আগ্রাসী: আমিরদের বিরুদ্ধে রোহিতের মারমুখী মেজাজ। রবিবার পাকিস্তান ম্যাচে। ম্যাঞ্চেস্টারে। এএফপি
ম্যাঞ্চেস্টারে যাঁর ব্যাটে রোশনাই দেখা গেল, তাঁর জীবনে সব চেয়ে উচ্চারিত দু’টি জায়গার নাম?
বোরিভালি এবং ডোম্বিভালি। প্রথমটায় তিনি থাকতেন কাকার সঙ্গে। দ্বিতীয়টায় তাঁর বাবা-মা। পাকিস্তানকে হারিয়ে যিনি বিলেতের পাঁচতারা হোটেলে ঢুকে গেলেন, একটা সময়ে তাঁর স্কুলের বেতন দেওয়ার মতো সচ্ছলতাটুকুও ছিল না। এমনই পরিস্থিতি হয়েছিল যে, ক্রিকেট খেলার জন্য স্কুল পাল্টানোর কথা ভাবতে গিয়ে তাঁর পরিবারকে অনেক ভাবতে হয়েছিল। কারণ, নতুন স্কুলে বেতন অনেক বেশি। তাঁর প্রতিভা দেখে শেষ পর্যন্ত স্কুল কর্তৃপক্ষ বেতন কাটছাঁট করতে রাজি হয়। না হলে রোহিত গুরুনাথ শর্মা কোথায় যে হারিয়ে যেতেন!
জীবনে সুযোগ পেয়েও সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার যন্ত্রণা কী, রোহিতের চেয়ে ভাল কেউ জানেন না। অস্ট্রেলিয়ায় ত্রিদেশীয় ওয়ান ডে সিরিজে তাঁর স্ট্রোক নেওয়ার দক্ষতা দেখে ইয়ান চ্যাপেল পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তখনও সচিন তেন্ডুলকর যুগ চলছে। কোহালিয়ানা শুরু হয়নি। অস্ট্রেলিয়ায় রোহিতের ব্যাটিং দেখে ইয়ান বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় ক্রিকেটে রাজ করার নতুন লোক এসে গিয়েছে।’’
তার পরেও রোহিত গুরুনাথ শর্মা কোথায় যে হারিয়ে যাচ্ছিলেন! ২০১১ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন ভেস্তে গেল। তাঁর নিজের শহরে কোহালিদের কাঁধে চড়ে সচিন তেন্ডুলকরের ওয়াংখেড়ে প্রদক্ষিণ করার সময় তিনি ভারতীয় দলের ধারেকাছেও নেই। চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তাঁর দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলার স্বপ্নই।
তিরাশির পরে ফের বিশ্বকাপ জয়ের উৎসব। মোহালিতে পাকিস্তানকে হারানো। রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দেওয়া। ফাইনালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সেই বিখ্যাত ছক্কা মেরে জেতানো। মেরিন ড্রাইভে সারা রাত ধরে গাড়ির লাইন লেগে থাকা। গোটা দেশে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়া। সবই দূর থেকে দেখতে হয়েছিল রোহিতকে। ঠিক ওই সময়টাতেই সামান্য পা হড়কে গিয়েছিল তাঁর। দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে ক্রিকেটের রাজপথে সবে পা রাখতে শুরু করেছেন। আইপিএলের হাতছানি ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছে। রোহিত সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন। পাখির চোখ থেকে সরে যায় তাঁর নিশানা। পিছলে যেতে থাকেন গন্তব্য থেকে।
ভারতীয় দলের মূলস্রোত থেকে সরে গেলেন। ২০১১ বিশ্বকাপে জায়গা না হওয়াটা বিরাট ধাক্কা নিয়ে উপস্থিত হল। কোহালি যেমন আইপিএল খেলতে খেলতে এক সালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠে নিজেকে বলে ফেললেন, এত আনফিট আর মেদযুক্ত শরীর, ফোলা গাল নিয়ে ক্রিকেট কী খেলবে? তেমনই রোহিতের বোধোদয় ঘটায় ২০১১ বিশ্বকাপ। বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে টিভিতে খেলা দেখতে দেখতে তিনি বলে ওঠেন, ‘‘আমাকেও বিশ্বকাপ খেলতে হবে। তার জন্য যা যা করার, করব আমি।’’ দীনেশ লাড তাঁর ছোটবেলার কোচ। অফস্পিনার থেকে তাঁকে ব্যাটসম্যান বানানোর পিছনে দ্রোণাচার্য তিনি। এক দিন নেটে পিছন থেকে দেখেন একটি ছেলে ছোড়া বলে ব্যাটিং করছে। দেখেই বোঝেন, অসাধারণ সময়জ্ঞান। তখনই রোহিতকে বলেন, ‘‘অফস্পিন ছাড়। ব্যাটিং শুরু কর।’’ সেই শুরু রোহিতের ব্যাটিং অভিযান। রবিবাসরীয় ম্যাঞ্চেস্টারে মেঘলা আকাশের নীচেও যা সূর্যকিরণের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
দীনেশ লাড বানিয়েছিলেন রোহিত পার্ট ওয়ান। কিন্তু ম্যাঞ্চেস্টারে যাঁকে দেখা গিয়েছে, তিনি রোহিত পার্ট টু। ক্রিকেটের রাজপথে প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে হড়কে যাওয়া দিগ্ভ্রষ্টের ফিরে আসার পিছনে রয়েছে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার সময়কার প্রতিজ্ঞার কাহিনি। সেই সময়েই তিনি শপথ নেন, ওজন কমাবেন। ফিটনেস বাড়িয়ে অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দেবেন। ফিরে যাবেন ক্রিকেটের কঠিন অধ্যবসায়ে। এ দিন যে, পাকিস্তানকে চূর্ণ করে সাংবাদিকদের সামনে বলে গেলেন, ‘‘আমরা একটা মিশনে বেরিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য সেই মিশন সফল করা,’’ সেটা আসলে আগের এক বিশ্বকাপ অভিযানে স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার যন্ত্রণা থেকে শিক্ষা নেওয়া।
কোহালি যেমন নিজেকে বিশ্বের সব চেয়ে ফিট ক্রিকেটার করে তোলেন, রোহিত তা পারেননি। কিন্তু দেশের মাটিতে হওয়া বিশ্বকাপের ম্যাচ টিভিতে দেখতে দেখতে সেই যে শপথ নিলেন, পরিশ্রমে নিজেকে ডুবিয়ে দেবেন, তার পর এক মাসের মধ্যে প্রায় দশ কেজি কমিয়ে ফেললেন। নেটে ব্যাটিংয়ের সময় বাড়িয়ে দিলেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বললেন, তোরা আমাকে টার্গেট দে। আমি না পারলে দয়ামায়া দেখাবি না। এ ভাবেই তৈরি হয়েছিল রোহিত পার্ট টু-র নকশা।
তাঁকে নিয়ে বরাবরের অভিযোগ, ধারাবাহিকতা নেই। একটা ম্যাচে রান করেই আলগা দিয়ে দেন। বিশ্বকাপে দু’টি সেঞ্চুরি হয়ে গেল। কী করে এই পরিবর্তন, তা বেরিয়ে এল তাঁর কথা থেকেই। ‘‘আজ কী করলাম, সেটা নিয়ে আমি আর আগামীকাল ভাবি না। মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করি পরের লক্ষ্যের উপর। নিজেকে বলি, আবার আমাকে ভাল কিছু করতে হবে।’’
রোহিত পার্ট টু-তে স্ত্রী রীতিকার অবদানও অনস্বীকার্য। রোহিতকে নরমসরম, আত্মভোলা এক যুবক থেকে আত্মবিশ্বাসী পেশাদার করে তুলেছেন তাঁর স্ত্রী। দু’জনের বন্ধন শুরু হয়েছিল বাণিজ্য দিয়ে। রোহিতের বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত কাজ দেখাশোনা করতেন রীতিকা। সেখান থেকে গড়ে উঠল জীবনের পার্টনারশিপ। রোহিত নিজেও এ দিন চলতি বিশ্বকাপে এমন স্বপ্নের ফর্ম নিয়ে বলে গেলেন, ‘‘আমি খুব ভাল মানসিক অবস্থানে রয়েছি। পারিবারিক দিক থেকে খুব শান্তির জগতে আছি। মেয়ে হওয়ার পরে সুখশান্তির মেজাজে আছি। সেটাই আমার সাফল্যের কারণ।’’
ফাদার্স ডে-তে ভারত-পাক মহারণ। জেতালেন এক বাবা! জীবনের রাস্তায় দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসা, সংকল্প হারিয়ে যেতে যেতেও তাকে ফের আঁকড়ে ধরে সুপথে ফিরে আসা এক বাবা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy