চেন্নাইয়ে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে ভারতের হার নিয়ে নানা তত্ত্ব বেরিয়ে পড়েছে। জো রুটের দারুণ ব্যাটিং নিশ্চয়ই বড় কারণ। ভারতীয় বোলাররা প্রথম ইনিংসে তেমন চাপ তৈরি করতে পারেনি, সেটাও রয়েছে। জিমি অ্যান্ডারসনের রিভার্স সুইংয়ের জবাব ছিল না অজিঙ্ক রাহানের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের কাছে।
কিন্তু আমার কাছে এই বিপর্যয়ের প্রধান কারণ অন্য। অনেক দিন হল ভারতীয় ব্যাটিংয়ের যারা প্রধান স্তম্ভ, তাদের ব্যাট থেকে বড় ইনিংস দেখা যাচ্ছে না। চোখের সামনেই তো পরিসংখ্যান রয়েছে। কোনও আইনস্টাইন হওয়ারও দরকার নেই, ফেলুদাকেও ডাকতে হবে না।
বর্তমান ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ‘বিগ ফোর’ হচ্ছে বিরাট কোহালি, চেতেশ্বর পুজারা, রোহিত শর্মা, অজিঙ্ক রাহানে। যেমন এর আগের প্রজন্মে ছিল ‘বিগ ফাইভ। সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ভি ভি এস লক্ষ্মণ, বীরেন্দ্র সহবাগ। দেখা যাবে, ওই সময়ে যত টেস্ট ভারত জিতেছে, বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে, সব ক’টাতেই পঞ্চপাণ্ডব দারুণ স্কোর তুলে দিয়েছেন বোর্ডে। ইডেনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক জয়ের টেস্টে সারা দিন ধরে ব্যাট করে খেলা ঘুরিয়েছিলেন লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়। অ্যাডিলেডে টেস্ট জয়ে রাহুলের ডাবল সেঞ্চুরি, হেডিংলের ঐতিহাসিক ইনিংস জয়ের টেস্টে সচিন, দ্রাবিড়, সৌরভ, লক্ষ্মণ চার জনেরই সেঞ্চুরি ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় সিডনিতে সচিনের ডাবল সেঞ্চুরি, লক্ষ্মণের বড় স্কোর। সহবাগের বোলারকে শাসন করা সব ট্রিপল সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি। মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচে ১৯৫ রানের দুরন্ত ইনিংস কে ভুলবে!
সেই তুলনায় গত এক বছরের উপর এখনকার এই তারকাখচিত ব্যাটিং বিভাগ কিন্তু বড় স্কোর করতে পারছে না। বড় স্কোর বলতে আমি সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি বোঝাতে চাইছি। যেমন জো রুট চেন্নাইয়ে প্রথম টেস্টে এসে ডাবল সেঞ্চুরি করে দিল। শ্রীলঙ্কাতেও প্রচুর রান করে এসেছে। কিন্তু ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে নিউজ়িল্যান্ডে প্রথম টেস্ট থেকে ধরলে চেন্নাই টেস্ট পর্যন্ত কোহালি, পুজারাদের থেকে মিলিত ভাবে মাত্র একটি সেঞ্চুরি এসেছে। অতিমারির জন্য দীর্ঘ দিন ক্রিকেট বন্ধ থাকলেও এই সময়ে অন্তত ছ’সাতটি করে টেস্ট হয়েছে, যার মানে ১২ থেকে ১৪টি ইনিংস পাওয়া গিয়েছে। একমাত্র বিরাট অস্ট্রেলিয়ায় তিনটি টেস্টে ছিল না পিতৃত্বের ছুটি নিয়েছিল বলে। রোহিত নিউজ়িল্যান্ডে ছিল না চোট থাকার জন্য, অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম দু’টি টেস্টেও খেলতে পারেনি।
এই একমাত্র সেঞ্চুরি এসেছে রাহানের ব্যাট থেকে মেলবোর্নে। ৩৬ অলআউটের পরে সেই সেঞ্চুরি ভারতকে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবল চাপের মধ্যে সিরিজে ফিরতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু ওই সেঞ্চুরিটা বাদ দিলে রাহানের ব্যাটও নিষ্প্রভ। ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে ওয়েলিংটনে নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট থেকে ধরলে পুজারা ৭ ম্যাচে ১৪টি ইনিংস পেয়েছে। রাহানেও তাই (পাশের ছবির সঙ্গে পরিসংখ্যান রয়েছে)। পুজারা পাঁচটি হাফ সেঞ্চুরি পেলেও কোনও সেঞ্চুরি নেই। রাহানের একটি সেঞ্চুরি রয়েছে কিন্তু বাকি ১৩ ইনিংসে একটি হাফ সেঞ্চুরিও নেই। সকলের গড় তিরিশের আশেপাশে বা তারও কম। যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
গত কয়েক বছরে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে উঠেছে বিরাট কোহালি। দুরন্ত সব শৃঙ্গ জয় করেছে। হয়তো আরও অনেক নজির গড়বে। কিন্তু ইডেনে দিনরাতের টেস্টে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির পরে ওর ব্যাটেও তিন অঙ্কের রান দেখা যায়নি। নিউজ়িল্যান্ড থেকে ধরলে আট ইনিংসে বিরাটের ব্যাট থেকে এসেছে দু’টি হাফ সেঞ্চুরি। কোনও সেঞ্চুরি নেই। রোহিত শর্মাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না কেন, তা নিয়ে এত হইচই হল। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে নিজের জায়গা পাকা করার ব্যাপারে ও নিজে কী করছে, সেই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। গত ছয় ইনিংসে রোহিত মাত্র একটি হাফসেঞ্চুরি করেছে, কোনও সেঞ্চুরি নেই। এমনকি, হনুমা বিহারী, পৃথ্বী শ বা মায়াঙ্ক আগরওয়ালদেরও ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে নিউজ়িল্যান্ড সফর থেকে কোনও সেঞ্চুরি নেই। এই সময়ের মধ্যে তিন জনে মিলে করেছেন তিনটি হাফসেঞ্চুরি।
অস্ট্রেলিয়াতে তুলনামূলক ভাবে ছোট স্কোরের খেলা হয়েছে প্রায় প্রত্যেকটি টেস্টে। তাই হয়তো এই খামতিটা ততটা ধরা পড়েনি। চেন্নাইয়ে রুটের ডাবল সেঞ্চুরির দৌলতে ইংল্যান্ড বিরাট স্কোর তুলে দেওয়ায় ভারতের ‘বিগ ফোর’-কেও যোগ্য জবাব দিতে হত। বিরাট-রাহানেরা সেটা করতে পারেনি বলেই টেস্ট হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। মানছি, চেন্নাইয়ের মতো কেন্দ্রে টস নিশ্চয়ই বড় নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারত প্রথমে ব্যাট করলে এই পুজারা, কোহালিরাই হয়তো বড় রানের পাহাড় চাপিয়ে দিতে পারত। কী হলে কী হত, ভেবে লাভ নেই। ভারতীয় দলকে সিরিজে ফিরতে হলে বড় ব্যাটসম্যানদের বড় স্কোর তোলার অভ্যাসে ফিরতে হবে। কোহালি, পুজারা, রাহানে, রোহিত— দুরন্ত ব্যাটিং বিভাগ আমাদের। যে কোনও প্রতিপক্ষকে ভয় পাওয়ানোর মতো। কিন্তু সেই দক্ষতার প্রতিফলন স্কোরবোর্ডে পড়তে হবে। রুটরা দেখিয়ে দিয়েছে, ওরা তৈরি হয়ে এসেছে। জবাব দেওয়ার পালা এ বার কোহালি-পুজারাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy