Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
IPL 2024 Winner

ভোটের লড়াই ছেড়ে মাঠের লড়াইয়ে, গম্ভীর মুখেই আবার কেকেআরে হাসি ফোটালেন গৌতি

গত বছর ২২ নভেম্বর কলকাতা নাইট রাইডার্সের অন্যতম মালিক শাহরুখ খান ঘোষণা করেছিলেন মেন্টর গম্ভীরকে দলে নেওয়ার কথা। বদলটা শুরু হয় সেই দিনই। ফলাফল পাওয়া গেল রবিবার।

gautam gambhir

মেন্টর গৌতম গম্ভীরের হাত ধরে বদলে গিয়েছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২৪ ২২:২৯
Share: Save:

এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “সমর্থকেরা আমার হাসি দেখতে আসে না, দলের জয় দেখতে আসে।” তাঁর সেই গম্ভীর উক্তিই বুঝিয়ে দিয়েছিল, তিনি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। রবিবার কাজ শেষ করেই হাসলেন গম্ভীর। কলকাতা নাইট রাইডার্সের মেন্টর গৌতম আর গম্ভীর নন।

গত বছর ২২ নভেম্বর কলকাতা নাইট রাইডার্সের অন্যতম মালিক শাহরুখ খান ঘোষণা করেছিলেন মেন্টর গম্ভীরকে দলে নেওয়ার কথা। তার আগের মরসুমে বাংলার শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েন্‌কার লখনউ সুপার জায়ান্টসে ছিলেন ভারতের হয়ে দু’টি বিশ্বকাপজয়ী ওপেনার। গোয়েন্‌কা একাধিক বার বলেছেন যে, গম্ভীর দলে থাকায় ক্রিকেটের বিষয়ে তিনি ঢোকেন না। শাহরুখও গম্ভীরকে দলে এনে বলেছিলেন, “গম্ভীরের অভাব বোধ করছিলাম আমরা। অধিনায়ক থেকে মেন্টর হল ও। কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের সঙ্গে গম্ভীরের জুটি দেখার জন্য মুখিয়ে আছি। ওরা হারতে জানে না। কেকেআরের জন্য ওরা ম্যাজিক তৈরি করবে।”

কলকাতায় ফিরে আবেগতাড়িত হয়েছিলেন গম্ভীর। কিন্তু ভেসে যাননি। বলেছিলেন, “আমি আবেগে ভেসে যাই না। কিন্তু এই ঘটনা আমার মধ্যেও আবেগ এনে দিয়েছে। আমি সেই জায়গায় ফিরে গিয়েছি, যেখান থেকে সব কিছু শুরু হয়েছিল। আমার গলা বুজে আসছে। কিন্তু বুকে আগুন অনুভব করছি এটা ভেবে যে, আবার কেকেআরের জার্সি পরতে পারব। আমি শুধু কেকেআরে ফিরছি না। আমি কলকাতায় ফিরছি। জয়ের খিদে নিয়ে ফিরছি।”

SRK with Gautam Gambhir

শাহরুখ খানের সঙ্গে গৌতম গম্ভীর। —ফাইল চিত্র।

শাহরুখ বা গম্ভীরের সেই কথাগুলো নিছক বলার জন্য ছিল না। আইপিএল জয়কে পাখির চোখ করে নিয়েছিলেন তাঁরা। না হলে কেকেআরের দায়িত্ব সামলাবেন বলে সাংসদ গম্ভীর রাজনৈতিক জীবন থেকে সরে আসবেন কেন? ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হয়ে ভোটে লড়ে সাংসদ হয়েছিলেন গম্ভীর। পাঁচ বছর দায়িত্ব সামলানোর পর লোকসভা ভোটের আগেই দায়িত্ব ছাড়েন তিনি। লোকসভা ভোটের ঠিক মুখে কেকেআর মেন্টর ঘোষণা করেছিলেন তিনি তাঁর রাজনৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে অব্যাহতি চান। সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, “আমি আমার সম্মাননীয় দলীয় সভাপতি জেপি নড্ডাজিকে অনুরোধ করেছি, আমাকে আমার রাজনৈতিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে। যাতে আমার আসন্ন ক্রিকেটীয় কর্তব্য পালনে বেশি মনোযোগ দিতে পারি। আমি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আমাকে মানুষের কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। জয় হিন্দ।” যদিও তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে এখনও লেখা ‘মোদী কি পরিবার’। বোঝাই যাচ্ছে শুধু মাত্র কেকেআরের মেন্টরের দায়িত্ব সামলানোর জন্যই রাজনৈতিক দায়িত্ব থেকে সরে এসেছিলেন তিনি।

গম্ভীর লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছিলেন। ২৬ মে আইপিএলের ফাইনালে দলকে তোলার সেই লক্ষ্যপূরণও করেন। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে এক বার অনুশীলনে গম্ভীরকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “২৬ মে পর্যন্ত আমাদের থাকতে হবে। তার জন্য নিজেদের উজাড় করে দিতে হবে। সেটা আজ থেকেই সকলে শুরু করে দাও। আমাদের প্রত্যেককে এক রকম ভাবতে হবে। একসঙ্গে লড়াই করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, তা হলেই সাফল্য আসবে।” আইপিএল শুরুর এক সপ্তাহ আগেই দলকে বলে দিয়েছিলেন তাঁর লক্ষ্য।

সেই লক্ষ্যপূরণ করার জন্য কী কী করেছিলেন গম্ভীর? কী ভাবে বদলে দিয়েছেন কেকেআর-কে? গত বারের থেকে কোথায় আলাদা এ বারের নাইটরা?

Gautam Gambhir and Sunil Narine

সুনীল নারাইনের সঙ্গে গৌতম গম্ভীর। —ফাইল চিত্র।

মেন্টর হিসাবে দায়িত্ব নিয়েই গম্ভীরের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল সুনীল নারাইনকে ওপেনার করে দেওয়া। গত মরসুমে কেকেআরের সব থেকে বড় সমস্যা ছিল ওপেনিং। বার বার সেই জুটি বদলাতে হয়েছিল। কিন্তু এই মরসুমে নারাইন এবং ফিল সল্টের জুটিই পুরো লিগ পর্বে খেলেছে। সল্ট দেশে ফিরে যাওয়ার পর তাঁর জায়গায় এসেছেন রহমানুল্লা গুরবাজ়। ২০১৪ সালে শেষ বার আইপিএল জিতেছিল নাইট রাইডার্স। গম্ভীর তখন কেকেআরের অধিনায়ক। সেই দলে ছিলেন নারাইন। পুরনো সতীর্থকে ওপেনার হিসাবে কাজে লাগালেন গম্ভীর। সেটাই কেকেআরের সব থেকে বড় মাস্টারস্ট্রোক। ১৩ ম্যাচে ৪৮৮ রান করেছেন নারাইন। একটি শতরান এবং তিনটি অর্ধশতরানও করেন তিনি। গত বারও দলে ছিলেন নারাইন। কিন্তু কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত তাঁকে ওপেনার হিসাবে কাজে লাগাতে পারেননি। গম্ভীরের ছোঁয়ায় নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেলেন নারাইন।

কেকেআরের প্রাক্তন অধিনায়ক গম্ভীর জানেন কী ভাবে দলকে নেতৃত্ব দিতে হয়। মাঠে সেই কাজ শ্রেয়স আয়ারের থাকলেও মাঠের বাইরে থেকে কাজটা করছিলেন গম্ভীর। তাতেই কেকেআর খুঁজে পায় হর্ষিত রানা, বৈভব আরোরা, রমনদীপ সিংহ এবং অঙ্গকৃশ রঘুবংশীকে। দেশের হয়ে না খেলা এই ভারতীয়রাই বাকি দলের থেকে কেকেআর-কে আলাদা করে দেয় এ বারের আইপিএলে। পেসার হর্ষিত এবং বৈভব যেমন ঢেকে দেন মিচেল স্টার্কের ব্যর্থতা। প্রথম দিকে ২৪ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকার পেসার উইকেট পাচ্ছিলেন না, রান দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাতে দল ম্যাচ জিতছিল। সেটার কারণ অবশ্যই বৈভবেরা। রিঙ্কু সিংহ এ বারের আইপিএলে রান পাননি। সেই অভাব ঢেকে দেন রমনদীপ। ফিনিশারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তিনি। প্রথম ম্যাচে চোট পেয়ে ১০ ম্যাচের জন্য প্রথম একাদশের বাইরে ছিলেন নীতীশ রানা। সেই অভিজ্ঞ রানার জায়গায় খেলানো হয় তরুণ অঙ্গকৃশকে। হতাশ করেননি তিনিও।

দলের সকলের মধ্যে জেতার খিদেটা এনে দিয়েছেন গম্ভীর। তাই দল কোনও ম্যাচে ব্যর্থ হলে দোষারোপ করা হয়নি। এই শিক্ষা গম্ভীরেরই। না হলে প্রতি ম্যাচে ৫০ রান দেওয়াকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলা স্টার্ক সম্পর্কে মেন্টর বলতে পারেন, “আমরা চারটি ম্যাচের মধ্যে তিনটে জিতেছি। সেটাই বড় কথা। ব্যক্তিগত ভাবে কোন ক্রিকেটার কেমন খেলছে সেটা আসল নয়। আসল হচ্ছে দলের জয়। কোনও দিন কোনও ক্রিকেটারের খারাপ যেতেই পারে।” তাঁর সংযোজন, “স্টার্ক দারুণ বোলার। বিপক্ষ ওকে ভয় পায়। ওর বোলিংয়ে আমি সন্তুষ্ট। এটাও দেখতে হবে যে ওকে কঠিন সময়ে বল করতে হয়। আমি নিশ্চিত আগামী দিনে স্টার্কের সেরাটা দেখা যাবে।” সেই সঙ্গে গম্ভীর আরও জানিয়ে দেন, দল জিতছে বলেই কারও উপর আলাদা করে দায় চাপাচ্ছেন না তিনি। কেকেআরের মেন্টর বলেন, “দল জিতছে বলে আমি এ ভাবে উত্তর দিচ্ছি। দল হারলে হয়তো আপনার প্রশ্নের জবাব আমি অন্য ভাবে দিতাম।”

KKR

কেকেআরের থিঙ্কট্যাঙ্ক। (বাঁদিক থেকে) মেন্টর গৌতম গম্ভীর, কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত এবং অধিনায়ক শ্রেয়স আয়ার। —ফাইল চিত্র।

গম্ভীর যে ভুল ছিলেন না, তার প্রমাণ প্রথম কোয়ালিফায়ারে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ম্যাচের সেরা স্টার্ক। ম্যাচের দ্বিতীয় বলে ট্রেভিস হেডকে বোল্ড করেছিলেন তিনি। কেন তাঁকে দলে নিতে প্রায় ২৫ কোটি টাকা দল খরচ করেছিল, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওই একটি বলেই। ফাইনালেও প্রথম ওভারেই উইকেট নেন স্টার্ক। ৩ ওভারে ১৪ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট। বড় ম্যাচের খেলোয়াড় বোধ হয় একেই বলে।

গত বারের আইপিএলে ১৪টা ম্যাচের মধ্যে মাত্র ছ’টিতে জিতেছিল কেকেআর। প্রতি ম্যাচে ওপেনারেরা ব্যর্থ হতেন। কিন্তু তাতেও দলে তেমন কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ত না। কেকেআরের যেন কোনও প্ল্যান বি ছিল না। এ বার সেটাই দেখা গেল। ওয়াংখেড়েতে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে নারাইন এবং সল্ট রান পাননি। ব্যর্থ হয়েছিলেন অঙ্গকৃশ এবং শ্রেয়সও। সঙ্গে সঙ্গে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে নামিয়ে দেওয়া হয় মণীশ পাণ্ডেকে। লিগ পর্বে ওই একটা ম্যাচেই দেখা গিয়েছিল তাঁকে। অভিজ্ঞ ব্যাটার ৩১ বলে ৪২ রান করেন। তাঁর সঙ্গে জুটি গড়েন বেঙ্কটেশ আয়ার। ১৬৯ রান তুলে নেয় কেকেআর। ম্যাচও জিতে নেয়। মণীশ না থাকলে হয়তো ওই ম্যাচ হেরেই যেত কেকেআর। এই ধরনের পরিবর্তনই কেকেআর-কে পাল্টে দিয়েছে এ বারের আইপিএলে। যে কোনও পরিস্থিতি থেকে জয়ের রাস্তা খুলে ফেলার আত্মবিশ্বাস পেয়ে গিয়েছে কেকেআর। আর এই বিশ্বাসটাই এনে দিয়েছেন গম্ভীর।

কেকেআরের অন্যতম মালিক শাহরুখের একটি ছবির সংলাপ ছিল, “অগর উও ঠিক না হো, তো উও দি এন্ড নেহি হ্যায়, পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।” গম্ভীর সেই সব কিছু ঠিক করে দেওয়া মানুষ। যত ক্ষণ না ঠিক হচ্ছে, তত ক্ষণ ছাড়ার পাত্র নন তিনি। তাই আইপিএল শেষ করে তবেই হাসলেন গম্ভীর। ‘হ্যাপি এন্ডিং’ এনে দিলেন শাহরুখের দলকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Gautam Gambhir KKR Kolkata Knight Riders
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy