সেরা: চেন্নাইয়িন এফসি-কে হারিয়ে ফের আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে উল্লাস এটিকের ফুটবলারদের। শনিবার মারগাওয়ে। এএফপি
আই লিগ থেকে আইএসএল। মোহনবাগানের পরে এটিকে— ফুটবলে ফের ভারত সেরা বাংলা। নেপথ্যে দুই স্পেনীয় চাণক্য। কিবু ভিকুনা ও আন্তোনিয়ো লোপেস হাবাস।
শনিবার গোয়ার মারগাওয়ে ফতোরদা স্টেডিয়ামে রেফারি শেষ বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত শূন্যে তুলে গ্যালারির দিকে তাকালেন হাবাস। চেন্নাইয়িন এফসিকে হারিয়ে আইএসএলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে হয়তো এটিকে কোচ ভুলে গিয়েছিলেন, করোনা-আতঙ্কে দর্শক শূন্য স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে। ভুল ভাঙার পরে আর সময় নষ্ট করেননি। ঝড়ের গতিতে মাঠে ঢুকে পড়লেন হাবাস।
৩৯ মিনিটে চোট পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন রয় কৃষ্ণ। এত যন্ত্রণা হচ্ছিল যে বাঁ-পা ভাজ করতেই পারছিলেন না। কিন্তু ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও লাফিয়ে উঠলেন। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোচের পিছনে পিছনে দৌড়লেন মাঠের ভিতরে। হাবাসের মতো তিনিও খুঁজছিলেন জোড়া গোল করে এটিকের জয়ের নায়ক হাভিয়ার হার্নান্দেসকে। কিন্তু কোথায় গেলেন এটিকে মিডফিল্ডার? হাবাসের মতো তিনিও ভুলে গিয়েছিলেন, দর্শক শূন্য মাঠে খেলা হচ্ছে। ম্যাচের ১০ মিনিটে প্রথম গোল করেন হাভিয়ার। দ্বিতীয় গোল তিনি করেন সংযুক্ত সময়ে। প্রত্যেকবারই গোল করে দৌড়ে চলে গিয়েছিলেন গ্যালারির সামনে। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেও এক ছবি। সম্বিত ফেরার পরে তিনি খুঁজতে শুরু করেন রয় কৃষ্ণ ও প্রণয় হালদারকে। তাঁদের জন্যই তো শাপমুক্ত হাভিয়ার!
আইএসএলে এই মরসুমে গোল করতে না পারার যন্ত্রণা নিয়েই শনিবার চেন্নাইয়িনের বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলতে নেমেছিলেন তিনি। প্রথম গোল তিনি করেন রয় কৃষ্ণের পাস থেকে। তাঁর দ্বিতীয় গোলের নেপথ্যে প্রণয় হালদার। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে হাভিয়ার তাই খুঁজছিলেন রয় কৃষ্ণ ও প্রণয়কে। কিন্তু দুই সতীর্থের কাছে পৌঁছবেন কী করে? সকলেই অভিনন্দন জানাতে চান হাভিয়ারকে। শেষ পর্যন্ত হাবাসই তাঁকে উদ্ধার করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এর পরে হাবাসকেই শূন্য ছুড়ে উৎসবে মেতে ওঠেন এ দিনের ম্যাচের সেরা অরিন্দম ভট্টাচার্য, প্রীতম কোটালেরা। এটিকের আর এক গোলদাতা এদু গার্সিয়া স্পেনের জাতীয় পতাকা শরীরে জড়িয়ে মাঠের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে দৌড়চ্ছিলেন। হতাশ হয়ে চেন্নাইয়িনের অন্যতম অংশীদার বলিউড তারকা অভিষেক বচ্চনের পাশে দাড়িয়ে দেখছিলেন দলের একমাত্র গোলদাতা নেরিউস ভালস্কিস।
প্রথম বছর হাবাসের কোচিংয়েই আইএসএল জিতেছিল এটিকে। তৃতীয় ট্রফিও এল স্পেনীয় কোচের হাত ধরে। দুর্দান্ত সাফল্যের রহস্যটা কী? সাংবাদিক বৈঠকে হাবাস বললেন, ‘‘যাবতীয় কৃতিত্ব ফুটবলারদের। দলগত সংহতি আমাদের সাফল্যের নেপথ্যে। রয় কৃষ্ণ বেরিয়ে যাওয়ার পরেও তাই ফুটবলারেরা হতাশ হয়ে পড়েনি।’’
আইএসএলে এটিকের তৃতীয় বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যে আর এক কারিগর প্রবীর দাসকে দেখা গেল আনন্দে চিৎকার করতে করতে ভিভিআইপি গ্যালারির সামনে চলে এসেছেন। ম্যাচের শুরু থেকেই লাল-সাদা জার্সি পরে কয়েক জন ফুটবলারের আত্মীয় ও এটিকের কিছু কর্মী চিৎকার করছিলেন। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে প্রবীর তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। করোনা-আতঙ্কে এ দিন শ’দুয়েক মানুষ ফতোরদা স্টেডিয়ামে হাজির ছিলেন। এর মধ্যে এটিকে ফুটবলারদের আত্মীয় ও কর্মী মিলিয়ে সংখ্যাটা ২৫। চেন্নাইয়িনের তরফে খেলা দেখতে এসেছিলেন ৩০ জন। বাকিরা আইএসএলের সঙ্গে যুক্ত।
মারগাওয়ের ফতোরদা স্টেডিয়ামে খেলা থাকলে ম্যাচ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই হাজির হয়ে যান ফুটবলপ্রেমীরা। স্টেডিয়ামের সব গেটের সামনে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড থেকে এফসি গোয়া, চার্চিল ব্রাদার্সের জার্সি দেদার বিক্রি হয়। ম্যাচ যদি শনি বা রবিবার হয়, তা হলে তো কথাই নেই। স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায় যানজট সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খান পুলিশকর্মীরা।
করোনা-আতঙ্কে পরিস্থিতিটাই সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় আইএসএল ফাইনাল শুরু হওয়ার মিনিট দশেক আগেও স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তা ফাঁকা। অধিকাংশ দোকান বন্ধ। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের মুখে মাস্ক। চোখে আতঙ্ক। দর্শক শূন্য স্টেডিয়ামে ম্যাচ করতে হবে, তাই আটটির মধ্যে মাত্র দু’টি গেট খোলা রয়েছে। এক নম্বর গেট শুধু মাত্র দু’দলের ফুটবলারদের জন্য। তিন নম্বর গেট খোলা রয়েছে সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের জন্য। গেট দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে স্যানিটাইজার এগিয়ে দিচ্ছিলেন আইএসএলের কর্মীরা। প্রেস বক্স থেকে সাংবাদিক সম্মেলনকক্ষ— সর্বত্র রাখা রয়েছে স্যানিটাইজার। আতঙ্ক এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, মাঠে নামার আগে হাতে স্যানিটাইজার মাখা সত্ত্বেও ম্যাচ শুরুর আগে ফুটবলারেরা কেউ কারওর সঙ্গে হাত মেলানোর ঝুকি পর্যন্ত নেননি। চ্যাম্পিয়ন হয়ে হোটেলে ফিরে গভীর রাতেই কলকাতা রওনা দেয় এটিকে। তৃতীয় বার আইএসএল জয়ের আনন্দে ম্যাচের পরে করোনা-আতঙ্ক উধাও এটিকে শিবির থেকে। প্রীতম, প্রবীর, ডেভিড উইলিয়ামসরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন। হাত মেলাচ্ছেন মাঠের কর্মীদের সঙ্গেও। বলছিলেন, ‘‘চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছি। করোনাভাইরাস নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই।’’
সাফল্য সব কিছুই ভুলিয়ে দেয়।
এটিকে: অরিন্দম ভট্টাচার্য, প্রীতম কোটাল, জন জনসন, সুমিত রাঠি, প্রবীর দাস, রেজিন এম (প্রণয় হালদার), এদুয়ার্দো গার্সিয়া, ফ্রান্সিসকো হাভিয়ার হার্নান্দেস, সুসাই রাজ, ডেভিড উইলিয়ামস ও রয় কৃষ্ণ (আর্মান্দো পেনা, ভিক্তর মনজিল)।
চেন্নাইয়িন এফসি: বিশাল কাইথ, লুসিয়ান গোলিয়ান, এলি ফিলহো, লালডিনলিয়ানা আর, জেরি লালরিনজ়ুয়ালা, অনিরুদ্ধ থাপা, জার্মানপ্রীত সিংহ (এডউইন হেনরি), রাফারেল ক্রিভেলারো, লালিয়ানজ়ুয়ালা ছাংতে, আন্দ্রে সেমব্রি (দ্রাগস পেতরুত) ও নেরিউস ভালস্কিস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy