ইউএস ওপেন হাতে ইয়ানিক সিনার। ছবি: রয়টার্স।
বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম ইয়ানিক সিনারের। প্রথমটিও জিতেছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের পর এই বছর ইউএস ওপেনও জিতলেন বিশ্বের এক নম্বর টেনিস তারকা সিনার। হারিয়ে দিলেন আমেরিকার টেলর ফ্রিৎজ়কে। ডোপ বিতর্ক পার করে সিনার ইউএস ওপেনের ফাইনালে জিতলেন ৬-৩, ৬-৪, ৭-৫ গেমে।
রবিবার রাতে নামার আগেই সিনার জানতেন তাঁর লড়াই শুধু ফ্রিৎজ়ের বিরুদ্ধে নয়। আমেরিকার টেনিস তারকার জন্য যে, গোটা গ্যালারি চিৎকার করবে সেটা সেমিফাইনালেই বুঝে গিয়েছিলেন বিশ্বের এক নম্বর। সেটাই হল। রবিবার ফ্রিৎজ় যত বার পয়েন্ট পেয়েছেন, তত বার শব্দব্রহ্ম তৈরি হয়েছে আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে। সেই শব্দ থেমে যাচ্ছিল সিনার পয়েন্ট পেতেই। কখনও কখনও চিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল ম্যাচটা বোধ হয় ফ্রিৎজ় জিতছেন। কিন্তু স্কোরবোর্ড সেটা বলছিল না। ফ্রিৎজ় হয়তো লড়াই করেছেন, কিন্তু সেটা সেট জেতার জন্য যথেষ্ট ছিল না। স্ট্রেট সেটে ম্যাচ জিতে নেন সিনার।
ইতিহাস গড়লেন সিনার। প্রথম ইটালীয় হিসাবে ইউএস ওপেন জিতলেন তিনি। ২৩ বছরের সিনার ক্রমতালিকায় বিশ্বের এক নম্বর। কিন্তু তাঁর গ্র্যান্ড স্ল্যাম সংখ্যা মাত্র দুই। এই বছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছিলেন তিনি। বছরের শুরু এবং শেষটা ভাল হল তাঁর। হার্ড কোর্টের দু’টি গ্র্যান্ড স্ল্যামই জিতে নিলেন তিনি। এ বারের ইউএস ওপেন ছিল অঘটনের। কার্লোস আলকারাজ় এবং নোভাক জোকোভিচ কোয়ার্টার ফাইনালের আগেই বিদায় নেন। এমন ঘটনা খুব একটা দেখা যায় না। এমন অঘটনের মাঝে সিনার প্রমাণ করলেন তিনি কেন এক নম্বর। জিতে নিলেন ইউএস ওপেন। তাঁর হাতে ট্রফি তুলে দেন আন্দ্রে আগাসি।
দর্শক ছিল ফ্রিৎজ়ের পক্ষে। ঘরের ছেলের জন্য টানা চিৎকার করে গিয়েছে গ্যালারি। ২৬ বছরের ফ্রিৎজ় বিশ্বের ১২ নম্বর। এই প্রথম কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে খেলতে নেমেছিলেন তিনি। ফ্রিৎজ়ের প্রধান শক্তি তাঁর সার্ভিস। কিন্তু সিনারের বিরুদ্ধে সেই অস্ত্রই ভোঁতা হয়ে গেল। প্রথম এবং দ্বিতীয় সার্ভে পয়েন্ট জেতার শতাংসে এগিয়ে রইলেন সিনার। যদিও ফ্রিৎজ় ১০টি এস মারেন। সিনার সেখানে ছ’টি এস মেরেছেন। ফ্রিৎজ়ের সার্ভে পয়েন্ট তুলতে না পারাই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির সিনার দর্শকের চিৎকারের সঙ্গে উড়িয়ে দিলেন ফ্রিৎজ়ের সার্ভও।
সিনার শুধু ইউএস ওপেন জিতলেন না সেই সঙ্গে জবাব দিলেন সমালোচকদেরও। এই গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলতে নামার বিতর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মার্চে ইন্ডিয়ান ওয়েলস প্রতিযোগিতায় খেলার সময় সিনারের শরীরে ক্লোস্টেবল নামে একটি পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল। টেনিস তারকার টেস্টস্টেরনে ওই পদার্থ ছিল। বিশ্ব অ্যান্টি ডোপিং এজেন্সি (ওয়াডা) ক্লোস্টেবল পদার্থটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক টেনিস ইন্টিগ্রিটি এজেন্সি (আইটিআইএ) সিনারের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তারা জানিয়েছে, ইটালির টেনিস তারকা ইচ্ছাকৃত ভাবে ডোপিং করেননি। তাঁর ফিজিয়োথেরাপিস্ট না জেনে কোনও একটি ওষুধ দিয়েছিলেন, সেটার মধ্যে ক্লোস্টেবল ছিল।
সিনারের শাস্তি না হওয়া মেনে নিতে পারেননি দুই টেনিস খেলোয়াড়। নিক কিরিয়স মনে করেন সিনারকে অন্তত দু’বছরের জন্য নির্বাসিত করে দেওয়া উচিত। ২০২৩ সালে স্টুটগার্ট ওপেনে শেষ বার খেলতে দেখা গিয়েছিল কিরিয়সকে। তিনি বলেন, “জঘন্য বিষয়। জেনে হোক বা না জেনে। দু’বার পরীক্ষা করা হয়েছে। এবং সেখানে স্টেরয়েড জাতীয় নিষিদ্ধ পদার্থ পাওয়া গিয়েছে। অন্তত দু’বছরের জন্য নির্বাসিত করা উচিত ছিল। ওই ওষুধের ফলে সিনারের খেলতে সুবিধা হয়েছে।” ডেনিস শাপোভালভ ২০২১ সালে উইম্বলডনের সেমিফাইনাল খেলেছিলেন। তিনি বলেন, “আমার খারাপ লাগছে সেই সব খেলোয়াড়দের জন্য যাঁরা ডোপিংয়ের জন্য নির্বাসিত হয়েছেন।”
সিনার পাশে পেয়েছিলেন তাঁর কোচকে। সিনারের শরীরে ওই পদার্থ নাকি ঢুকেছে মালিশ করার স্প্রের মধ্যে দিয়ে। কোচ ড্যারেন কাহিল বলেছিলেন, “সিনার বুঝতে পেরেছিল কী ভাবে ওর শরীরে ওই নিষিদ্ধ পদার্থ ঢুকেছে। সেই কারণে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। সব নিয়ম মানা হয়েছিল বলেই সাময়িক নির্বাসন উঠে গিয়েছে।”
১৫ অগস্ট সিনারের ডোপিং নিয়ে শুনানি ছিল। সেখানে টেনিস খেলোয়াড় বুঝিয়েছেন, তাঁর এক ফিজিয়ো মালিশ করার সময় একটি স্প্রে ব্যবহার করেছিলেন। একটি চোট সারানোর জন্য ওই স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই স্প্রের মধ্যে ক্লোস্টেবল ছিল। সেটাই সিনারের শরীরে ঢুকে যায়। সিনারের সেই দাবি মেনে নেয় আইটিআইএ। সেই কারণে তাঁকে কোনও শাস্তি দেওয়া হয়নি।
প্রথম টিনএজার হিসাবে সিনার এটিপি ৫০০ পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন ২০২১ সালের সিটি ওপেনে। জোকোভিচের পর সিনারই কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসাবে পাঁচটি এটিপি খেতাব জিতেছেন। পেশাদার টেনিসজীবনের শুরুতেই জোকোভিচের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেওয়া সিনারের বাবা একটি রেস্তোরাঁর শেফ। মা ওই রেস্তোরাঁরই কর্মী। উত্তর ইতালির সান ক্যানডিডোয় জন্ম সিনারের। মাত্র তিন বছর বয়স থেকে টেনিস শিখতে শুরু করা সিনারের পছন্দের খেলার তালিকায় রয়েছে স্কি এবং ফুটবল। আট বছর বয়সেই ইতালির অনূর্ধ্ব ১২ পর্যায়ের টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হন সিনার। ১৩ বছর পর্যন্ত টেনিসের পাশাপাশি নিয়মিত ফুটবলও খেলতেন। পরে অবশ্য টেনিসকেই বেছে নিয়েছেন। সেই টেনিস র্যাকেট হাতে বিশ্বকে আগামী দিনে সিনার শাসন করবেন বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞই।
১৭ বছর বয়সেই টেনিসকে পেশা হিসাবে বেছে নেন সিনার। জুনিয়র পর্যায়ে অবশ্য কখনও গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলেননি। সে সময় ক্রমতালিকাতেও তেমন উল্লেখযোগ্য জায়গায় ছিলেন না। ইউএস ওপেনজয়ী সিনারের সেরা জুনিয়র র্যাঙ্কিং ছিল ১৩৩। ১৩ বছর বয়স থেকে টেনিসকে গুরুত্ব দিতে শুরু করার পর থেকে ক্রমশ উন্নতি করেন তিনি। সে সময় তাঁর আট বছর বয়সের সাফল্যকে ব্যতিক্রম হিসাবেই ধরতেন অনেকে।
সিনারের খেলার সঙ্গে অনেকে আবার মিল পান রজার ফেডেরারেরও। ফেডেরারের মতোই অত্যন্ত দ্রুত টেনিস কোর্টের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারেন তিনি। শক্তিশালী ফোরহ্যান্ডের পাশাপাশি ব্যাকহ্যান্ডেও দক্ষ তিনি। ফেডেরার নিজেও সিনারের প্রশংসা করে এক বার বলেছিলেন, ‘‘সিনার আমার মতোই ফোরহ্যান্ড এবং ব্যাকহ্যান্ড মারে।’’
এসি মিলানের অন্ধ ভক্ত সিনার ইতালিয়ান ছাড়াও ইংরাজি এবং জার্মান ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। রবিবার আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়াম দেখল চাইলে চুপও করিয়ে দিতে পারেন সিনার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy