তৃতীয় দিনের খেলা চলার সময় সিরিজের অফিশিয়াল ব্রডকাস্টার পরিসংখ্যানের গ্রাফিক্সটা দেখাল।
ভারতের লোয়ার-মিডল এবং লোয়ার অর্ডারের চলতি সিরিজে ব্যাট হাতে অবদান। বলা হচ্ছিল, এই যে ভারত পরের পর টেস্ট ম্যাচ সাম্প্রতিকে জিতে চলেছে তার প্রধান কারণ কোহালির টিমের লোয়ার-মিডল এবং লোয়ার অর্ডার। ব্যাটিংয়ে তারা এতটাই রান করছে যে, বাকি টিমের সঙ্গে পার্থক্যটা ওখানেই হয়ে যাচ্ছে। আর এ ব্যাপারে বাকি টিম কোহালিদের ধারেকাছে নেই। ভারতই সেরা।
ঠিকই। চলতি সিরিজে ভারত এবং ইংল্যান্ড দু’টো টিমের লোয়ার মিডল এবং লোয়ার অর্ডারকে ধরা যাক। ভারতের রবিচন্দ্রন অশ্বিনের তিন টেস্টে রান ২৩৯। তিনটে হাফসেঞ্চুরি সহ। গড় প্রায় ৪৮। জয়ন্ত যাদবের ২ ম্যাচে রান ১১৭। হাফসেঞ্চুরি এক। গড় আরও বেশি, ৫৫! রবীন্দ্র জাডেজা এত দিন সে ভাবে পারেননি। কিন্তু সোমবার ৯০ করে গেলেন। ৩৭ গড় রেখে তিন ম্যাচে রান ১৪৮। উমেশ যাদব এবং মহম্মদ শামি— ভারতের দশ এবং এগারো, তাঁরাও কিন্তু নেমেই আউট হয়ে যাচ্ছেন না। গোটা দশ-বারো করে রান করে দিয়ে যাচ্ছেন। উল্টো দিকে ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস ছাড়া যুদ্ধ চালানোর মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। ছ’নম্বরে নেমে স্টোকসের তিন ম্যাচে স্টোকসের রান ২৬৭। সেঞ্চুরি এক, হাফসেঞ্চুরিও এক। গড়ও পঞ্চাশের উপরে। কিন্তু বাকিরা? আদিল রশিদ তিন ম্যাচ মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত গোটা পঁয়তাল্লিশ রান করেছেন। কিন্তু স্টুয়ার্ট ব্রড, ক্রিস ওকস বা অ্যান্ডারসন কেউ তিরিশের নীচে, কেউ বা কুড়িরও কম।
মোহালি টেস্টকে আরও জলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অ্যালিস্টার কুকের যে আজ নির্ঘুম রাত কাটবে, তাঁর কারণ বোলার অশ্বিন নয়। সেই অশ্বিন নন, যিনি আজ তিন উইকেট তুলে চার দিনেই ম্যাচ শেষ করে দেওয়ার সমূহ ইঙ্গিত ছেড়ে রাখলেন। কুকের নির্ঘুম রাতের কারণ বরং অন্য অশ্বিন ও তাঁর দলবল। ব্যাটসম্যান অশ্বিন ও তাঁর লোয়ার অর্ডার টিম। যাঁরা প্রায় খাদের ধার থেকে টিমকে টেনে তুলে ভারতের দিকে মোহালি টেস্ট ঘুরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। স্কোরগুলো দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
রবিচন্দ্রন অশ্বিন— ৭২। রবীন্দ্র জাডেজা— ৯০। জয়ন্ত যাদব— ৫৫। উমেশ যাদব— ১২।
ভাবা যায়, ১৮০ রানে পাঁচ-পাঁচটা উইকেট বেরিয়ে যাওয়া একটা টিমের শেষ পাঁচ উইকেটে উঠল ২৩৭ রান! ইংল্যান্ড অধিনায়ককে এ দিন একটা সময় চরম হতবাক দেখাচ্ছিল। স্বাভাবিক। কে আর ভেবেছিল যে, কোহালি আউট হওয়ার পরেও ভারত শেষ হবে না? অশ্বিন নিয়মিত রান করছেন। তাঁরটা বাদ দেওয়া গেল। জা়ডে়জা— তিনিও ঠিক আছে। কিন্তু জয়ন্ত যাদবও যে হাফসেঞ্চুরি করে বেরিয়ে যেতে পারেন, স্ট্র্যাটেজি করার সময় নির্ঘাৎ কুক ভাবতে পারেননি।
ছোটবেলায় মা-কে হারিয়েছিলেন জয়ন্ত। জীবনের গোড়াতেই ঝটকা খাওয়ার পর স্বপ্ন দেখতেন, একদিন দেশের হয়ে খেলবেন। টেস্ট ক্রিকেট খেলবেন। কিট হাতে ক্রিকেট-ক্লাসে যাওয়ার সময় খুদেরা যে স্বপ্ন দেখে সাধারণত। কিন্তু জয়ন্ত বোধহয় ভাবতে পারেননি যে, তাঁর সেই অতীব সাধারণ চাহিদার পূর্ণতার পথটা এত রাজকীয় হবে। বিশাখাপত্তনমে নিজ-প্রতিভার সাক্ষর ছেড়ে গিয়েছিলেন জয়ন্ত। দেখিয়েছিলেন, জীবনের প্রথম ভাগেই চাপ শব্দটা জুড়ে যাওয়ায়, সেই শব্দের বোঝা ক্রিকেট মাঠে টানা তাঁর কাছে কঠিন ব্যাপার নয়। দশ-এগারো নম্বরকে সঙ্গী বানিয়ে রান করে গিয়েছিলেন দু’ইনিংসে। তুলেছিলেন উইকেটও। মুগ্ধ হয়েছিল টিম ইন্ডিয়া। প্রশংসা করেছিল তাঁর ওয়ার্ক এথিক্সের। সোমবারের মোহালি তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ আরও একবার দেখল। ১৪১ বল খেলে এ দিন ৫৫ রান করলেন জয়ন্ত। অশ্বিন-জাডেজা আউট হওয়ার পরেও ইংল্যান্ডকে এক মুহূর্তের স্বস্তিতে থাকতে দিলেন না। ব্যাটসম্যান জাডেজার প্রত্যাবর্তন কাহিনিও বা কম কী? ভারতীয় টিমের ‘জাড্ডু’ম যে রানটা পেয়ে কত স্বস্তি পেলেন, তা তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে সমালোচকদের উদ্দেশ্যে শ্লেষাত্মক, ‘‘আমি কিন্তু ব্যাটসম্যান, ঘরোয়া ক্রিকেটে আমার রানটান দেখুন’’ বলা থেকেই পরিষ্কার। আসলে হালফিলে ব্যাট হাতে টিমের প্রতি ‘স্যর জা়ডেজা’র অবদান নিয়ে কথা হয়েছে প্রচুর, লেখালেখিও হয়েছে পর্যাপ্ত। চার বছর আগে ধোনির টিম ইন্ডিয়ায় ঢুকেছিলেন যখন, পরিচয়টা ছিল অলরাউন্ডার। কিন্তু পরে সেটা অনেক বেশি ঝুঁকে গিয়েছিল বোলার-সত্ত্বার দিকে। মোহালিতে সেটা পাল্টে দিলেন জাডেজা। অশ্বিন যতক্ষণ ছিলেন, রণমূর্তি ধরেননি। কিন্তু অশ্বিন ফিরে যাওয়ার পর সংহারমূর্তি ধরে নেন। ক্রিস ওকসকে একটা ওভারে তো চারটে বাউন্ডারি মারলেন নাগাড়ে। আর একটু সংযত হলে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটাও চলে আসত এ দিন।
কিন্তু সেঞ্চুরি না এলেও লক্ষ্যের কাছাকাছি টিমকে পৌঁছে দিতে পেরেছেন জাডেজা। টেস্ট জয়ের কাছাকাছি। ভারতকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামাতে হলে আরও ৫৭ রান লাগবে ইংল্যান্ডের। অথচ এখনই চারটে বেরিয়ে গিয়েছে। কুক নেই। স্টোকস আউট। বেয়ারস্টো নেই। মইনও আউট। পড়ে শুধু রুট। অবিশ্বাস্য মহানাটকীয়তা তিনি আমদানি করলে আলাদা কথা। কিন্তু বর্তমানের বিচারে ভারতের জয় এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
মোহালি টেস্ট পাঁচ দিনে গেলেই আশ্চর্যের হবে।
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ২৮৩।
ভারত প্রথম ইনিংস (আগের দিন ২৭১-৬): অশ্বিন ক বাটলার বো স্টোকস ৭২, জাডেজা ক ওকস বো রশিদ ৯০, জয়ন্ত ক মইন বো স্টোকস ৫৫, উমেশ ক বেয়ারস্টো বো স্টোকস ১২, শামি ন.আ. ১, অতিরিক্ত ১৬, মোট ৪১৭। পতন: ৩৯, ৭৩, ১৪৮, ১৫২, ১৫৬, ২০৪, ৩০১, ৩৮১, ৪১৪। বোলিং: অ্যান্ডারসন ২১-৪-৪৮-০, ওকস ২৪-৭-৮৬-০, মইন ১৩-১-৩৩-০, রশিদ ৩৮-৬-১১৮-৪, স্টোকস ২৬.২-৫-৭৩-৫, ব্যাটি ১৬-০-৪৭-০।
ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস: কুক বো অশ্বিন ১২, রুট ন.আ. ৩৬, মইন ক জয়ন্ত বো অশ্বিন ৫, বেয়ারস্টো ক পার্থিব বো জয়ন্ত ১৫, স্টোকস এলবিডব্লিউ অশ্বিন ৫, ব্যাটি ন.আ. ০, অতিরিক্ত ৫, মোট ৭৮-৪। পতন: ২৭, ৩৯, ৭০, ৭৮। বোলিং: শামি ৭-২-১৭-০, উমেশ ১-০-৭-০, অশ্বিন ১২-৩-১৯-৩, জাডেজা ১২-৪-১৮-০, জয়ন্ত ৬-১-১২-১।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy