমত নন। তাঁর মতে, চরম সিদ্ধান্তে আসতে বছরখানেক দেরি করলেন ধোনি। সম্বরণের কথায়, “আমি যদি ধোনি হতাম, তা হলে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের কাছে পরাজয়ের পরই অবসর নিতাম। সুনীল গাওস্কর বাই-সেন্টিনারি ম্যাচে ১৮৮ করার পর অবসরের সিদ্ধান্তে এসেছিল। থামতে জানা একটা আর্ট। আমার কথাও বলতে পারি। রঞ্জি ট্রফি জেতার পর তিন বছর আরামসে খেলতে পারতাম। কিন্তু তখনই অবসর নিয়েছিলাম। থামতে জানতে হয়।” ধোনির সিদ্ধান্তে অবশ্য একেবারের অবাক নন ঘাউড়ি। বললেন, “ধোনি তো আর হুইমজিক্যাল নয়। তবে ও সিদ্ধান্ত নেয় তাৎক্ষণিক ভাবে। যখন ও অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজে ক্যাপ্টেন ছিল, তখনও সবাইকে অবাক করে নেতৃত্ব ছেড়েছিল। বিদায় জানিয়েছিল টেস্ট ক্রিকেটকেই। যা রীতিমতো হতবুদ্ধিকর (পাজলিং)। তবে এটাই ধোনি। এ ভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়। ওর সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচার করা তাই খুব কঠিন। ”
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন ধোনি
কিন্তু, ধোনির মতো ক্রিকেটার করোনাকালে কার্যত আড়ালে থেকেই সরে গেলেন আন্তর্জাতিক আসর থেকে। বিদায়বেলায় মাঠে উপস্থিত থেকে অঞ্জলি দেওয়ার সুযোগ অধরা থেকে গেল ভক্তদের। দুই ফরম্যাটে বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, টেস্টে ভারতকে এক নম্বর করা অধিনায়কের এমন চুপিসাড়ে চলে যাওয়াই কি প্রাপ্য ছিল? সচিন তেন্ডুলকর বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিদায়ী সিরিজ তো শেষবেলায় থাকতেই পারত মেনুতে। সেই সুযোগই মিলল না। দিলেন না ধোনিই। নাকি, করোনাই কেড়ে নিল সেই সুযোগ? সদানন্দ বিশ্বনাথ অবশ্য অন্য ভাবে দেখছেন, “কিছু ক্রিকেটার সেন্ড-অফ পায়। তারা ফেয়ারওয়েল ম্যাচ পায়। জনতার হাততালি সঙ্গী হয় শেষ মুহূর্তে। কিন্তু ধোনি এগুলো চাওয়ার মতো লোক নয়। ও কোনও ড্রামা চায় না। ও নাটকীয়তা বাদ দিয়ে চলেছে এর আগেও। তাই সঠিক সময়েই সরে গেল। আর ওর কেরিয়ারে গৌরবের মুহূর্ত তো কম নেই। ও শুধু ক্রিকেটারদের কাছেই নয়, বিশ্বজুড়েই ছেলে-মেয়েদের কাছে অনুপ্রেরণা।”
সম্বরণের আবার শেষের মুহূর্তে মনে ভাসছে প্রথম দেখার কথা। বললেন, “২০০২ সালে আগরতলার পলিটেকনিক মাঠে ঝাড়খণ্ড বনাম বাংলার ম্যাচে প্রথমবার দেখি ধোনিকে। তখন আমি বাংলার কোচ। টস জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলাম। তখনও ধোনি কে, জানতামই না। দেখি বড় বড় চুলের একটা ছেলে ওপেন করতে নেমে শিবশঙ্কর পাল ও রণদেব বসুকে দুমদাম মারছে। যা খুব একটা অর্গানাইজিং ক্রিকেট শট নয়। আমি সাইটস্ক্রিনের কাছে গিয়ে রণকে বললাম, ওকে একটু আস্তে বল কর। ও চাইছে বল যেন ব্যাটে আসে। রণ দুটো নাকল বল করল। তাতেই আউট হল। টপ এজে লেগে পয়েন্টে আউট হয়ে গেল ধোনি। এই প্রথম ধোনিকে দেখা।”
২০০৭ সালে জোহানেসবার্গে পাকিস্তানকে হারিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ধোনির জার্সি বিতরণের ছবি এখনও দেখতে পাচ্ছেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, “দলের বাকি ১০জনের আবেগ-উচ্ছ্বাস-উল্লাস সবই দেখেছিলাম চ্যাম্পিয়ন হয়ে। কিন্তু ধোনিকে দেখলাম একেবারে শান্ত। ভাবছিলাম, এই ছেলেটা কে! ক্যাপ্টেন হিসেবে শেষ ওভারে যোগিন্দরকে বল দিয়েছিল। যা ভাবাই যায় না। আবার ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে যুবরাজ যখন ড্রেসিংরুমে বমি করছিল, তখন গ্যারি কার্স্টেনকে বলেছিল, আই উইল গো বিফোর যুবি। গেল এবং ছয় মেরে জেতাল। এটাও ইতিহাস।”
শনিবার থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধোনিও পরিণত হলেন ইতিহাসে। কিন্তু, ভাবাই যায়নি যে ছক্কায় বিশ্বকাপ জেতানোর নায়ককে অনন্ত প্রতীক্ষার স্টেশনে পৌঁছে উইকেট নেবে করোনা। কে জানত, সেরা ফিনিশারের ‘ফিনিশিং’ এমন হবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy