কে বলল, প্যাট কামিন্স ব্যাট করতে পারেন না! আসলে ম্যালকম মার্শালের মতো বল করেন, আন্দ্রে রাসেলের মতো ছক্কা মারতে পারেন। আর টম ক্রুজ়ের মতো দেখতে। কে বলল, প্যাট কামিন্স ব্যাট করতে পারেন না! হার-না-মানা যোদ্ধাদের কাছে আবার অসম্ভব বলে কিছু থাকে নাকি!
ফাইল চিত্র।
প্যাট কামিন্স ব্যাট করতে পারেন না।
কৈশোর থেকেই বল হাতে আগুন ঝরাচ্ছেন। ১৩ বছর বয়সে এক প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে এতবার আঘাত করেছিলেন যে, তাঁর মা পর্যন্ত আবেদন করেন, ‘‘আর মেরো না আমার ছেলেকে। দয়া করে ওকে বাউন্সার দেওয়া বন্ধ করো।’’ ১৪ বছর বয়সে তাঁর একটি বল স্টাম্পে লেগে সোজা উইকেটকিপারের মাথার উপর দিয়ে বাউন্ডারিতে উড়ে যায়! তাহলে আইপিএলে গত বুধবার পুণের মাঠে ১৫ বলে ৫৬ রানের ঝড় কার ব্যাটে উঠেছিল? আদৌ কি ঘটেছিল নাকি ছিল শুধুই মনের বিভ্রম? নাকি কোনও ক্রিকেট দেবতা তুষ্ট হয়ে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন এক রাতের জন্য! যার স্পর্শে কামিন্স হয়ে উঠেছিলেন আন্দ্রে রাসেল!
গ্রেগ চ্যাপেলের মন্তব্য রিওয়াইন্ড করা যাক। প্রতিভাবান কিশোরকে দেখে যিনি অস্ট্রেলিয়ার বোলিং কোচ ট্রয় কুলিকে বলে দিয়েছিলেন, ‘‘ছেলেটার বোলিংয়ের দিকে তো নিশ্চয়ই তোমরা নজর দেবে। ও কিন্তু ব্যাটিংটাও বেশ ভাল করে। দেখো সেটা যেন অবহেলিত না হয়।’’
প্যাট কামিন্স ব্যাট করতে
জানেন না।
শুধুই বল হাতে হাসতে হাসতে ব্যাটসম্যানকে ধরাশায়ী করেন। তা-ও কী, মাত্র তিন বছর বয়সে মধ্যমার অর্ধেকটা উড়ে যাওয়া নিয়ে। তাঁর দিদি সপাটে দরজা বন্ধ করে দেন, খেয়াল করেননি ভাইয়ের আঙুল চিপে গিয়েছে। যে মধ্যমা বল ধরে রাখার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নেয়, কামিন্সের সেটা কড়ে আঙুলের মাপের।
চলুন, ২০১১-র জোহানেসবার্গে যাওয়া যাক। যে দিন আঠেরোর স্পর্ধা নিয়ে অভিষেক টেস্টে ক্রিজ়ে গিয়ে দাঁড়ালেন কোনও কামিন্স। জেতার জন্য দরকার ১৮ রান! হাতে মাত্র দুই উইকেট। তার আগেই প্রথম টেস্টে কেপ টাউনে ৪৭ অলআউটের লজ্জা তাড়া করেছে অস্ট্রেলিয়াকে। জো’বার্গে অপমান ফিরিয়ে দেওয়ার টেস্ট। তত ক্ষণে দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ইনিংসে ছয় উইকেট নিয়ে সফল আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েই ফেলেছেন কামিন্স। কিন্তু এ বার পরীক্ষা ব্যাট হাতে। ক্রিজ়ে সঙ্গী আর এক বোলার মিচেল জনসন। ভয়ঙ্কর জো’বার্গ পিচে আগুন ঝরাচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলিং ত্রিমূর্তি— ডেল স্টেন, ভার্নন ফিল্যান্ডার, মর্নি মর্কেল। বোলার ব্যাট করতে এসেছে বলে এতটুকু দয়ামায়া দেখানোর ব্যাপার নেই। স্টেন-ফিল্যান্ডার গোলার মতো একের পর এক শর্ট বল নিক্ষেপ করে যাচ্ছেন। একের বিরুদ্ধে এগারো— ক্রিকেটের সেই আদি অনন্তকালের নির্মম বিধান। ক্রিজ়ে দাঁড়াবে এক জন ব্যাটসম্যান আর তাঁকে আক্রমণ করবে এগারো জন মিলে। তবু বলা হবে ক্রিকেট ব্যাটসম্যানের খেলা!
কামিন্স আবির্ভাব মঞ্চেই বুঝিয়ে দিলেন, আর যা-ই হোক তিনি ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসার বান্দা নন। বল হাতে যেমন ব্যাটসম্যানের পরীক্ষা নেন, তেমনই ব্যাট হাতে বাইশ গজে দাঁড়িয়ে পুরুষকারের প্রমাণ দিতেও প্রস্তুত। পাল্টা আক্রমণে রান এগোতে থাকলেন। কোনওটা ব্যাটের কাণায় লেগে বাউন্ডারিতে গেল, কোনওটা প্যাডে ঘষা খেয়ে লেগবাই। তার পর একটা শর্ট বল বেপরোয়া ভঙ্গিতে মিডউইকেট দিয়ে চার মেরে জিতিয়ে দিলেন অস্ট্রেলিয়াকে।
অভিষেকেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ, অস্ট্রেলিয়ার সব সংবাদপত্রে পরের দিন শিরোনামে তিনি। ডনের দেশ পেয়ে গিয়েছে তার পরবর্তী ‘পোস্টার বয়’-কে। গ্রিক যোদ্ধাদের মতো সুদর্শন, সুঠাম। গতির তুফান তুলে যেন ঘোড়া ছুটিয়ে টগবগিয়ে এগিয়ে চলেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। ইনি নায়ক হবেন না তো কে হবেন?
পুণের মাঠে একের পর এক ছয় মারা কামিন্সের জীবনে ‘ছয়’ আসলে এক অভিশপ্ত সংখ্যা। কে ভেবেছিল, অমন স্বপ্নের টেস্ট অভিষেকের পরের ছয় বছরে চোট-আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে সেই কামিন্সেরই আর দেশের হয়ে খেলা হবে না! কখনও গোড়ালির চোট, কখনও পাঁজরে টান। দু’এক বার ফেরার চেষ্টা করলেন, কয়েক ওভার বোলিং, তার পরেই আবার চোট পেয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখচোখ নিয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া।
পশ্চিম সিডনির ব্লু মাউন্টেন্সের বাসিন্দা হয়তো ক্রিকেট পৃথিবী থেকেই হারিয়ে যেতেন। পড়াশুনোতেও বেশ ভাল ছিলেন, ব্যাচেলর অব বিজ়নেস ডিগ্রি নিয়ে মার্কেটিংয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার চেষ্টা চলতে থাকল পাশাপাশি। যদি ক্রিকেট শেষ পর্যন্ত মুখ ঘুরিয়েই নেয়, অন্য কোনও চাকরি তো জোটাতে হবে।
এখনও কামিন্সের ট্র্যাভেল ব্যাগে থাকবেই বেস্টসেলার। হ্যারিপটার গিলেছেন শৈশব থেকে। খুব প্রিয় বই অ্যান্থনি ডি মেলোর ‘অ্যাওয়ারনেস’, নাসিম নিকোলাস তালেবের ‘স্কিন ইন দ্য গেম’। কামিন্সদের প্রজন্মের অস্ট্রেলীয় ড্রেসিংরুম মানে শুধু ‘আগলি অসিজ়’-দের আনাগোনা নয়। সেখানে কামিন্স, উসমান খোয়াজ়ার মতো পড়ুয়া ক্রিকেটারদের পাওয়া যাবে, যাঁরা হয়তো ম্যাচের শেষে এককোণে বসে বিজ্ঞান নিয়ে
আলোচনায় ডুবে থাকবে।
সেই কারণেই বল-বিকৃতি কেলেঙ্কারি-উত্তর জমানায় ভাবমূর্তি উদ্ধারে নামা অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড তাঁকেই বেছে নিয়েছে টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে। অ্যালান ডেভিডসনের পরে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বোলার-অধিনায়ক। ভয়ঙ্কর হয়েও তিনি সুন্দর। কখনও রাগেন না। উত্তেজনা, আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দেখা যায় না। ম্যাচ রেফারির কক্ষে ডাক পড়ে না। স্লেজিং করেন না। যেন ফাস্ট বোলারদের ‘ক্যাপ্টেন কুল’। শিশুসুলভ হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক বিধ্বংসী ফাস্ট বোলার।
সংগ্রামের সেই ছয় বছর ছিল বিভীষিকার মতো। এ রকমই এক হতাশার রাতে সত্যিই ভেসে যাচ্ছিলেন কামিন্স। সিডনির নাইট লাইফ এলাকা কিংস ক্রসে পাড়ি দিলেন। এমন এক প্রতিভা পথভ্রষ্ট হোক, চায়নি বোধ হয় অদৃষ্টও। নৈশজীবনের হাতছানিতে ডুবে যাওয়ার বদলে কামিন্সের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল রেবেকা বস্টনের। নাইট ক্লাবে বসে অল্প কিছু কথাবার্তা, তার পর ম্যাকডোনাল্ডসে সাক্ষাৎ, পরের সপ্তাহে বারবিকিউয়ে দেখা। জীবনের রাস্তায় হারিয়ে যাওয়ার বদলে সেই রাত উপহার দিয়ে গেল জীবনসঙ্গিনীকে।
রেবেকার আবির্ভাব বাইরের প্রলোভন থেকে সরিয়ে কামিন্সকে মনঃসংযোগ করালো ক্রিকেটে। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং কোচ ট্রয় কুলি, ফিজ়িয়ো-ট্রেনারের দল সব সময় লেগে থাকত তাঁর সঙ্গে। কখনও চোট সারিয়ে ফিরছেন তো পরের দিনই আবার ধাক্কা। আবার ঢুকে পড়ো রিহ্যাবিলিটেশনে। কলেজের অন্য পড়ুয়ারা যখন ক্লাস শেষ করে আড্ডা দিতে বেরচ্ছে, কামিন্স ক্রিকেট-কয়েদির মতো এক কোণে দাঁড়িয়ে। তাঁর কফি শপে যাওয়ার পাসপোর্ট নেই। ফিজ়িয়ো আসবেন নিতে, শুরু হবে তাঁর নির্মম রিহ্যাব সেশন। মহম্মদ আলির সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘‘ট্রেনিংয়ের প্রত্যেকটা মিনিটকে আমি ঘৃণা করতাম। কিন্তু নিজেকে একটাই কথা বলতাম। ছেড়ে দিয়ে চলে যেয়ো না। এখন যন্ত্রণাটা সহ্য করো, বাকি জীবনটা কাটাও চ্যাম্পিয়নের মতো!’’
প্যাট কামিন্স ব্যাট করতে জানেন না।
পারিবারিক অ্যালবামে খুব ছোটবেলায় অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ‘ব্যাকইয়ার্ড ক্রিকেট’-এর যে ছবি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ব্যাট হাতে।
প্রায় হারিয়ে যাওয়ার মুখে কামিন্সের জীবনে ‘ঈশ্বর’ হিসেবে উদয় হন এক কিংবদন্তি। তিনি— ডেনিস লিলি, নিজেও চোটের ধাক্কা সামলে কেরিয়ারকে নতুন করে গড়েছিলেন। লিলির সঙ্গে সাক্ষাৎই পাল্টে দিয়ে যায় কামিন্সের জীবন। লিলির কাছেই শেখেন, ফাস্ট বোলারের শরীরটাই মন্দির। শেখেন, কী ভাবে চোট-আঘাতের অভিশাপ থেকে মুক্ত থেকে এক জন ফাল্ট বোলারকে দৌড়ে যেতে হয়। সুইং কমিয়ে লাইন-লেংথের উপর বেশি মনোনিবেশ করেন, রান-আপ পাল্টাতে হয়, অ্যাকশনেও ঘটাতে হয় রদবদল। কিন্তু লিলির পরামর্শে কামিন্স পেয়ে যান পেস বোলার হিসেবে টিঁকে থাকার পরিকল্পনা।
কিন্তু সে তো গেল বোলিংয়ের পাঠ। ব্যাটসম্যান কামিন্স কোথা থেকে উদয় হলেন? প্যাট কামিন্স যে ব্যাট করতে পারেন না!
পুণের মাঠে ড্যানিয়েল স্যামস দিলেন এক ওভারে ৩৫ রান। আর দু’বছর আগে যশপ্রীত বুমরা মরুশহরে চারটি ছক্কা-সহ দিয়েছিলেন ২৭। ব্যাটসম্যান? সেই অস্ট্রেলীয় তরুণ, কিশোর বয়স থেকে যে বল হাতে আগুন ঝরাচ্ছে, যার কাছে এসেছিল ছেলেকে নিয়ে এক মায়ের করুণ আবেদন।
কে বলল, প্যাট কামিন্স ব্যাট করতে পারেন না! আসলে ম্যালকম মার্শালের মতো বল করেন, আন্দ্রে রাসেলের মতো ছক্কা মারতে পারেন। আর টম ক্রুজ়ের মতো দেখতে। কে বলল, প্যাট কামিন্স ব্যাট করতে পারেন না! হার-না-মানা যোদ্ধাদের কাছে আবার অসম্ভব বলে কিছু থাকে নাকি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy