একের পর এক ম্যাচ হারলেও মুখের হাসি উধাও হয়নি হার্দিকের। ছবি: পিটিআই।
হার্দিক পাণ্ড্য হাসছেন। ক্যাচ পড়লে হাসছেন। বল হাতে মার খেলে হাসছেন। ব্যাট হাতে রান না করতে পারলেও হাসছেন। হার্দিকের এই হাসি দেখে ভয় পাচ্ছেন কেভিন পিটারসেন। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়কের মতো হার্দিকের হাসি দেখে চমকে উঠছেন আরও অনেকে।
রবিবার চেন্নাই সুপার কিংসের কাছে হারের পরেই হার্দিকের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পিটারসেন। তাঁর মনে হচ্ছে, মানসিক ভাবে সমস্যা হচ্ছে মুম্বইয়ের অধিনায়কের। সম্প্রচারকারী চ্যানেলে পিটারসেন বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, মাঠের বাইরের ঘটনা হার্দিকের উপর প্রভাব ফেলছে। টস করার সময় দেখলাম ও খুব হাসছে। আসলে ও দেখাতে চাইছে যে ও খুব খুশি। কিন্তু আসলে ও মোটেই খুশি নয়। আমি ওই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। তাই আমি জানি, হার্দিকের মনের মধ্যে কী চলছে।”
সত্যিই কি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন হার্দিক?
ঘরে ফেরার আনন্দটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্রথম ম্যাচেই। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়ক হিসাবে টস করতে নেমে টিটকিরির মুখে পড়তে হয়েছিল হার্দিককে। টিটকিরি দিয়েছিলেন নিজের দলের সমর্থকেরাই। ছ’ম্যাচ পরেও তা থামেনি। চারটে ম্যাচ হারতে হয়েছে। পাশাপাশি হার্দিকের নিজের ফর্মও প্রভাব ফেলেছে তাঁর উপর। হারতে হারতে হার্দিক এখন মুম্বইয়ের ডাগ আউটে একা। ক্রমে সেই একাকিত্ব আরও বাড়ছে। হার্দিকের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন আগেও ছিল। সেই প্রশ্ন ক্রমশ বাড়ছে। এ বার প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও। মানসিক ভাবেও কি ধাক্কা খাচ্ছেন মুম্বইয়ের অধিনায়ক?
তিন বছর আগেও ছবিটা অন্য রকম ছিল। তখন হার্দিক ছিলেন মুম্বই সমর্থকদের ভরসার পাত্র। অধিনায়ক রোহিত শর্মার বড় অস্ত্র। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, তিন বিভাগেই হার্দিকের অবদান মুম্বইকে ২০১৯ ও ২০২০ সালে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের নিলামের আগে হার্দিককে ছেড়ে দেয় মুম্বই। তাঁকে কেনে গুজরাত টাইটান্স। নতুন দলে গিয়ে হার্দিকের আরও একটি রূপ সবার চোখে পড়ে। অধিনায়ক হার্দিক। প্রথম বারই চ্যাম্পিয়ন। দ্বিতীয় বার চ্যাম্পিয়ন হতে হতে রানার্স। এই দু’বছরে হার্দিক সুপারস্টার হয়ে গিয়েছেন। তাই মুম্বইয়ের নজর আবার তাঁর দিকে পড়ে।
চলতি আইপিএলের নিলামের আগে থেকেই হার্দিকের মুম্বইয়ে যোগ দেওয়ার জল্পনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, গুজরাত তাঁকে রেখে দিয়েছে। যদিও তার পরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানা গেল, হার্দিক গুজরাত ছেড়ে মুম্বইয়ে যোগ দিয়েছেন। কয়েক দিন পরে রোহিতকে সরিয়ে হার্দিককে অধিনায়ক ঘোষণা করে দিল মুম্বই। সেটাই হয়তো ছিল হার্দিকের মুম্বইয়ে ফেরার শর্ত। কিন্তু গোটা বিষয়টিই এত দ্রুত হয় যে কেউ থিতু হওয়ার সময় পাননি। রোহিতকে এ ভাবে সরিয়ে দেওয়া ভাল ভাবে নিতে পারেননি মুম্বইয়ের সমর্থকদের বড় অংশ। যে অধিনায়ক দলকে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন করেছেন, তাঁকে এ ভাবে সরিয়ে দেওয়ার পরিণতি যে খুব একটা সুখকর হবে না, তা হয়তো তখন বুঝতে পারেনি মুম্বই ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি। এখন তারা টের পাচ্ছে। সত্যিই তো, রোহিত তো আর মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো নিজে থেকে সরে যাননি। তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন একটা সময়ে, যখন তিনি জাতীয় দলের তিনটি ফরম্যাটেই অধিনায়ক।
হার্দিকও হয়তো বুঝতে পারেননি, মুম্বইয়ের হয়ে দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটা তাঁর এ রকম হবে। প্রথম ম্যাচ থেকেই গ্যালারিতে পোস্টার পড়ল, ‘‘আমাদের অধিনায়ক রোহিতই”, “রোহিত ভাই, আমরা তোমার পাশে আছি।” সেই সঙ্গে টিটকিরি তো আছেই। গুজরাতের মাঠে কুকুর ঢুকে পড়ায় দর্শকদের একাংশ ‘হার্দিক, হার্দিক’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। দর্শকদের বিদ্রুপের আগুনে ঘি ঢাললেন হার্দিক নিজেই। রোহিতকে বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করতে পাঠালেন। প্রথমে রোহিত নিজেই খানিকটা অবাক হয়ে যান। পরে অধিনায়কের নির্দেশ মেনে নিলেও রোহিতকে দেখে বোঝা যায়, তিনি বিরক্ত। ম্যাচ শেষে লাসিথ মালিঙ্গাকে ঠেলে সরিয়ে দেন হার্দিক। এমনকি, মুম্বই ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে যে রোহিতের সমর্থনে পোস্টার, ব্যানার নিয়ে দর্শকদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে হার্দিক-বিরোধিতা আরও বেড়ে যায়।
মাঝে পর পর দু’টি ম্যাচ মুম্বই জেতায় কিছুটা হলেও হার্দিকের মুখে হাসি ফিরেছিল। কিন্তু রবিবার চেন্নাই সুপার কিংসের কাছে হেরে পরিস্থিতি আবার খারাপ হয়ে গেল। চেন্নাইয়ের কাছে হারের জন্য হার্দিকের দিকেই আঙুল উঠেছে। বল হাতে ৩ ওভারে ৪৩ রান দিয়েছেন। ২ উইকেট নিলেও শেষ ওভারে ধোনির হাতে তাঁর তিনটি ছক্কা খাওয়াকেই হারের কারণ মনে করছেন অনেকে। ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ৬ বল খেলে মাত্র ২ রান করেছেন হার্দিক। রোহিত যেখানে শতরান করে অপরাজিত থেকেছেন সেখানে দলকে হারতে হয়েছে। হার্দিক নিজেকে ফিনিশারের ভূমিকায় তুলে এনেছিলেন। কিন্তু ইদানীং যেন ব্যাটে-বলে হচ্ছে না তাঁর। চাপের ফলেই কি ভুল করছেন হার্দিক?
হার্দিক ১০০ শতাংশ ফিট নন বলেই মনে করছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। আইপিএলে ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় থাকা গিলক্রিস্ট বলেন, “শেষ ওভারে ধোনির বিরুদ্ধে হার্দিকের বল করা দেখে মনে হল ও ১০০ শতাংশ ফিট নয়। তার পরেও কেন বল করতে গেল বুঝতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, অধিনায়ক হিসাবে নিজেই দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছে হার্দিক। সব করতে চাইছে। কিন্তু হচ্ছে না।”
অধিনায়ক হার্দিককে তুলোধনা করেছেন সুনীল গাওস্কর। ওয়াংখেড়েতে চেন্নাইয়ের ইনিংসের পরে সম্প্রচারকারী চ্যানেলে বসে তিনি বলেন, “ভয়াবহ বোলিং। ভয়াবহ নেতৃত্ব। হাতে একাধিক বোলার থাকতেও নিজে বল করতে এল। ধোনি অপেক্ষা করছিল ওর পায়ের কাছে বল আসার। সেটাই করল হার্দিক। ছক্কা মারতে দিল। খুব সাধারণ মানের বোলিং এটা। ততটাই সাধারণ নেতৃত্ব।” গাওস্কর যে কতটা বিরক্ত সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তিনি বলতেই থাকেন, “শ্রেয়স গোপাল মাত্র এক ওভার বল করল। কেন? ও তো বোলার। তাকে দিয়ে আমি মাত্র এক ওভার করাব? এটা নেতৃত্ব! আগের ম্যাচে যে (যশপ্রীত) বুমরা এত ভাল বল করল, তাকে নতুন বলটাই দিল না। এটাকে নেতৃত্ব বলে না।”
গাওস্করের সঙ্গেই ছিলেন পিটারসেন। তিনিও হার্দিকের সিদ্ধান্তে বিরক্ত। বলেন, “এটা মুম্বইয়ের ঘরের মাঠ। সেখানে ওকে টিটকিরি দেওয়া হচ্ছে। এখানে গোটা মাঠ চেন্নাইয়ের জন্য চিৎকার করছে। এটা মেনে নেওয়া কঠিন। ও তো মানুষ। ওর আবেগ আছে। আমি জানি এমন পরিস্থিতিতে কেমন লাগে। গাওস্করও জানেন। মায়ান্তিও (সঞ্চালিকা) জানে। এটা মেনে নেওয়া কঠিন। সেটার প্রভাব পড়ছে হার্দিকের উপর।”
সত্যিই কি তাই? দলে কি ক্রমেই একা হয়ে পড়ছেন হার্দিক? গত যে কয়েকটি ম্যাচে মুম্বই হেরেছে, ম্যাচ শেষে দেখা গিয়েছে হার্দিক একা ডাগ আউটে বসে রয়েছেন। থমথমে মুখে। তাঁর আশপাশে কেউ নেই। হার্দিকের কথাতেও একাকিত্ব ফুটে উঠছে। চেন্নাইয়ের কাছে হারের পরে তিনি বলেন, “ওদের উইকেটের পিছনে এমন এক জন দাঁড়িয়ে আছে যে পরিস্থিতি খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে। কোন উইকেটে কী ভাবে বল করতে হবে সেই নির্দেশ দিতে পারে।” হার্দিক কি বোঝাতে চেয়েছেন যে রুতুরাজ গায়কোয়াড়ের এক জন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি রয়েছেন, কিন্তু তাঁর পাশে কেউ নেই?
এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য কি হার্দিকই দায়ী নন? মুম্বইয়ের প্রথম ম্যাচে দেখা গিয়েছিল কিছু দৃশ্য। বল করার সময় রোহিত মাঝেমাঝেই হার্দিককে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু হার্দিক তাতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বুমরার সঙ্গে রোহিতের আলোচনার মাঝে হার্দিক সেখান থেকে চলে যান। তাঁর শরীরী ভাষা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছিল, অধিনায়ক তিনি। সুতরাং তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। যে কাজটা তিনি গুজরাত টাইটান্সে করতেন সেটাই মুম্বইয়ে করার চেষ্টা করছেন। রোহিতও ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। ধোনি যখন হার্দিককে পর পর ছক্কা মারছেন তখন দেখা যায়, চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রোহিত। হার্দিককে গিয়ে কোনও পরামর্শ দেননি তিনি।
এই বিষয়ে আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল দুই মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনন্যা সিন্হার সঙ্গে। অনুত্তমা বললেন, “উনি ঠিক কী কারণে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন তার উত্তর একমাত্র উনিই দিতে পারবেন। আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। ধারাভাষ্যকারেরাও অনুমান করেই বলছেন। এটুকু বলা যেতে পারে, মনস্তত্ত্বে আমরা অনেক সময় দেখে থাকি যে প্রদর্শনের বাড়তি মানে আসলে অন্তর্নিহিত ঘাটতি। সুতরাং যখনই আমরা কোনও কিছুর বাড়াবাড়ি রকমের প্রদর্শন দেখি এই সংশয় অনেক সময় জাগে, সেটা কি কিছু আড়াল করার জন্যেই? আমার মনে হয়ে ধারাভাষ্যকারদের মধ্যেও এই প্রশ্ন জাগছে।” আরও একটি অনুমানের কথা বলেছেন অনুত্তমা। তিনি বলেন, “ওঁর এই ধরনের প্রতিক্রিয়ার আরও একটা কারণ হতে পারে। এটা তো সত্যিই খুব চাপের খেলা। অনেক মানুষ খেলা দেখছেন। ওঁকে একটি বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই উনি যদি মাঠে খুব মুষড়ে পড়তে থাকেন তা হলে ওই বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া ওঁর মনকে আরও বেশি দ্রবীভূত করে ফেলতে পারে। তাই হয়তো উনি একটা বাড়তি প্রয়াস করছেন। বোঝাতে চাইছেন, যত ক্ষণ আমি মাঠে আছি এই সাময়িক ব্যর্থতাগুলোতে আমি আমার মনকে গ্রাস করতে দেব না। কারণ, এই ক্যাচটা মিস্ করা মানে পরের ক্যাচের দিকে তাকাব না তা নয়। এই ক্যাচ ফেলার ব্যর্থতাই আমি যদি আচ্ছন্ন হয়ে যাই তা হলে হয়তো পরের ক্যাচটাও মিস করব। এটা একটা ডিফেন্স মেকানিজ়মও হতে পারে।”
অনন্যা একটু অন্য ভাবে বিষয়টি ভাবছেন। তিনি বললেন, “ভিতরের দুঃখ চাপার জন্য অতিরিক্ত হাসি কি না তা বলা মুশকিল। কিন্তু অতিরিক্ত চাপ থাকলে অনেকেই তা সামলাতে বেশি হাসে। কারণ, হাসলে শরীর ও মনের উপর থেকে চাপ কমে। শরীর ও মন তরতাজা থাকে। যে হরমোনগুলি শরীর ও মনের উপর চাপ ফেলে সেই হরমোনের নিঃসরণ হাসলে অনেকটা কমে যায়। তাই হয়তো উনি বেশি হাসছেন।” তিনি আরও বলেন, “দলকে মানসিক ভাবে চাঙ্গা রাখতেও উনি এই কাজ করে থাকতে পারেন। দলে একটা ইতিবাচক মনোভাব বজায় থাকে। অধিনায়কের হাসি দলে একটা বাড়তি তাগিদ নিয়ে আসতে পারে।”
তবে প্রথম ছ’টি ম্যাচের পরে এ কথা স্পষ্ট, হার্দিক হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে আইপিএলের অন্যতম সফল দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। এমন এক জন অধিনায়কের জুতোয় পা গলিয়েছেন, যিনি শুধু আইপিএলের অন্যতম সফল অধিনায়ক নন, দেশেরও অধিনায়ক। রোহিতের সমর্থন, জনপ্রিয়তা নিজের দিকে টেনে আনতে হার্দিককে যা যা করতে হত তার ঠিক উল্টোটা করেছেন তিনি। তার পরেও যদি দল জিতত, তা হলে হয়তো সমর্থকদেরও পাশে পেতেন হার্দিক। ছয় ম্যাচে চার হার পরিস্থিতি আরও কঠিন করে দিয়েছে। প্রতিটি হারের সঙ্গে যেন আরও খানিকটা একা হয়ে যাচ্ছেন হার্দিক। দেখে মনে হচ্ছে প্রতিপক্ষ নয়, নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন তিনি। যত দিন যাচ্ছে, মুম্বইয়ের ডাগ আউটে তাঁর পাশে অন্ধকারটা যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেও পারছেন না তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy